Logo
×

Follow Us

দক্ষিণ এশিয়া

ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে কাশ্মীরের সন্ত্রাসী হামলা

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ১০:০৩

ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে কাশ্মীরের সন্ত্রাসী হামলা

প্রতীকী ছবি

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সংকটের ইঙ্গিতবাহী। এই ঘটনা শুধু একটি স্থানীয় সহিংসতা নয়, বরং এটি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক কূটনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

২২ এপ্রিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগাম শহরে সকালটা তখনো স্বাভাবিক ছন্দেই কাটছিল। সেই স্বাভাবিকতা ভেঙে এলোপাতাড়ি গুলিতে বিধ্বস্ত হয় গোটা এলাকা। বন্দুকধারীদের হামলায় প্রাণ হারান ২৫ পর্যটক এবং একজন স্থানীয় অধিবাসী, যিনি এ হামলায় বাধা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আরো উত্তপ্ত বিষয় হলো, এই হামলা ঘটেছে এমন সময়ে যখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ভারত সফর করছিলেন।

এই হামলা এসেছে কয়েক বছর ধরে চলা আপাত শান্ত পরিস্থিতির মধ্যে, যেখানে মাঝে মাঝে ছোটখাটো সহিংসতা দেখা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই শান্ত পরিস্থিতিকে ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতির ফল বলে দাবি করে আসছে। এই ধারা বাতিলের মূল যুক্তি ছিল নিরাপত্তা, পর্যটন ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করা। কিন্তু পেহেলগাম হামলা এই কৌশলের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিয়েছে। বিশেষত, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতায় ভারত অকৃতকার্য প্রমাণিত হয়েছে।

হামলার পরই মোদি এই ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদের ‘জঘন্যতম অধ্যায়’ বলে উল্লেখ করেন। ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এর জবাবে ‘ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি’ স্থগিত করেছে, যা দুই দেশের মধ্যে ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি এবারই প্রথম স্থগিত হলো এবং এটি একটি বড় ধরনের উত্তেজনার সূচনা করতে পারে, কারণ সিন্ধু নদী পাকিস্তানের জন্য জীবনরেখাস্বরূপ। 

অন্যদিকে পাকিস্তান সরাসরি অভিযোগ অস্বীকার করে। ইসলামাবাদের দাবি, পুরো হামলা ভারতের সাজানো ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’। উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে হেয় করা। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে, বাতিল করে ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা এবং স্থগিত করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। সীমান্তের দুই প্রান্তে থেমে থেমে চলে গোলাগুলি। পাকিস্তান ১৯৭২ সালের ‘শিমলা চুক্তি’ স্থগিত করেছে, যা জম্মু-কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্যে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং কাশ্মীর ইস্যু দ্বিপক্ষীয় ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের বিধান রেখেছিল। 

যদিও পূর্ণাঙ্গ সামরিক আক্রমণ অসম্ভব ও ঝুঁকিপূর্ণ; তবুও শুধু প্রদর্শনীমূলক জবাবও ভারতীয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। শেষ পর্যন্ত নয়াদিল্লিকে দেখাতে হবে যে, ভারতকে আক্রমণের ভয়াবহ পরিণতি হবে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতা ধ্বংস করতে হবে। একটি সম্ভাব্য অভিযান হতে পারে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের জন্য ব্যবহৃত ঘাঁটিগুলো দখল করা। তবে তা সহজ নয়। পাকিস্তানের পক্ষেও পরিস্থিতি অনুকূলে নেই।

প্রশ্ন হলো পাকিস্তান কেন ভারতের সঙ্গে বছরের পর বছর শান্তি বজায় রাখার পর এমন একটি কাণ্ড ঘটাবে? ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব জনমত পাকিস্তানের পক্ষে একেবারেই নেই। খুব কম দেশই পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়েই ভারতের সঙ্গে শক্ত সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ভারত যদি সামরিক বা অর্থনৈতিকভাবে জবাব দিতে চায়, তাহলে তারা সংযত হওয়ার জন্য চাপ দেবে না বা ভারতের হাত বেঁধে দেবে না। ট্রাম্প প্রশাসন ভারত ও মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা প্রবলভাবে ভারত-সমর্থক। উপরন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো গভীর আগ্রহ নেই। তবে প্রশ্ন হলো গাজা উপত্যকা ধ্বংসের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যে সমর্থন দিয়েছে, তা কি ভারতকে দেবে? তেমনটি হবে না। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে অকার্যকর হলেও পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায় সে রয়েছে। আর চীনের সমর্থনও পাকিস্তানের প্রতি রয়েছে। পাকিস্তান হয়তো চীনকে দিয়ে ভারতের ওপর কিছুটা চাপ তৈরি করতে পারে। তবে চীন এখানে কূটনৈতিক চাপের বেশি ব্যবহার করবে না বলেই মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান এখানে কোনো যুদ্ধ শুরু করুক; সেটাও চায় না চীন। কারণ এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে।

এদিকে পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার কিছু সময় পর এ ঘটনার দায় স্বীকার করে একটি বার্তা প্রকাশ করেছিল অঞ্চলটির একটি বিদ্রোহী সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। কিন্তু ২৫ এপ্রিল কাশ্মীরের বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া আগের দাবির জন্য উল্টো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেছে। গোষ্ঠীটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেছে, টিআরএফকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়ানোর বিষয়টি মিথ্যা এবং কাশ্মীরি প্রতিরোধ আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে সাজানো একটি প্রচারের অংশ। ‘পেহেলগামে হামলার কিছুক্ষণ পর আমাদের একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে সংক্ষিপ্ত এবং অনুমোদনহীন বার্তা পোস্ট করা হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ তদন্তের পর একাধিক প্রমাণ রয়েছে, সমন্বিত সাইবার অনুপ্রবেশের ফলে এমনটি ঘটেছে। আর এটি ভারতের ডিজিটাল যুদ্ধ কৌশলের একটি পরিচিত পদ্ধতি।’

পেহেলগাম হামলা কাশ্মীর ইস্যুকে পুনরায় একটি স্ফুটনাঙ্কে নিয়ে এসেছে, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভঙ্গুরতা এবং আঞ্চলিক শক্তি কাঠামোর জটিলতাকে উন্মোচন করে। এই সংকটের সমাধান কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংলাপের সমন্বয় ছাড়া সম্ভব নয়। অন্যথায়, কাশ্মীর শুধু ভারত-পাকিস্তানের নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য এক অস্থির অঞ্চল হিসেবেই বিবেচিত থাকবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫