
বিজেপির লোগো। ছবি: সংগৃহীত
ভারতে গত এক দশক ধরে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার সংবাদ মাধ্যমসহ সব মাধ্যম ব্যবহার করে আসছে। বাদ যায়নি বলিউডও। তারকাদের শুধু টিকিট দিয়ে দলে ভেড়ানো নয়; নির্বাচনী হাওয়া এলে বা কোনো ইস্যু সামনে পেলেই একের পর এক প্রপাগান্ডা সিনেমা বানানো হচ্ছে বলিউডে।
এবারের নির্বাচন হতে চলেছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ইস্যুহীন নির্বাচন; যেখানে অর্থনীতি বা জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুও নেই। আছে শুধু বিভাজনের রাজনীতি। আর তাই বিজেপির প্রপাগান্ডা সিনেমাগুলোতেও সেটিই দেখানো হয়েছে।
ধর্মীয় ভাবাবেগকে সুকৌশলে উসকে দেওয়া, বিভাজন বিষের তীব্রতা বাড়িয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিকীকরণ এবং ইতিহাসকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে রাজনৈতিক বিরোধীদের কোণঠাসা করতে বলিউডকে নরেন্দ্র মোদি আমলে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; এমনটা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এমন কিছু চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে-‘কাশ্মীর ফাইলস’, ‘রাম সেতু’, ‘কেরালা স্টোরি’, ‘৭২ হুরে’, ‘রাজাকার’, ‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকার’, ‘আর্টিকল ৩৭০’, ‘জেএনইউ’, ‘সবরমতী রিপোর্ট’, ‘গোধরা’, ‘ডাইরি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’। এ তালিকা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। হিন্দি বলয়ে এমন ছবিকে চিহ্নিত করা হয় ‘গোদি মুভি’ নামে। সচরাচর সিনেমার বিষয়বস্তুর আভাসটুকু কেবল দেওয়া থাকে তার ট্রেলারে, ক্লাইম্যাক্স ফাঁস করা হয় না। এতে কৌতূহল জাগে দর্শকের মনে। কিন্তু প্রপাগান্ডা ছবিগুলোর ট্রেলারও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্বেষে আবির্ভূত! স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রপাগান্ডা তিন পথে পরিচালিত হয়-নির্জলা মিথ্যাচার, আংশিক সত্যের অপলাপ এবং বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ। প্রতিবাদী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংবাদমাধ্যম কাউকেই রেহাই দেওয়া হচ্ছে না।
‘আর্টিকল ৩৭০’ সিনেমার সংলাপে কেন্দ্রীয় চরিত্র জুনি হাকসার অভিযোগ করছেন, তার স্কুলের যে সহপাঠী প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হতেন, সেই শিবম কুমার এখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নাকি কোনো তফসিলি জাতির মানুষকে সরকারি চাকরি করার অধিকারই দিত না! জুনি আরও বলছেন যে, কোনো কাশ্মীরি নারী কাশ্মীর-বহির্ভূত কাউকে বিয়ে করলে অনুচ্ছেদ ৩৭০ তাকে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে।
বাস্তবে যে ছেলে এতটাই মেধাবী যে প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হন, তাকে সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতে হবে কেন! তিনি নিজের কৃতিত্বেই কর্মসংস্থান করে নিতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অনুসারে, জম্মু ও কাশ্মীরে নিজস্ব সংবিধান প্রযোজ্য ছিল। কাশ্মীরের সংবিধান জাত, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষালাভের সুযোগ দেয় এবং কর্মক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার প্রদান করে। কাশ্মীরে তফসিলি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩টি। বরওয়ালা, বসিৎ, বটওয়াল, চামার বা রামদাসিয়া, চুহরা, ধিয়ার, ডোম বা মহাশ, গরদি, জলাহা, মেঘ বা কবীরপন্থি, রতল, সরিয়ারা এবং ওয়াতাল। তারা সবাই শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকার পান। তবে পান না, এমন সম্প্রদায়ও রয়েছে। ১৯৫৭ সালে জম্মুতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ধর্মঘট ঘোষণা করলে বেগতিক দেখে তদানীন্তন বক্সি সরকার পাঞ্জাব থেকে বাল্মীকি জনজাতির কিছু পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে জম্মুতে নিয়ে আসে। তাদের পরিবারসহ থাকার জন্য বাসস্থান দেওয়া হয়। তাদের সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা যায় পরবর্তী প্রজন্মে গিয়ে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেহেতু কাশ্মীরি নাগরিক নয়, তাই কাশ্মীরের সংবিধান তাদের ওপর প্রযোজ্য হয় না। ফলে সংবিধান-প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়ে পড়েন।
২০০১ সালের শেষ জনশুমারি অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরে তফসিলি জনজাতির সংখ্যা ৭ লাখ ৭০ হাজার। আর বাল্মীকি জনজাতির সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম। অর্থাৎ তারা মোট তফসিলির প্রায় ০.৬ শতাংশ। সিনেমায় ওই ০.৬ শতাংশকে দেখিয়ে গোটা তফসিলি জাতির কথা বলা হয়।
আবার কাশ্মীরি নারী অ-কাশ্মীরি কাউকে বিয়ে করলে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার যে গল্প ছবিটিতে শোনানো হয়েছে, সেটি আদতে পুরনো আইনের একটি অলক্ষিত ফাঁক। ২০০২ সালের ৭ অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্ট বিধান খারিজ করে দেয়। ফলে সিনেমায় দেখানো গোটা বক্তব্যই অন্তসারশূন্য।
জাহাঙ্গীর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নামাঙ্কিত ‘জেএনইউ’ সিনেমায় নাম বিকৃত করে আদতে সন্ত্রাসবাদের আখড়া সাজানো হয়েছে ভারতের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিকে। ‘কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমায় গোপন রাখা হয়েছে ৯০-এর প্রেসিডেন্টশাসিত কাশ্মীরে পণ্ডিত বিতাড়নের পেছনে তদানীন্তন রাজ্যপাল জগমোহন মলহোত্রার কদর্য অবদান। যিনি ইমার্জেন্সির সময় সঞ্জয় গান্ধীর দিল্লি সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্পে তুর্কমান গেটে মুসলিম বস্তির ওপর বুলডোজার চালিয়ে প্রথম সংবাদ শিরোনামে আসেন। পরে তিনি প্রথমে রাজ্যসভায় ও পরে লোকসভায় বিজেপির এমপি হন।
সিনেমাগুলোর শুরুতে ডিসক্লেইমার দিয়ে বলা হয়, সেগুলো আদৌ বাস্তবভিত্তিক নয়, বরং সম্পূর্ণ কাল্পনিক।