
কলকাতার ট্রাম। ছবি: সংগৃহীত
১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ সাল, কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ‘জল খাবার’ হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। চারপাশে কী হচ্ছে- এ নিয়ে কোনো কৌতূহল নেই কবির। দূর থেকে ট্রাম ছুটে আসছে, ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে অবিরত- কাছাকাছি থাকা দুই-একজন পথিক চিৎকার করে সতর্ক করলেন ‘ট্রাম আসছে-সরে যান’।
আপন মনে হাঁটতে থাকা জীবনানন্দ দাশ শেষমুহূর্তেও সরতে পারলেন না। ট্রামের ধাক্কায় পড়ে গেলেন, ক্যাচারে আটকে গেল শরীর- এ অবস্থাতেই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে ট্রাম থামল। জলখাবার থেকে ছুটে এলেন দোকানের মালিক চুনিলাল দেব। ট্রামের ক্যাচার থেকে বের করে আনেন কবিকে।
পাঁজর, ঊরু, কাঁধের হাড় ভেঙে সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আট দিনের মাথায় ২২ অক্টোবর ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে শঙ্খচিল-শালিকের বেশে ফেরার বাসনা নিয়ে অনন্তের পথে চলে গেলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশ। এবার জীবনানন্দের কাছেই চলল কলকাতার ট্রাম। অর্থাৎ পাকাপাকিভাবে কলকাতা শহরতলি থেকে ট্রাম-সেবা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। শহরের অস্থিমজ্জায় শিরা-উপশিরার মতো বইতে থাকা ট্রামের লাইনগুলোও তুলে ফেলতে চায়। এতে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হয়ে গেছে কলকাতাবাসীর। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন অনেকেই। লেখক সুপ্রিয় চৌধুরী ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- ‘ভালো থেকো পার্ক সার্কাস, ধর্মতলা খিদিরপুর, হাওড়া, গালিফ স্ট্রিট...! ইতি-ট্রাম’। তার পোস্টে পার্থ রায় নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘শ্যামবাজার ডিপোর জন্য রইলো আমার শুভকামনা। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫- দীর্ঘ ছবছর বহন করেছে হাতিবাগান থেকে কলেজ স্ট্রিট। ভালো থেকো ট্রাম’।
কলকাতার ট্রাম-সেবার ইতিহাস ১৫০ বছরের। ট্রাম পরিষেবা চালু রাখার দাবিতে ‘কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন’ হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিল। মামলার ফলে ট্রামের বিষয়ে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছিলেন আদালত। ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় রাজ্য সরকার। শহরে এখন মাত্র দুটি রুটে ট্রাম চলছে। রাজ্য পরিবহনমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানান, শুধু পর্যটকদের জন্য ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত একটি ট্রাম চলবে। এ ছাড়া শহরের বুকে ছড়িয়ে থাকা সব ট্রাম লাইন তুলে ফেলা হবে। কলকাতাই ভারতের একমাত্র শহর, যেখানে এখনও ট্রাম চলে। কলকাতা শহরে ১৮৭৩ সালে যাত্রা শুরু করে ট্রাম। আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ছিল তার যাত্রাপথ। এ যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩.৯ কিলোমিটার (২.৪ মাইল)। উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ট্রাম পরিষেবা ছিল এটি; কিন্তু যাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই পরিষেবা। তার পর ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’ নামের লন্ডনভিত্তিক কোম্পানিটি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে। প্রথম দিকে ঘোড়া টানা ট্রাম চলাচল করত শহরে।
তখন ট্রাম কোম্পানিটির হাতে ১৭৭টি ট্রাম ও ১০০০টি ঘোড়া ছিল। পরে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় ট্রাম চালানোর জন্য। তখন ট্রাম কোম্পানির ১৯ মাইল দীর্ঘ ট্রাম লাইন ছিল। ১৯০০ সালের শুরুতে ১৪৩৫ এমএম (৪ ফুট ৮.৫ ইঞ্চি) স্ট্যান্ডার্ড গেজের ট্রাম লাইন চালু হয়। ১৯০২ সালে বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়- এটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। ধুঁকতে ধুঁকতে বন্ধ হতে চলা এই ট্রামকে কেন্দ্র করেই গত শতকের পঞ্চাশে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কলকাতা শহরতলি। ট্রাম ভাড়া ১ পয়সা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তই ছিল এর মূলে।
ঘটনাটির বিস্তারিত ছুঁয়ে আসা যাক- ‘১৯৫৩ সালে কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জুলাই থেকে ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ১ পয়সা বাড়ানো হবে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) আন্দোলনের ডাক দেয়। পশ্চিমবঙ্গের সব বামপন্থী রাজনৈতিক দল এক জোট হয়ে যায় আন্দোলনের সমর্থনে। ভাড়া বৃদ্ধি ঠেকাতে ও আন্দোলন জোরদার করতে গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ কমিটি। নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সিপিআই নেতা ও পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু। সভা-সমাবেশ, মিছিল, ট্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, ১৪৪ ধারা জারি, গ্রেপ্তার, মুক্তি- কী হয়নি তখন! বামপন্থিদের ক্ষমতায় আসার ভিতটা তখনই তৈরি হয়ে যায় বিপুল জনসমর্থনে। কংগ্রেস সরকারের ভিত টালমাটাল হয়ে যায়। ভাড়া বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখতে সরকার বিশেষ কমিটি গঠন করে- ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ব্রিটিশ কোম্পানিটি’।
১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কোম্পানিকে সরিয়ে ট্রামের জাতীয়করণ করা হয়। কলকাতার মানুষের দৈনন্দনি জীবনে হয়তো ট্রামের প্রয়োজনীয়তা কমেছে, তবে ফুরিয়ে যায়নি- এ কথা তো বলাই যায়। প্রশ্ন এসে যায়- স্মৃতির পরতে পরতে মিশে থাকা ট্রাম বন্ধ হতে দেবে কি কলকাতাবাসী?