
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
পাঁচ দিনের (৬ থেকে ১০ অক্টোবর) দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। মালদ্বীপ, ভারত এবং ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে এ সফরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
বিশেষত দেশটির ঋণ বাড়ছে, রাজস্বের পরিমাণ কম, রিজার্ভও কমছে, বাজেট ঘাটতিও আছে। সে কারণে আর্থিক সহায়তা খুঁজছে মালদ্বীপ। মুইজ্জু গত বছরের নভেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। এরপর থেকেই ভারতের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর করেন চীনে। পাঁচদিনের ওই সফর শেষে দেশে ফিরে মালদ্বীপে উপস্থিত ভারতীয় সেনাদের ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়।
তখন ভারতের কড়া ভাষায় সমালোচনা করে মুইজ্জু বলেন, ‘আমাদের দেশ ছোট হতে পারে, তবে আমাদের ধমক দেওয়ার লাইসেন্স কারও নেই। এই মহাসাগর একটি নির্দিষ্ট দেশের নয়। মহাসাগরটি এখানে অবস্থিত সব দেশের অন্তর্ভুক্ত। আমরা কারও বাড়ির উঠানে নেই। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।’
সেই অবস্থার বদল ঘটে চলতি বছরের জুন মাসে, যখন তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারত সফর করেন মুইজ্জু। কয়েক মাস ধরে সম্পর্কের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে মালদ্বীপ। এর আগে ভারত থেকে ঘুরে গিয়েছেন সে দেশের আর এক মন্ত্রীও। এবার মুইজ্জু নিজে এসেছেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে। ভারত সফরকালে ভারতের কাছে তার দেশের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কারণ দ্বীপদেশটি অর্থনৈতিক সংকটে আছে। দেশটি ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা করছে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক পি সাহাদেবন বলেন, মুইজ্জুর সরকার তার চীনপন্থি অবস্থান পরিবর্তন না করেও ভারতের প্রতি অবস্থান নরম করেছে।
মালদ্বীপের অর্থনৈতিক সংকট এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি। নির্বাচনি প্রচারে জনগণের কাছে মুইজ্জুর মূল অঙ্গীকার ছিল- ‘ভারত হটাও’ নীতি। মূলত মালদ্বীপের ওপর ভারতের প্রভাব কমানোই ছিল তার লক্ষ্য।
কূটনীতি বিশেষজ্ঞ অনিল ওয়াধওয়া মনে করছেন, মুইজ্জুর এই সফর তার ‘ইন্ডিয়া আউট’ অবস্থান থেকে সরে আসার একটি সংকেত। মালদ্বীপ বুঝতে পেরেছে যে, ভারতই একমাত্র দেশ, যেটি মালদ্বীপের সংকটে দ্রুত সাড়া দিতে পারে এবং আর্থিক সংকটের সময়ে তাকে উদ্ধার করতে পারে।
গবেষণা সংস্থা মন্ত্রয়ার প্রধান শান্থি ম্যারিয়েট ডি’সুজা জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, মুইজ্জুর সরকার আপাতদৃষ্টিতে ভারতের সঙ্গে অনুকূল সম্পর্ক থাকলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে কিছু বাস্তবতা যাচাই করেছে। এটিকে নীতি পরিবর্তন বলা এখনই ঠিক হবে না, তবে এটা অবশ্যই ভারত-মালদ্বীপের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিবাচক অগ্রগতি। ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রেখে লাভবান হতে চাইছে মালদ্বীপ।
গত মাসে মালদ্বীপের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ দিয়ে দেড় মাসের আমদানি খরচ মেটানো সম্ভব। গত মাসে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স মালদ্বীপের ক্রেডিট রেটিং (ঋণমান) কমিয়ে দেয়।
সংস্থাটি জানায়, মালদ্বীপের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাস্তবিক অর্থে বেড়েছে। এখন ভারত আর্থিক সহায়তা দিলে তা মালদ্বীপের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে।
মুইজ্জু এরইমধ্যে তুরস্ক ও চীন সফর করেছেন। বিশেষ করে গত জানুয়ারিতে তার চীন সফরকে নয়াদিল্লির প্রতি মালদ্বীপের একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কারণ মালদ্বীপের পূর্ববর্তী নেতারা নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের প্রথম বিদেশ সফরের জন্য নয়াদিল্লিকেই বেছে নিয়েছিলেন। মালদ্বীপের বিশ্লেষক ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রভাষক আজিম জহির বলেন, প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর ভারত সফর বিভিন্নভাবে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- মালদ্বীপ তার প্রতিবেশী ভারতের ওপর কতটা নির্ভরশীল, এর প্রতিফলন মুইজ্জুর এই সফর। ভারতের ওপর মালদ্বীপের যে নির্ভরতা, তা অন্য কোনো দেশ সহজে পূরণ করতে পারবে না।
ভারত মহাসাগরে অবস্থিত প্রায় ১ হাজার ২০০টি প্রবালদ্বীপ নিয়ে মালদ্বীপ গঠিত। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার। ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তার বেশিরভাগ খাদ্য, অবকাঠামো নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল।