প্রাণের শহর ঢাকা। দেশের রাজধানী ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। একসময় যে শহরকে বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস, তা আজ এক নিদারুণ বাসযোগ্যতা সংকটে ধুঁকছে। পুরো বাংলাদেশের ভার যেন এই একটি শহর প্রায় একাই বইছে। জনসংখ্যা, যানবাহন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবকিছুই যেন এই এক শহরে গাদাগাদি। এর ফলে যানজট, দূষণ ও আবাসন সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অথচ দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক শহরগুলো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে পিছিয়ে আছে, তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, এভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র টেকসই পথ হলো ‘বিকেন্দ্রীকরণ’। শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোগত বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য ও টেকসই শহরে রূপান্তরিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
নগর বিকেন্দ্রীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো একটি কেন্দ্রীয় শহরের ওপর জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের চাপ কমানো হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, বড় একটি শহর বা মহানগরীর মধ্যে জমে থাকা সুযোগ-সুবিধা, শিল্প, প্রশাসনিক কাজ এবং বসবাসযোগ্যতার বোঝা ছোট শহর, উপশহর বা শহরের বাইরের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়াকে বুঝায়।
১৯৬০ সালে যেখানে দেশের মোট নগর জনসংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ ছিল, সেখানে বর্তমানে তা প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এই বিশালসংখ্যক নগরবাসীর একটি বড় অংশ, অর্থাৎ দুই কোটিরও বেশি মানুষ, এককভাবে ঢাকায় বাস করছে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
এই অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণের ফলস্বরূপ শহরগুলোতে যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণ, আবাসনসংকট এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর অকল্পনীয় চাপ বাড়ছে। ফলে শহরের মৌলিক অবকাঠামো ও পরিষেবাগুলো এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, যা শহরের বাসযোগ্যতাকে ক্রমাগত নিম্নগামী করছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) ২০২৩ সালের একটি গবেষণার ফল বাংলাদেশের ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের ভয়াবহ চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছে। এই গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা জেলা দেশের মোট উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় ২১ শতাংশ একাই পাচ্ছে। বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল পাচ্ছে ৩২ শতাংশ, যেখানে চট্টগ্রাম অঞ্চল পাচ্ছে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ। অন্যদিকে দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল যেমন বৃহত্তর কুষ্টিয়া (১.৫৩%), পার্বত্যাঞ্চল (১.৬০%), বৃহত্তর বগুড়া (১.৬৮%) ও বৃহত্তর দিনাজপুর (১.৮০%) সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাচ্ছে। এই অসম বরাদ্দ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের উন্নয়নে একতরফাভাবে ঢাকার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা আঞ্চলিক বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং অন্যান্য অঞ্চলের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বারবার সতর্ক করছেন, নগরায়ণ যদি কেবল ঢাকা বা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক থাকে, তাহলে তা দেশের সার্বিক টেকসই উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। একটি সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়ণের জন্য বহুকেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। এই নীতি অনুযায়ী, ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও সিলেটের মতো শহরগুলোকে আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প এলাকা এবং প্রশাসনিক সুবিধাগুলোকে রাজধানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শহরগুলোতে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে করে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং ঢাকামুখী জনস্রোত কমাতে সাহায্য করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণই যথেষ্ট নয়, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণও অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত, যার ফলে স্থানীয় পর্যায়ের সামান্যতম কাজের জন্যও মানুষকে রাজধানীতে ছুটতে হয়। যদি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শাখা আঞ্চলিক পর্যায়ে গঠন করা যায়, তবে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ হবে, নাগরিকদের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে এবং ঢাকামুখী অভিবাসনও কমবে। ফলে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়বে এবং তারা নিজেদের অঞ্চলের উন্নয়নে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবে। একইভাবে আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেওয়া হয়। স্থানীয় পর্যায়ে কর আদায়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের সুষম বণ্টন এবং উন্নয়ন বাজেটে স্থানীয় সরকারের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে তারা স্বাবলম্বী হবে এবং নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করতে পারবে। অবকাঠামো ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব পেয়েছে, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধার মতো মৌলিক পরিষেবাগুলোকে আঞ্চলিক শহরগুলোতে উন্নত করা সম্ভব হবে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি অন্যান্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অপরিহার্য। এর মধ্যে একটি হলো উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন। ঢাকায় মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পগুলো প্রশংসনীয় হলেও এটিকে আরো বিস্তৃত করতে হবে এবং অন্যান্য গণপরিবহন যেমন-বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT) ও সুপরিকল্পিত বাস রুট চালুর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক পথ তৈরি করাও অত্যাবশ্যক।
গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে স্মার্ট ট্রাফিক লাইট সিস্টেম এবং উন্নত তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে, যা যানজট কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আবাসন সংকট মোকাবিলায় আঞ্চলিক শহরগুলোতে সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। বর্তমানে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন খুঁজে পাওয়া কঠিন করে তোলে। যদি আঞ্চলিক শহরগুলোতে উন্নত আবাসন সুবিধা তৈরি হয়, তাহলে ঢাকামুখী জনস্রোত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমবে।
এ ছাড়া শহরগুলোতে উল্লম্ব সম্প্রসারণের (Vertical Expansion) পাশাপাশি অনুভূমিক সম্প্রসারণের (Horizontal Expansion) জন্য সুপরিকল্পিত টাউনশিপ বা উপশহর গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থাকবে। পরিবেশদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও বিকেন্দ্রীকরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকার বায়ুদূষণ বিশ্বের অন্যতম খারাপ। এই দূষণ কমাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শহরের বাইরে স্থানান্তরের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো, গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা জরুরি। প্রতিটি আঞ্চলিক শহরেও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নকে উৎসাহিত করতে হবে। সবুজ স্থান, পার্ক ও জলাভূমি সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়, যা শহরের বাসযোগ্যতাকে উন্নত করে। ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব কমাতে প্রতিটি উপশহরে পর্যাপ্ত সবুজ বেষ্টনী ও জলাধার রাখা উচিত।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একটি শহর শুধু বাসযোগ্যই হয় না, এটি আঞ্চলিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। যেমন-বহুকেন্দ্রিক শহরগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈচিত্র্য বেশি থাকে এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। এটি দীর্ঘ যাতায়াত কমিয়ে সময় বাঁচায় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। সিঙ্গাপুর, কোপেনহেগেন ও জার্মানির কিছু বহুকেন্দ্রিক শহরের মডেল দেখিয়েছে যে, সুপরিকল্পিত বিকেন্দ্রীকরণ কীভাবে একটি শহরকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, পরিবেশগতভাবে টেকসই এবং সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারে।
তবে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনগত সংস্কার, প্রশাসনিক ক্ষমতা বণ্টন এবং স্থানীয় সরকারের আর্থিক স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত করা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি ছাড়া এই প্রক্রিয়া কার্যকর হবে না। নগর পরিকল্পনাবিদরা বারবার বলছেন, ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দেশের জন্য এক গুরুতর হুমকি। এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন না করলে ভবিষ্যতে নগর সংকট আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে স্থবির করে দেবে। ঢাকা বাংলাদেশের হৃদয়, কিন্তু এই হৃদয়কে সুস্থ রাখতে হলে দেশের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকেও সমানভাবে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে ঢাকাকে তার হারানো বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে দিতে।
