Logo
×

Follow Us

প্রতিবেদন

ঢাকার নবাবদের গুপ্তধন ‘দরিয়া-ই-নূর’ ফিরছে?

Icon

রফিকুর রহমান প্রিয়াম

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০৯

ঢাকার নবাবদের গুপ্তধন ‘দরিয়া-ই-নূর’ ফিরছে?

প্রতীকী ছবি

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে যা ছিল কেবলই কিংবদন্তি, জল্পনা আর গুঞ্জনের বিষয়, সেই রহস্যের ওপর থেকে পর্দা সরতে চলেছে। ঢাকার নবাবদের হারানো গৌরব আর আভিজাত্যের প্রতীক, বিখ্যাত ‘দরিয়া-ই-নূর’ হীরাটি কি সত্যিই বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সযত্নে রক্ষিত আছে? যুগের পর যুগ ধরে চলা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবশেষে মাঠে নেমেছে সরকার। সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ শতবর্ষী এক ব্যাংক ভল্ট খোলার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা শুধু একটি হীরা নয়, বরং উপমহাদেশের এক বর্ণাঢ্য ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

‘দরিয়া-ই-নূর’ : আলোর সাগর

ফার্সি ভাষায় ‘দরিয়া-ই-নূর’ শব্দের অর্থ ‘আলোর সাগর’। নামটি যেমন মোহনীয়, এর ইতিহাসও তেমনি চমকপ্রদ। তবে প্রথমেই একটি বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন। ইরানের রাজকীয় রত্নভান্ডারে ১৮২ ক্যারেটের যে গোলাপি আভার হীরাটি রয়েছে, সেটির নামও দরিয়া-ই-নূর। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হীরাটি স্বতন্ত্র। এটি ২৬ ক্যারেটের একটি আয়তাকার টেবিল-কাট হীরা, যা একটি স্বর্ণের বাজুবন্ধে বসানো। মূল হীরাটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় পাঁচ ক্যারেট ওজনের আরো ১০টি ছোট হীরা। এর গঠন এবং উৎস মোগল আমলের ঐতিহ্য বহন করে।

সাম্রাজ্যের হাতবদল : কোহিনূরের সহযাত্রী

এই হীরাটির ঐতিহাসিক পথচলাও কম রোমাঞ্চকর নয়। ইতিহাসবিদদের মতে, মোগলদের পর এটি মারাঠা ও হায়দরাবাদের নিজামদের দখলে ছিল। সেখান থেকে এটি শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের কোষাগারে স্থান পায়। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করলে শিখদের বহু মূল্যবান সম্পদ তাদের হস্তগত হয়, যার মধ্যে ছিল বিশ্বখ্যাত কোহিনূর এবং এই দরিয়া-ই-নূর। চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৮৫১-৫২ সালে লন্ডনের গ্রেট এক্সিবিশনে কোহিনূরের পাশেই এই হীরাটিও প্রদর্শন করা হয়েছিল।

ঢাকায় আগমন এবং নবাবদের গৌরব

১৮৫২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক নিলামে ঢাকার প্রথম নবাব খাজা আলিমুল্লাহ হীরাটি কিনে নেন। সেই সময় এর মূল্য ছিল প্রায় ৬৩ হাজার টাকা, যা তৎকালে এক বিশাল অঙ্ক। এই হীরা কেনার মাধ্যমে ঢাকার নবাব পরিবারের গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। এটি হয়ে ওঠে নবাবদের আভিজাত্যের প্রতীক। যদিও ১৮৮০-এর দশকে লেডি ডাফরিন তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, হীরাটি তাকে ততটা আকর্ষণ করেনি, তবে তার এই মন্তব্য তৎকালীন পশ্চিমা রুচির পরিচায়ক, যা এই রত্নটির ঐতিহাসিক মূল্যকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারে না।

ভল্টের অন্তরালে দীর্ঘ এক শতাব্দী

১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ আর্থিকসংকটের কারণে তার জমিদারির কিছু অংশ এবং মূল্যবান পারিবারিক সম্পদ, যার মধ্যে দরিয়া-ই-নূরও ছিল, ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছে বন্ধক রাখেন। দেশভাগের পর সেই সম্পদ স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের জিম্মায় আসে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এর স্থান হয় বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকের ভল্টে। জানা যায়, ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে এই ভল্টে থাকা সামগ্রীর কোনো আনুষ্ঠানিক তালিকা জনসমক্ষে যাচাই করা হয়নি। বছরের পর বছর ধরে এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এমনকি এটি হারিয়ে গেছে বলেও গুজব রটেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে।

চূড়ান্ত পদক্ষেপ : যখন খুলবে রহস্যের দরজা

অবশেষে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে, অন্তর্বর্তী সরকার এই দীর্ঘস্থায়ী রহস্যের যবনিকা টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের সেই সুরক্ষিত ভল্ট খুলে নবাবদের রেখে যাওয়া ১০৮টি ঐতিহাসিক সামগ্রীর তালিকা যাচাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের কাগজপত্রে উল্লিখিত এই তালিকায় দরিয়া-ই-নূর বসানো বাজুবন্ধ ছাড়াও রয়েছে হীরাখচিত তলোয়ার, মুক্তার ঝালর দেওয়া টুপি এবং আরো অনেক অমূল্য সম্পদ।

কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

দরিয়া-ই-নূর নিছক একটি দামি পাথর নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোগল, শিখ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং ঢাকার নবাবদের উত্থান-পতনের গল্প। এই হীরা এবং নবাবদের অন্যান্য সম্পদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও প্রদর্শন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করবে। এটি প্রমাণ করবে, বাংলাদেশ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিই নয়, বরং এক বর্ণময় ও সমৃদ্ধ ইতিহাসেরও উত্তরাধিকারী। এর সম্ভাব্য বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভল্ট খোলার পর যা-ই পাওয়া যাক না কেন, এই উদ্যোগটি এরই মধ্যে দেশের মানুষের মধ্যে তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে যা ছিল কেবল গল্পকথা, তা এবার সত্যি হয়ে চোখের সামনে আসবেÑএই প্রত্যাশায় এখন পুরো জাতি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫