ফিলিস্তিনবিরোধী ভুয়া খবর প্রচারের শীর্ষে ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:০২

ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখতে স্টেডিয়ামে এসে ইসরায়েলের পতাকা তুলে ধরে তাদের প্রতি সমর্থনের ডাক দিচ্ছেন এক ভারতীয় নাগরিক। ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ চলমান। এ যুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় ডানপন্থী অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ব্যাপকহারে ফিলিস্তিনবিরোধী ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে। গতকাল রবিবার (১৫ অক্টোবর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এসব ভুয়া খবরের মধ্যে রয়েছে, হামাস একটি ইহুদি শিশুকে অপহরণ করেছে এবং একটি ট্রাকের পিছনে এক যুবককে শিরশ্ছেদ করছে। ব্লু চেক অ্যাকাউন্টগুলো (ভ্যারিফাইড অ্যাকাউন্ট) এসব মিথ্যা খবরগুলোকে ভাইরাল করে দিচ্ছে। হাজার হাজার লোকের দ্বারা শেয়ার করা একটি জনপ্রিয় টুইট এমনকি দাবি করেছে যে- মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনই হামাসের হামলা আসল কারণ।
ইসলাম নিয়ে “অপপ্রচারকারীদের” উত্থান
বুম, ভারতের অন্যতম ফ্যাক্ট-চেকিং পরিষেবা, ইসলাম ও ফিলিস্তিনবিরোধী ভুয়া প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দেয়া বেশ কিছু ভ্যারিফাইড ভারতীয় এক্স হ্যান্ডল ব্যবহারকারীকে খুঁজে পেয়েছে।
বুম জানায়, এসব অপপ্রচারকারীরা নিয়মিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করেছে। তারা বেশিরভাগই ফিলিস্তিনকে নেতিবাচকভাবে টার্গেট করছে অথবা ইসরায়েলের সমর্থন করছে। তারা ফিলিস্তিনিদেরকে মৌলিকভাবে নৃশংস হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি অ্যাকাউন্ট এমন এক ভিডিও প্রচার করা হয় যেখানে দাবি করা হয়েছে যে কয়েক ডজন তরুণীকে ‘ফিলিস্তিনি’ যোদ্ধারা যৌনদাসী বানিয়ে রেখেছে। তবে বুম বলছে, ভিডিওটি সম্ভবত জেরুজালেমে স্কুল ভ্রমণের। তুলনামূলকভাবে নিম্ন মানের হলেও, যদি মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে দেখা যায় মেয়েরা আনন্দের সাথে গল্প করছে এবং তাদের ফোন ব্যবহার করছে।
তা সত্ত্বেও, ভিডিওটি হাজার হাজার রিটুইট পেয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমপক্ষে ৬০ লাখ মানুষ ওই ভিডিওটি দেখেছে। ভিডিওটি শেয়ার করা অ্যাকাউন্টগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এগুলোর বেশিরভাগই ভারত থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে।
এমনকি ভারত থেকে অপারেটিং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বা ওএসআইএনটি চ্যানেল অ্যাংরি স্যাফ্রনের টেলিগ্রাম চ্যানেলেও এটি শেয়ার করা হয়েছিল।
অন্য একটি উদাহরণে, একটি ভিডিও প্রচারিত হয়েছে যা মিথ্যাভাবে দাবি করেছে যে হামাস একটি ইহুদি শিশুকে অপহরণ করছে। ভিডিওটি শুধুমাত্র একটি পোস্টে ১০ লাখের বেশি ভিউ অর্জন করেছে। বলা বাহুল্য যে, বিভ্রান্তিকর ভিডিও সমন্বিত শীর্ষ ১০টি সর্বাধিক-প্রচারিত করা টুইটগুলির মধ্যে সাতটি ছিল ভারত ভিত্তিক প্রোফাইল বা তাদের অ্যাকাউন্টগুলিতে ভারতীয় পতাকা সংযুক্ত রয়েছে৷
এই সাতটি টুইট একাই এক্স হ্যান্ডলে ৩০ লাখের বেশি ইমপ্রেশন/ভিউ পেয়েছে। তবে ফ্যাক্ট-চেকিং পরিষেবা বুম বলছে, ভিডিওটি সেপ্টেম্বরের না এবং ওই ভিডিওটির সাথে গাজা বা অপহরণের কোন সম্পর্ক ছিল না।
ইসলামোফোবিয়া, ভারত এবং সোশ্যাল মিডিয়া
এই মিথ্যা ভিডিওগুলি শেয়ার করা অনেক অ্যাকাউন্টও এক্স হ্যান্ডলে মুসলিম বিরোধী মন্তব্য পোস্ট করার জন্য তাদের অনেক সময় ব্যয় করে।
এমনই একটি অ্যাকাউন্ট, মিঃ সিনহার, যিনি হামাস কর্তৃক একটি ছেলের শিরশ্ছেদ করার মিথ্যা ভিডিও শেয়ার করেছেন, একই পোস্টে #IslamIsTheProblem হ্যাশট্যাগ অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
অন্য একটি অ্যাকাউন্ট যেটা থেকে ফিলিস্তিনিদের যৌনদাসী অপহরণ করার বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিল- সেটিতে আগে লেখা হয়েছিল: “মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ধর্মে গ্রহণ হয় তখন তারা সুখে থাকে। কিন্তু হিন্দু মেয়েরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাদের শেষ গন্তব্য হয় স্যুটকেস কিংবা ফ্রিজ। এটাই একমাত্র পার্থক্য।”
অন্যদের ভিতরও ফিলিস্তিন-বিদ্বেষ স্পষ্ট। একটি ভারতীয় অ্যাকাউন্ট, যা একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সৈনিকের, বলেছে, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই গ্রহ থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে দিতে হবে।’
এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে ভারতের অনেক মানুষের ইসলামভীতি রয়েছে, যা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) উত্থানের পর থেকেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ইসলামিক কাউন্সিল অফ ভিক্টোরিয়ার একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে সমস্ত ইসলামোফোবিক টুইটগুলির বেশিরভাগই ভারতীয় নাগরিকদের।
আগুন যেমন পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ইসলামবিদ্বেষীদের তেমনভাবে টেনে এনেছে এবং এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। এই অনলাইন বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালছে স্বয়ং বিজেপির আইটি সেল।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদীর এক বইয়ে। স্বাতী চতুর্বেদী তার বই, আই অ্যাম এ ট্রল-এ বিজেপির অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়া আর্মি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
চতুর্বেদীর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের একজন সাধবী খোসলা। তিনি বিজেপির অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়া আর্মিতে ছিলেন একসময়। তিনি জানান, ‘বিজেপির স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে যারা সমালোচনামূলক কণ্ঠকে ট্রল করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া সেল এবং দুটি অনুমোদিত সংস্থা থেকে নির্দেশনা পায়।’
খোসলা বলেন যে তিনি ‘ঘৃণা, নারীবিদ্বেষ ও ইসলামফোবিয়া’-এ সব মিথ্যাচার দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ‘বিজেপির আইটি সেল’ ত্যাগ করেন।