দিল্লি থেকে ৪০ রোহিঙ্গাকে ধরে সাগরে ফেলার অভিযোগ জাতিসংঘের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১৩:১৫

সাগর পথে অনেক রোহিঙ্গাই মিয়ানমার থেকে পালানোর চেষ্টা করেন
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে আটক করে অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নৌবাহিনী দিয়ে সমুদ্রে নামিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। এতে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও ছিল।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসে শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায়, আটক শরণার্থীদের ভারত-মিয়ানমার সামুদ্রিক সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদের জাহাজ থেকে সমুদ্রে নামিয়ে দেয়।
শরণার্থীরা জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট পরে সাঁতরে উপকূলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, কিন্তু বর্তমানে তারা মিয়ানমারে কোথায় আছে- তা নিশ্চিত নয়।
৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী শুক্রবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা ৬ মে আটক হওয়া ওই গ্রুপে ছিলেন।
ওই শরণার্থীদের ৮ মে একটি বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের সমুদ্রে ফেলে দেয়। গ্রুপটিতে ১৫ জন খ্রিস্টান রোহিঙ্গাও ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের আইনজীবী দিলাওয়ার হুসেইন জানান, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে একটি আবেদন দায়ের করেছে, যাতে ভারত সরকারকে তাদের ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভারতের নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘ একে ‘নির্দয় ও অগ্রহণযোগ্য কাজ’ বলে অভিহিত করেছে এবং ভারত সরকারকে শরণার্থীদের ‘অমানবিক ও জীবন-সংহারক আচরণ এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন’ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ এ ঘটনাকে, ‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার প্রতি চরম অবজ্ঞা’ বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “এটি একেবারেই লজ্জাজনক ও চরম মাত্রার নৃশংসতা। এ রকম নিষ্ঠুর কাজ মানবতার প্রতি চরম অবমাননা এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। বিশেষ করে ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতির, যা বলে— কোনো ব্যক্তিকে এমন কোনো জায়গায় ফেরত পাঠানো যাবে না, যেখানে তার জীবন বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।”
ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। সেখানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন।
ভারতের কোনো জাতীয় শরণার্থী আইন নেই এবং দেশটি ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন কিংবা ১৯৬৭ প্রটোকলের সদস্য নয়।
তবে ২০১৭ সালের পর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে লাখো রোহিঙ্গা প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যায়।
রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনালের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ভারতে বসবাসরত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার ৫০০ জন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরে নিবন্ধিত। এদের অনেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অস্বাস্থ্যকর ও বস্তির মতো শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করে।
নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শরণার্থী এপিকে জানান, তার ভাই ৮ মে মিয়ানমারে একটি দ্বীপে সাঁতরে পৌঁছানোর পর এক জেলের কাছ থেকে মোবাইল ধার নিয়ে তাকে ফোন করেছিলেন। তার ভাষ্য, “আমার বাবা-মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমি কেবল তাদের ফিরে পেতে চাই, আমার আর কিছু দরকার নেই।”
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের চোখ ও হাত বাঁধা খুলে দেয়, জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট দেয় এবং বলে সাঁতরে মিয়ানমারের একটি দ্বীপে যেতে।
এপি বলছে, ফেরত পাঠানো অনেক রোহিঙ্গা ইউএনএইচসিআরে নিবন্ধিত ছিলেন এবং তাদের অনেককে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের অযুহাতে আটক করেছিল।
এপিকে তিনি তার ভাইয়ের কিছু ছবি সরবরাহ করেন, যেখানে দেখা যায় তাকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে।
এপি আরও একটি ফোন কলের অডিও রেকর্ড পর্যালোচনা করেছে, যেখানে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী দিল্লিতে থাকা তার ভাইকে বলেন, গ্রুপের কয়েকজনকে ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা মারধোর করেছে।
এই সব দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে বসবাসরত রোহিঙ্গারা দেশটির হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর হামলা ও বিদ্বেষের শিকার হয়েছে। অনেককে আটক কেন্দ্রে রাখা হয়েছে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে।