
বড় কুঠি।
পদ্মার ধারে দাঁড়িয়ে একটি পুরোনো ভবন যেন চুপ করে তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে। বাতাসে তার গায়ে লাগে ইতিহাসের ধুলোর স্পর্শ, আর নদীর স্রোতে ভেসে আসে এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের দীর্ঘশ্বাস। রাজশাহীর বুকে এমনই এক নীরব প্রত্নচিহ্ন, বড় কুঠি। সে যেন একটি স্থির গল্প, দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত কবিতা।
যাত্রা শুরু : পদ্মা যখন বিদেশকে ডেকেছিল
সতেরো শতকের বাংলায় যখন গাঢ় সবুজ ধানক্ষেতের ওপর হেলে পড়ত নীল আকাশ, তখন ইউরোপের চোখে এই ভূমি ছিল এক লোভনীয় স্বপ্ন। মসলিন, রেশম, নীল এই ত্রয়ী মোহে বুঁদ হয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা ভিড়ে এলো পদ্মার পারে। তারা দেখল এই নদী শুধু জল বয়ে আনে না, বয়ে আনে অর্থ, সুযোগ আর আধিপত্যের সম্ভাবনা। তাদেরই হাত ধরে জন্ম নিল বড় কুঠি, রাজশাহীর বুকে পাথরে লেখা ইউরোপীয় উচ্চাকাক্সক্ষার প্রতীক।
স্থাপত্যে ইতিহাস : ইট-পাথরে বাঁধা সময়ের কাব্য
১৭৮১ সালের আশপাশে গড়ে ওঠা এই ভবনটিতে মোটা দেওয়াল, খিলান আকৃতির দরজা, উঁচু ছাদ আর প্রশস্ত জানালায় যেন এক সময়ের নিঃশব্দ সৌন্দর্য আঁকা। ইউরোপীয় স্থাপত্যকলা আর বাঙালি কারিগরদের নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্টি এই ভবন এমন একটি নীরব স্থাপত্য, যা আজও নিজের ভাষায় বলে চলে ইতিহাসের চুপচাপ উপাখ্যান।
এখানে আর নেই আগের বাণিজ্যের কোলাহল, নেই চাষিদের হাহাকার, আছে শুধু নিস্তব্ধ দেওয়ালে লুকিয়ে থাকা অশ্রুজল মাখা দিনগুলোর গুঞ্জন।
শোষণ ও সৌন্দর্য : ডাচদের রাজশাহী অধ্যায়
ডাচদের আগমন রাজশাহীতে যেমন আনল আধুনিক বাণিজ্যের হাতছানি, তেমনি এনেছিল কৃষক নির্যাতনের এক নির্মম কাহিনি। বাধ্যতামূলক নীল চাষ, কৃষকদের চোখে রাতের মতো অন্ধকার হয়ে নেমে এসেছিল। যখন ইউরোপ সমৃদ্ধ হচ্ছিল বাংলার রঙে, তখন বাংলার মাটি রক্তাক্ত হচ্ছিল শোষণের ধারালো ছোবলে। এ এক দ্বৈত চিত্র, সৌন্দর্য আর শোষণের বড় কুঠির প্রতিটি ইটে যেন আজও লুকিয়ে আছে।
আজকের বড় কুঠি : অতীতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একান্ত বর্তমান
আজ এই কুঠি রাজশাহী কলেজের পাশেই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীনে। দেওয়ালে আজ আর নেই পণ্য জমার হিসাব, নেই নীল চাষের রক্তাক্ত চিৎকার, আছে শিল্পচর্চা, নীরব দর্শন আর ইতিহাসের গভীর দোলা।
প্রতিদিন অনেকেই আসে, কেউ ছবি তোলে, কেউ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা সবাই হয়তো শোনে না, কিন্তু বড় কুঠি বলে চলে তার গল্প, একটি হারিয়ে যাওয়া সময়, একটি শহরের নরম শিকড়, একটি ভূগোলের রক্তাক্ত পটভূমি।
সময়ের মুখোমুখি
বড় কুঠি কেবল একটি প্রাচীন ভবন নয়, এটি সময়ের ওপার থেকে পাঠানো এক বার্তা, এক আত্মপরিচয়ের ঘুমন্ত আয়না। যখন আমরা তার দেওয়ালে হাত রাখি, সে আমাদের ফিরিয়ে দেয় ইতিহাসের দোলায়। জানায়, ‘তোমাদের শিকড় এখানেই, এই ইট, এই পাথরে।’
পদ্মার বাতাসে এখনো ভেসে বেড়ায় সেই শতাব্দীপ্রাচীন গন্ধ, আর বড় কুঠি দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, প্রহরীর মতো।