
আদালতে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে না জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আল বদর বাহিনীর সংগঠক অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের যে আদেশ জারি করেছিল সেটি বাতিল করে আজহারকে খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকতে আপিল বিভাগও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আজহারকে। তবে ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর আবারও নতুন করে আপিল শুনানি পর খালাস পান জামায়াত নেতা আজহার।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়। অন্য কোনো মামলা না থাকলে তাকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেয় সর্ব্বোচ আদালত।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলেন।
আদালতে আজহারুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক এবং শিশির মনির।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে আজহারুল ইসলামকে আপিলের অনুমতি দিয়েছিল আপিল বিভাগ।
মামলার নথিপত্র ও আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী- একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে আজহারের বিরুদ্ধে গণহত্যা-হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে ২ নম্বর, ৩ নম্বর এবং ৪ নম্বর অভিযোগে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আজহারুল ইসলাম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন।
পরে আজহারুল ইসলামের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
আপিল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।
ওইদিন আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী (প্রয়াত) খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন (প্রয়াত) অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এর পরদিন ১৬ মার্চ আজহারুল ইসলামের মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
পরে ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আজহারুল ইসলাম আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন। ২৩ পৃষ্ঠার পুনর্বিবেচনার ওই আবেদনে মোট ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এ টি এম আজহারুল ইসলামের পক্ষ থেকে রিভিউ শুনানির জন্য আবেদন করা হয়।
ওই রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সার সংক্ষেপ দাখিল করতে বলা হয়। আর আপিল শুনানির জন্য ২২ এপ্রিল দিন ধার্য করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আজহারুল ইসলামের করা আবেদনের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগ লিভ (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর করে এই আদেশ দেয়।
আইনজীবীরা বলছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদনের প্রেক্ষিতে এই প্রথম লিভ (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর হলো।
এরপর আজহারুল ইসলাম আপিল করেন। শুনানির ধারাবাহিকতায় গত ২২ এপ্রিল আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানি পিছিয়ে ৬ মে দিন ধার্য করে দেয় আপিল বিভাগ।
পরে গত ৬ মে আংশিক শুনানি শেষে পরবর্তী শুনানির জন্য ৮ মে দিন ধার্য করা হয়।
এরপর ৮ মে শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করে দেয়।
রায়ের ধার্য তারিখে জামায়াত নেতা আজহারের আপিল মঞ্জুর করে খালাসের রায় দেয় আপিল বিভাগ।
এই রায়ের ফলে তার কারামুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আজহারের আইনজীবীরা।
রায়কে কেন্দ্র করে আদালতে উপস্থিত ছিলেন- জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন।
আরও উপস্থিত ছিলেন আব্দুল হালিম, মতিউর রহমান, জামায়াতের ঢাকা উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, মাসুদ সাঈদী, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।