
যত্রতত্র কোরবানির ফলে নর্দমাগুলোয়র মুখ আটকে যাওয়ায় ময়লা পানি বের হতে পারছে না।
গত কয়েক বছর ধরে ঈদের দিন কোরবানি দেওয়ার জন্য নির্ধারিত স্থান ঠিক করলেও এবার সে পথে হাঁটেইনি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ফলে ঈদের দিন সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন সড়ক, গলি ও অলিগলিতে যত্রতত্র পশু কোরবানির চিত্র দেখা গেছে। এতে একদিকে যেমন দুর্ভোগ বেড়েছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
২০১৫ সালে নির্দিষ্ট স্থানে পশু কোরবানির ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। শুরুতে নগরবাসীর খুব একটা সাড়া পায়নি তারা। ২০২১ সালে নির্ধারিত স্থানে পশু জবাইয়ের ধারণা থেকে সরে আসে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। উত্তরও পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিলে শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়।
তবে এবার কোনো ধরনের নির্ধারিত স্থান বা আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যদিও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. যোবায়ের হোসেন বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে নির্ধারিত কোনো স্থান ঠিক করে দেওয়া হয়নি। তবে মহাখালীতে ডিএনসিসি মার্কেট, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট এবং মিরপুর সাড়ে বারোতে আমাদের স্থায়ী জবাইয়ের জায়গা আছে। এছাড়া জোন ভিত্তিক জবাইয়ের স্থান নির্ধারণের জন্য বলা হয়েছে।”
ঈদের দিন সকালে রাজধানীর কাঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, বাংলামোটর, সাতরাস্তার মোড়, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গেন্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ী, বনানী, উত্তরা, গাবতলী, কলাবাগানসহ প্রায় সব এলাকায় রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে কোরবানি দিতে দেখা যায়। অনেকে সড়কেই গরুর ভুঁড়ি পরিষ্কার করতেও দেখা যায়। বেলা ১১টার পর রাজধানীতে বৃষ্টির পর অনেকে সড়কেই রক্ত ছড়িয়ে পরতে দেখা যায়।
নগরবাসী বলছেন, আগে থেকে নির্ধারিত স্থান না থাকায় সবাই নিজের বাসার সামনেই কোরবানি দিচ্ছেন। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বর্জ্য অপসারণও কঠিন হয়ে পড়ছে।
মগবাজারের একটি বাসায় কেয়ারটেকার রমিজ মিয়া বলেন, “গ্যারেজে একসাথে তিনটা গরু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। জায়গা না হওয়ায় একটা গরু বাইরে কোরবানি দিতে হয়েছে। তবে পরে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর পরিষ্কার করার সুযোগ পাইনি।
নির্ধারিত স্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ বছর এমন কিছু আছে বলে শুনিনি। বাড়ির মালিকও কিছু বলেনি।”
বাংলা মোটরের বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, “সময়মতো বর্জ্য অপসারণ না হলে রাস্তায় হাঁটা দুরূহ হয়ে পড়বে। আজকের মধ্যে যদি ময়লা অপসারণ না হয় তাহলে মশা-মাছি ও দুর্গন্ধে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।”
কাঠালবাগান বক্সকালভার্ট রোডে কোরবানি পশু জবাই হচ্ছে মানুষের চলাচলের রাস্তার উপরে। কোরবানির কাজে নিয়োজিত জামাল ভূঁইয়া বলেন, “সিটি করপোরেশন থেকে আমরা কোন নিদের্শনা পাইনি ফলে সুবিধা মতো জায়গায়ই পশু জবাই করছি।”
কোরবানির পশুর ময়লা-আবর্জনা ফেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন থেকে যারা ময়লা নেয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ময়লা তোলার সময় হলে তারা এসে নিয়ে যাবে। যাদের কোরবানি শেষ হয়েছে তাদের অনেকের ময়লা তুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা।”
কোরবানির পরপরই বর্জ্য অপসারণ করার আশ্বাস দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। তারা জানিয়েছে, এবার ঈদে দ্রুত বর্জ্য অপসারণে বিশেষ টিম কাজ করছে। কোরবানির পশুর বর্জ্য ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য প্রায় ২০ হাজার ২৬৭ পরিচ্ছন্ন কর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
মানুষ কোরবানি দেবেই বা কোথায়
ঈদের দুই দিন আগে বৃহস্পতিবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে উন্মুক্ত বা অনির্ধারিত স্থানে পশু জবাই থেকেও বিরত থাকতে অনুরোধ করে।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই নিশ্চিত করার আহ্বান জানায় তারা।
মন্ত্রণালয় বলেছে, “যত্রতত্র পশু জবাই, উচ্ছিষ্ট ফেলা ও বর্জ্য ফেলে রাখার কারণে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জনদুর্ভোগ তৈরি হয়, যা প্রতিরোধে সবার সচেতন অংশগ্রহণ প্রয়োজন।”
তবে বিগত বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোরবানির পশু জবাইয়ের নির্ধারিত স্থান থাকলেও এবার সেই তালিকা নেই কোথাও। সিটি করপোরেশন কিংবা মন্ত্রণালয়ে কথা বলেও তালিকার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জোবায়ের হোসেন ডটকমকে বলেন, “কোরবানির নির্ধারিত স্থান সমূহের তালিকা তো আমাদের কাছে নির্দিষ্টভাবে নেই। তবে আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে থাকতে পারে।”
অঞ্চল -১ এর সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আনিচুল হক বলেন, “কোরবানির নির্দিষ্ট জায়গার তথ্য তো আমাদের কাছে নেই। আর আমাদের অঞ্চল-১ এ কোরবানির জায়গা নেই।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপংকর বর বলেন, “এই লিস্ট তো এবার আমাদের কাছেও নেই। আগে যখন কাউন্সিলররা ছিলেন তখন এটি আমাদের কাছে আসত।”
এবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কোরবানির পশু জবাইয়ের নির্ধারিত স্থান আছে কি না জানতে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাসেল রহমানকে ফোনে পাওয়া যায়নি সেদিন।
দূষণের আশঙ্কাবাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, “রাস্তায় কোরবানি শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, এটি নাগরিক অসচেতনতার পরিচায়কও।”
তিনি নগরবাসীকে সুশৃঙ্খলভাবে কোরবানি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা কোরবানির আগে একাধিকবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে জানিয়েছি, কোরবানির পশু গরু ইন্টারনাল বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে গরুর পাকস্থলির ময়লা মিথেন গ্যাস ছাড়ায় এবং তা আমাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বড় কারণ।”
আলমগীর কবির বলেন, “আজ আমরা দেখলাম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কিছুটা চেষ্টা করেছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকার অবস্থা বেশ নাজুক। বিশেষ করে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন তাদের বিভিন্ন এলাকার কোরবানি বর্জ্য অপসারণ করতে এখনও সক্ষম হয়নি। আমরা ধারণা করছি এর ফলে পরিবেশের মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যদি আজকের মধ্যে পশুর বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে নাগরিকদের নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হবে।