Logo
×

Follow Us

প্রতিবেদন

কৈলাশটিলা: গর্ব ও দুঃখ গোলাপগঞ্জবাসীর

Icon

আবুল কাশেম রুমন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১৫:৫৫

কৈলাশটিলা: গর্ব ও দুঃখ গোলাপগঞ্জবাসীর

কৈলাশটিলা গ্যাসফিল্ড।

দুই শতাব্দীকালের সিলেট জেলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে গোলাপগঞ্জ থানাকে নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত এই ভান্ডার যেকোনো দেশি-বিদেশি পর্যটকের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। এখানে রয়েছে সবুজ সুরমা ও কুশিয়ারা বিধৌত উর্বর শস্যভূমি, সবুজ বন-বনানী, বেলে-দোআঁশ মাটিসমৃদ্ধ উঁচু-নিচু টিলাভূমি। হাওর-বাঁওড়ও কম নয়। দেশের ঐতিহ্যবাহী কৈলাশ টিলাও এখানেই অবস্থিত, যার খ্যাতি ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশে। এই কৈলাশ টিলা থেকে উত্তোলিত গ্যাস দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কৈলাশটিলার আরেকটি পরিচয়-আধ্যাত্মিক সাধক কৈলাশ শাহ (র.)-এর নামানুসারে এর নাম। এখানেই এই আধ্যাত্মিক পুরুষের মাজার। 

কালের পরিক্রমায় গোলাপগঞ্জ থানা তার অতীত গৌরব কিছুটা হারালেও শেষ হয়ে যায়নি। অবারিত সম্পদের ভান্ডার গোলাপগঞ্জ থানার অন্যতম গৌরব হচ্ছে তেল ও গ্যাসভান্ডার। তেল ও গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই মাটিতে পা পড়েছে এ দেশের প্রায় সব প্রধানমন্ত্রীর। বিদেশি তেল ও গ্যাস বিশেষজ্ঞদের আনাগোনা তো আছেই। আজকের এই প্রতিবেদন থানার কৈলাশটিলা তেল ও গ্যাস কূপকে কেন্দ্র করেই।

কৈলাশটিলা তেল ও গ্যাসকূপ সম্পর্কে আলোচনার আগে সিলেট বিভাগের খনিজ সম্পদ বিষয়ে একটি ধারণা নেওয়া দরকার। সিলেট গ্যাসফিল্ডস হচ্ছে একটি খনিজ সম্পদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সিলেট বিভাগের চার জেলায় বিস্তৃত। বাংলাদেশের 

প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল আবিষ্কার এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করে আসছে। ১৯৫৫ সাল থেকে এই কোম্পানির যাত্রা। এর পূর্বসূরি হচ্ছে পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। তারা ১৯৫৫ সালে সিলেট জেলার হরিপুরে সর্বপ্রথম গ্যাস আবিষ্কার করে। এটিই এ দেশের সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত গ্যাসকূপ। ১ নম্বর গ্যাসকূপ নামে এটি চিহ্নিত। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার এলাকার টেংরাটিলায় ছাতক কূপ-১ নম্বর খননের মাধ্যমে দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। ১৯৬০ সালে ছাতক কূপ ১ নম্বর থেকে উৎপাদিত গ্যাস ১১ মাইল দীর্ঘ চার ইঞ্চি গ্যাসের উচ্চচাপবিশিষ্ট পাইপলাইন দ্বারা দৈনিক প্রায় চার মিলিয়ন ঘনফুট হারে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সরবরাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস উৎপাদন এবং বিপণনে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ১৯৬১ সালে হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রের কূপ ৩ নম্বর থেকে উৎপাদিত গ্যাস হরিপুর থেকে ৩০ মাইল দীর্ঘ আট ইঞ্চি গ্যাসের উচ্চচাপবিশিষ্ট পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় সরবরাহ শুরু করা হয়। ১৯৮৪ সালের ৫ জুলাই কৈলাশটিলা গ্যাসফিল্ড একটি উৎপাদনশীল কূপসহ এ কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হয়। ১৯৮৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৭ নম্বর কূপে এ দেশের সর্বপ্রথম খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের তেল অনুসন্ধানের ইতিহাস একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে নির্মিত দৈনিক ৬০ এমএমসিএফ গ্যাস পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গ্লাইকল প্লান্ট এবং দৈনিক ৭০ এমএমসিএফ গ্যাস পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সলিড ডেসিক্যান্ড (সিলিকাজেল) প্লান্ট কোম্পানির আওতায় ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্রে নির্মিত দৈনিক ৯০ এমএমসিএফ পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ‘মলিকুলার সিভ টার্বো এক্স পাওয়ার প্লান্ট’ কোম্পানিতে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে সিলেট গ্যাসফিল্ডস লিমিটেড কোম্পানির আওতায় ছয়টি ক্ষেত্র রয়েছে। এগুলো হচ্ছে হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও ছাতক। এর মধ্যে হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপ, কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্রের পাঁচটি কূপ ও রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের চারটি কূপ থেকে দৈনিক গড়ে ১৪০ এমএসসিএফ পরিশোধিত গ্যাস উত্তর-দক্ষিণ পাইপলাইনের মাধ্যমে তিতাস গ্যাস সিস্টেম এবং জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেমে সরবরাহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সমপরিমাণ গ্যাসের উপজাত হিসেবে দৈনিক গড়ে ৮০০ ব্যারেল কনডেনসেট উৎপাদিত হচ্ছে। এই গ্যাসের উপজাত পেট্রোলিয়াম দ্রবাদি যথা পেট্রোল, ডিজেল, আইকেও এবং কনডেনসেট বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত হচ্ছে। কৈলাশটিলা গ্যাস উন্নয়ন (কূপ নং-৪) প্রকল্পটি সিলেট জকিগঞ্জ সড়কের পাশেই অবস্থিত। এটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬২ সালে এবং ১৯৮৩ সালে কূপ নম্বর-১ থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। কৈলাশটিলা কূপ নম্বর-২ ও ৩ খননকালে কিছু পরিমাণ পেট্রোলিয়াম উৎপাদন হওয়ায় এ ক্ষেত্রে খনিজ তৈল প্রাপ্তির সম্ভাবনা অংকুরিত হয়। এই আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে তৈল মজুদ পরিস্থিতি মূল্যায়নের লক্ষ্যে এই প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন শেষে কৈলাশটিলা ৪ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক ৫৫০ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম তৈল উৎপাদনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য তৈলাধারের সন্ধান পাওয়া না গেলে কুপটিকে গ্যাস উৎপাদনকারী কূপ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে ক্ষেত্রে কূপটি থেকে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং ৩০০ ব্যারেলের অধিক উপজাত তৈল (এনজিএল) উৎপাদিত হবে। কৈলাশটিলা তৈল মূল্যায়ন, গ্যাস উন্নয়ন কূপ 

নম্বর-৪ প্রকল্পটির অর্থায়ন সম্পূর্ণভাবে সিলেট গ্যাসফিল্ডস লিমিটের নিজস্ব সম্পদ থেকে করা হচ্ছে। তবে অর্থায়নের সুবিধার্থে বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছ থেকে পেট্রোলিয়াম তৈল উপজাত তৈলের অগ্রিম বিক্রয়মূল্য হিসেবে ১০ কোটি  টাকা পাওয়া যাবে। এ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে। 

কৈলাশটিলা নিয়ে দুঃখ

গ্যাসফিল্ড নিয়ে গর্বের পাশাপাশি লক্ষণাবন্দ ইউনিয়ন তথা গোলাপগঞ্জবাসীর দুঃখ-বেদনাও আছে। পৃথিবীর সব দেশেই এটি সাধারণ নিয়ম যে, প্রাকৃতিক সম্পদ যেখান থেকেই আহরিত হোক না কেন, স্থানীয় জনগণ পায় তার ন্যায্য হিস্যা। সে তুলনায় গোলাপগঞ্জবাসীর দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, গোলাপগঞ্জের তেল-গ্যাস সারা দেশে যাচ্ছে, শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে, দেশ উপকৃত হচ্ছে আর্থিক দিক থেকে। কিন্তু গোলাপগঞ্জের  মানুষ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গোলাপগঞ্জবাসীর জন্য নেই উন্নত অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের বিশেষ উদ্যোগ। কৈলাশটিলায় তেল ও গ্যাসের সন্ধান লাভের পর থেকেই জনগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। সংসদে বহুবার দাবি তোলা হয়েছে। কিন্তু গোলাপগঞ্জবাসী তাদের ন্যায্য হিস্যা পায়নি। 

সিলেট বিভাগ থেকে আহরিত প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ 

এবার কিছুটা পরিসংখ্যান দিতে চাই, যা থেকে বোঝা যাবে সিলেট বিভাগ থেকে কী পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরিত হয়, টাকার অঙ্কেই বা তার পরিমাণ কত। ১৯৯৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) মোট মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ৪৪৪ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য মজুদ গ্যাসের পরিমাণ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) ২৬৬ বিলিয়ন ঘনফুট। ১৯৯৬-এর জুন পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে ১৫৭.২৯৫ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট  উত্তোলনযোগ্য মজুদ ১০৮.৭০৫ বিলিয়ন ঘনফুট। একই সময়ে কৈলাশটিলায় মোট মজুদের (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) পরিমাণ তিন হাজার ৬৫৭ বিলিয়ন ঘনফুট, সম্ভাব্য দুই হাজার ৫২৯ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হয়েছে। রশিদপুরে এ সময়ে মোট মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) দুই হাজার ২৪২ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য এক হাজার ৩০৯ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলন করা হয়েছে ৬৬.৪৫৪ বিলিয়ন। ফেঞ্চুগঞ্জে মোট মজুদ ৩৫০ বিলিয়ন ঘনফুট, উত্তোলনযোগ্য ২১০ বিলিয়ন ঘনফুট, অবশিষ্ট আছে ১১১৩.৫৩৫ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে হরিপুরের ৬ নম্বর কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। কৈলাশটিলার তিনটি কূপের মধ্যে ১ নম্বর কূপ থেকে অতিরিক্ত পানি আসার কারণে ১৯৯৫ সালের ১২ মে থেকে উৎপাদন বন্ধ। বিয়ানীবাজার ও ফেঞ্চুগঞ্জ উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫