Logo
×

Follow Us

দক্ষিণ এশিয়া

সিন্ধুর পানি না পেলে কী হবে পাকিস্তানের?

Icon

পাকিস্তানের কাশ্মীর অংশে সিন্ধু নদী

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:৫৬

সিন্ধুর পানি না পেলে কী হবে পাকিস্তানের?

পাকিস্তানের কাশ্মীর অংশে সিন্ধু নদী

পাকিস্তানের কাশ্মীর অংশে সিন্ধু নদী।

কাশ্মীরের পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার পেছনে পাকিস্তান জড়িত বলে অভিযোগ করছে ভারত। মঙ্গলবারের ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন। হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে এই চুক্তি হওয়ার পর দুই দেশ তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। কিন্তু তা চুক্তিতে কোনো প্রভাব ফেলেনি। মোদী প্রশাসন যেই সিদ্ধান্ত নিল -সেটি নজিরবিহীন।

ভারতের চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, এমনটা হলে -পাকিস্তান তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে দেখবে।

বৃহস্পতিবার ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আলী মুর্তজাকে দেওয়া চিঠিতে লিখেছেন, ভারত ওই চুক্তি স্থগিত করছে এবং ‘অবিলম্বে তা কার্যকর’ হবে।

সিন্ধু পানিচুক্তির প্রেক্ষাপট

প্রায় এক যুগ ধরে আলোচনার পর বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম টেকসই আন্তঃদেশীয় পানি চুক্তি হিসেবে পরিচিত।

চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু নদী অববাহিকার ছয়টি নদী দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়। ভারত পায় পূর্বের তিনটি নদী (রাভি, বিয়াস এবং সুতলজ)। পাকিস্তান পায় পশ্চিমের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝেলম এবং চেনাব। এই তিন নদী সম্মিলিতভাবে অববাহিকার মোট পানির প্রায় ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে।

চুক্তি অনুযায়ী ভারত পশ্চিমের নদীগুলোর পানি সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না। তবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সীমিত পরিমাণ সেচের জন্য পানি ব্যবহার করতে পারে। তবে এই ব্যবহারে কিছু কঠোর শর্ত আছে যাতে নদীর প্রবাহ ব্যাহত না হয়। এসব শর্ত নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।

পাকিস্তানের জন্য এই চুক্তি শুধু পানি সরবরাহই নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আগেভাগে পরিকল্পনার করার সুযোগ নিশ্চিত করেছিল।

চুক্তিটি সহযোগিতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থাও প্রদান করে। একটি স্থায়ী সিন্ধু কমিশন রয়েছে, যেখানে দুই দেশ থেকে একজন করে কমিশনার থাকেন। এদের কাজ হলো তথ্য বিনিময় করা, নতুন প্রকল্প পর্যালোচনা করা এবং নিয়মিত বৈঠক করা।

বিভিন্ন মতপার্থক্য একটি স্তরভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। প্রথমে কারিগরি বিষয়গুলো কমিশনের কাছে যায়। যদি সেখানে সমাধান না হয়, তাহলে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। আইনি বিরোধ থাকলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে পাঠানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে।

একই প্রক্রিয়া এর আগে ভারতের বাগলিহার ও কিশনগঙ্গা বাঁধ নিয়ে বিরোধ সমাধানে ব্যবহার করা হয়েছে।

চুক্তিটির কোনো মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন নেই। এটি স্থগিত করার কোনো নিয়মও নেই। চুক্তির ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, এটি শুধু দুই দেশের পারস্পরিক সম্মতিতে পরিবর্তন করা যেতে পারে। আজ পর্যন্ত এমনটা কখনও হয়নি।

পাকিস্তান যে ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান এফ খান লিখেছেন, “পানি আটকে রাখার ক্ষেত্রে ভারতের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে চুক্তির সুরক্ষাগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়া তবুও গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ হলো, পানি কাল থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে নয়। যে ব্যবস্থা এই পানির ওপর নির্ভর করে, সেটি কখনোই অনিশ্চয়তার জন্য তৈরি হয়নি।”

পাকিস্তানের হাবিব বিশ্ববিদ্য়ালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরও লিখেছেন, “সিন্ধু, ঝেলম এবং চেনাব নদীর প্রবাহ আমাদের কৃষি, আমাদের শহর, আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এই মুহূর্তে, এই পানির কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। ভারতের পক্ষ থেকে পানির প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটলে, পাকিস্তানের জন্য এই প্রভাব অনেক গভীর হতে পারে। পাকিস্তানের সেচ ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম। এটি প্রায় পুরোপুরি পশ্চিমের নদীগুলোর নির্ভরযোগ্য পানি প্রবাহের সময়সূচির ওপর নির্ভরশীল।”

হাসান এফ খান লিখেছেন, “পানি প্রবাহের সময় বুঝে কৃষকরা তাদের ফসল বোনার পরিকল্পনা করেন। খালের সময়সূচিগুলো এমন কিছু ধারণার ওপর তৈরি, যেগুলো দশকের পর দশক ধরে ঠিক ছিল। যদি এই তাল ছন্দ সামান্যও ভেঙে যায়, তাহলে পুরো পানি ব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে পড়বে।”

তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তানে পানি কখন আসবে সেই সময়সূচিতে সামান্য পরিবর্তন হলেও বাস্তব সমস্যা তৈরি হতে পারে। গম বপনের মৌসুমে যদি পানি দেরিতে আসে, অথবা শুষ্ক শীতকালে হঠাৎ পানির প্রবাহ কমে যায়, তাহলে বপনের সময় পার হতে পারে। একই সঙ্গে ফলন কমতে পারে এবং খরচ বেড়ে যেতে পারে।”

পরিবেশ বিজ্ঞানী হাসানের মতে, মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নদীর বদ্বীপ ইতোমধ্যেই সংকুচিত হচ্ছে। যদি উজানে পানির প্রবাহে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তাহলে এই অবক্ষয় আরও দ্রুত হতে পারে। এর ফলে উপকূলীয় জীবিকা এবং মৎস্য শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

তিনি লিখেছেন, “নদীর পানির পরিমাণ কমে যাওয়া বা সময়ের তারতম্য হলে সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোথায় কত পানি দেবে সেটি নিয়ে। এতে আন্তঃপ্রাদেশিক টানাপোড়েন বাড়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যে, যেখানে পানিবণ্টন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা আগে থেকেই আছে।”

হাসান লিখেছেন, “এরপর আছে বিদ্যুৎ বিষয়ক ঝুঁকি। পাকিস্তানের মোট বিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ জলবিদ্যুৎ থেকে আসে। যদি উজানে পানির প্রবাহ কমে যায় বা সঠিক সময়ে না আসে, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে পারে। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই পানির সংকটের মধ্যে রয়েছে। এখন সেই ব্যবস্থাই নতুন এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।”

পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের সাবেক সেচমন্ত্রী মহসিন লেঘারি টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রথম আলোকে বলেন, “পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের কৃষিব্যবস্থা পুরো্পুরি সিন্ধু ও শাখা নদ–নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় সিন্ধু নদ ও এর শাখা নদ–নদীগুলোর পানি দিয়ে। সুতরাং ভারত যদি একতরফাভাবে এই চুক্তি স্থগিত করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তানে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।”

মহসিন লেঘারি জানান, পাকিস্তানের কৃষির বেশির ভাগ ফসল আসে পাঞ্জাব রাজ্য থেকে। আর পাঞ্জাবের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কৃষির কাজে সেচের পানির জোগান আসে সিন্ধু ও অন্যান্য শাখা নদী থেকে। চুক্তি স্থগিত করে ভারত পানি বন্ধ করে দিলে দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের কৃষি উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। আবার বর্ষা মৌসুমে ভারত পানি ছেড়ে দিলে অতি বন্যাও দেখা দিতে পারে।

পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) দলের কেন্দ্রীয় এই নেতা বলেন, “পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী দেশটির জীবন, জীবিকা এবং প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই এই নদীগুলোর বিকল্প নেই। সিন্ধু পানিচুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাকিস্তানে খরা বাড়বে, মরুভূমি হবে, কৃষি ও সেচ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষক বেকার হয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের জন্য সমাজে অস্থিরতা ও হাহাকার বাড়বে। সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।”

মহসিন লেঘারির মতে, পাকিস্তানের অবশ্যই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যাওয়া উচিত। কারণ, ৬৫ বছরের পুরোনো চুক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক হঠকারী সিদ্ধান্তে ভেস্তে যেতে পারে না।

মহসিন লেঘারি বলেন, “সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করতে ভারতের তরফ থেকে নেওয়া এই সিদ্ধান্তটা সত্যিই অমানবিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক থামানো যায়; কিন্তু নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, অথবা নদীর সঙ্গে নদীর সম্পর্ক থামানো যায় না।”





Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫