Logo
×

Follow Us

প্রতিবেদন

বিলুপ্তি থেকে পদ্ম রক্ষা জরুরি

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৪

বিলুপ্তি থেকে পদ্ম রক্ষা জরুরি

একসময় দেশের হাওর-বাঁওড়-বিলে সারি সারি পদ্ম ফুলের দেখা মিলত। গ্রাম্য জনজীবনে এ দৃশ্য ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। অনেকটা শাপলা ফুলের মতো। শাপলা যেমন অতি পরিচিত, তেমনি ছিল পদ্মও। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই উদ্ভিদ বাংলাদেশে সাধারণত শোভাবর্ধন এবং পুজোর অঞ্জলিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। যুগের পর যুগ ধরে মানুষের জীবনধারণ ও প্রকৃতিকে-পদ্ম নানাভাবে রক্ষা করে আসছে। যদিও এখন আর যত্রতত্র চোখে পড়ে না জলজ এই ফুলটি। খাল-বিল ভরাট করে তৈরি স্থাপনা অনেক কিছুর মতোই কেড়ে নিয়েছে পদ্ম ফুলের সহজাত জন্ম এবং বৃদ্ধি। তাই নানা কারণে আজ বিলুপ্তির পথে পদ্ম ফুল।

মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষা 

বিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের তুলনায় পদ্ম অনেক বেশি সক্ষম।’ এ ছাড়াও সিসা, তামা, ফ্লোরাইড কিংবা নাইট্রেটের মতো ভারী ধাতু শোধনের ক্ষমতা পদ্ম ফুলের রয়েছে। পদ্ম পানির মান ভালো রাখে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জলাশয়ে পদ্ম ফুলের উপস্থিতি থাকে, সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেন বেশ ভালো অবস্থায় থাকে। 

জলজ পরিবেশ রক্ষায় পদ্ম ফুল

শিল্প-কারখানা ও মনুষ্য বর্জ্যসহ বিভিন্নভাবে জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এই দূষণে নানা ক্ষতিকর উপাদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে ভারী ধাতুর উপস্থিতি লক্ষণীয়-ফলে হ্রদ, পুকুর, খাল, বিল, নদীসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন ও বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই ভারী ধাতুর দূষণ রোধ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পদ্ম ফুল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। 

পানি শোধন প্রক্রিয়ায় পদ্মের ভূমিকা নিয়ে ভারতের রাজস্থানের জয়পুরে একটি গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নগরের গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্যরে কারণে পানিতে সৃষ্ট ভৌত রাসায়নিক এবং ভারী ধাতব পদার্থ কমাতে সাহায্য করে পদ্ম। এ ছাড়াও পদ্ম পানি থেকে নাইট্রোজেন কমায় এবং নাইট্রোজেন ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।  ‘রোল অব লোটাস ইন ফাইটোরিমেডিয়েশন অব হেভি মেটাল অ্যান্ড ওয়াটার কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি  ২০২৪ সালের রেডভেট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করা হয় জয়পুরের চাঁদলাই হ্রদ ও বরখেদা পুকুরে।

২০২২ ও ২০২৩ সালের তিনটি ভিন্ন ঋতুতে চাঁদলাই হ্রদ ও বরখেদা পুকুরের বর্জ্যমিশ্রিত পানি ব্যবহার করে পদ্মের মাধ্যমে ফাইটোরিমিডিয়েশন (উদ্ভিদের মাধ্যমে দূষক দূর করা) পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, পদ্মের কারণে দূষিত পদার্থের মধ্যে টিএসএস (পানিতে অদ্রবনীয় কঠিন পদার্থ) ৫০ শতাংশ এবং রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (সিওডি) ৩৯ শতাংশ কমে যায়। পানির মান কতটুকু জলজ বাস্তুতন্ত্রর জন্য সহনীয়, তার নির্ণায়ক হলো দ্রবীভূত অক্সিজেন। যেকোনো পানিতে যদি পাঁচ মিলিমিটার দ্রবীভূত অক্সিজেন না থাকে, তবে তা জলজ প্রাণীর জন্য সহনীয় নয়।

এই গবেষণায় আরো দেখা গেছে, পদ্ম থাকলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৩৯ শতাংশ বেড়ে যায়। দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ কমে যায় ৩০ শতাংশ। আগেই বলা হয়েছে, পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি রোধ করে পদ্ম। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ৩৩ শতাংশ সিসা, ৩০ শতাংশ তামা, ২২ শতাংশ ফ্লোরাইড  ও নাইট্রেট ২২ শতাংশ। পদ্মের কাণ্ড ও শিকড়ে এনজাইম ও মাইক্রোব থাকায় ভারী ধাতব পদার্থ জমা হয়, যা পানির তাপমাত্রা ও পানির মানকে প্রভাবিত করে। 

দেশে পদ্মের পরিস্থিতি

জলাভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ার ফলে আবাস স্থল হারাচ্ছে পদ্ম। সাসটেইনেবল ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সাময়িকীতে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘ডেল্টাইক ফ্লাডপ্লেইনস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড ইকোসিস্টেম ম্যানেজমেন্ট ইন গ্যাঞ্জেস-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা রিভার্স ডেল্টা ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বাংলাদেশের জলাভূমির একটি চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অঞ্চলে শুধু নদীর প্লাবনভূমিতে প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জলাভূমি হারিয়ে গেছে। এর কারণ মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জল নিষ্কাশন ও সেচ উন্নয়ন। এ ছাড়াও জলাভূমির দখল নিয়ে মাছ চাষ করার ফলেও পদ্ম বিলীন হচ্ছে। 

বিশ্বজুড়ে পদ্মের ব্যবহার  

প্রকৃতি রক্ষা এবং সৌন্দর্য ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানাভাবে পদ্মের ব্যবহার হয়ে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, পদ্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উদ্ভিদ। চীনে তিন হাজার বছরেরও আগে থেকে পদ্মের চাষ, পদ্ম বীজ ও কন্দ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। পদ্ম থেকে তৈরি হয় বিশেষ মানের কাপড় ‘লোটাস সিল্ক’। পদ্ম ফুলের সৌরভ থেকে উৎকৃষ্ট মানের মধু ও সুগন্ধি পাওয়া যায়, যা চিকিৎসাকাজে ব্যবহার করা হয়।

চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও ভারতে পদ্মের বড় বাজার আছে। দেশগুলোতে কচি পাতা, ডাঁটা ও ফুল কাঁচা অথবা রান্না করে খাওয়ার চল রয়েছে। চীন ও জাপানে পদ্মবীজ ও কন্দ কখনো কাঁচা, কখনো ভেজে বা রান্না করে খাওয়া হয়। এমনকি ডেজার্টে ও মিষ্টিতেও পদ্মবীজ ব্যবহৃত হয়। 

খাদ্যের গঠনসংক্রান্ত উপাত্ত প্রদানকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইউএসডিএ নিউট্রিয়েন্ট ডাটাবেইস অনুযায়ী, ১০০ গ্রাম পদ্মের কন্দে ২৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৯ মিলিগ্রাম লৌহ, ২২ ম্যাগনেশিয়াম মিলিগ্রাম, ৩৬৩ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ১.৫৮ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে। পদ্মের বীজ কাঁচা খাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম পদ্মে ৫০৬ কিলোজুল এনার্জি, ৮.১ গ্রাম প্রোটিন ও ২২০ মিলিগ্রাম ফসফরাস রয়েছে। 

বিস্তৃত পদ্মের বাজার

ভারতের মহারাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াইজগাইজ নামক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মবীজ, পদ্ম ফুলের নির্যাস, পদ্মকন্দ, পদ্মপাতা ও পদ্ম গুঁড়ার সম্মিলিত বৈশ্বিক বাজার ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। খাদ্য ও পানীয়, ওষুধশিল্প, প্রসাধনী, নিউট্রাসিউটিক্যালস হিসেবে পদ্মের ব্যবহার হচ্ছে।

জার্নাল অব মেডিসিনাল প্ল্যান্ট স্টাডিজ সাময়িকীতে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘এথনো মিডিসিনাল ইউজেস অ্যান্ড ফার্মাকোলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিজ অব লোটাস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, পদ্মের পাতা, ফুল, শুকনা ফুল, কন্দ ও বীজ অন্তত ৪৮ ধরনের অসুখের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ডায়রিয়া, জ্বর, কুষ্ঠ, হাইপারটেনশনের মতো রোগও রয়েছে।

পরিবেশ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার স্বার্থে বিশ্বজুড়ে পদ্মের আবাদ ও সংরক্ষণ বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে নষ্ট হচ্ছে পদ্মের আবাসস্থল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পদ্ম সংরক্ষণ ও প্রসারে নানা গবেষণা হলেও বাংলাদেশে সে তুলনায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। 

বাংলাদেশে পদ্মের অস্তিত্ব এখন অনেকটাই হুমকির মুখে। বিশ্বের বহু দেশে প্রাকৃতিক জলাশয়ে সংরক্ষণের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের বাড়িঘরের ছাদেও পদ্মের চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশে পদ্মের চাষের সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। পদ্ম চাষের দিকে যাওয়ার আগে দেশের প্রকৃতিতে যতটুকু পদ্ম এখনো টিকে আছে তা রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫