ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীর গোপন চিঠি ফাঁস

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২০, ০১:২১

চলতি বছর জুলাই মাসেই হায়দরাবাদের কোম্পানি ভারত বায়োটেকের তৈরি ‘কোভ্যাকসিন’ টিকার মানব দেহে ট্রায়াল শুরু হবে। চলবে দুই দফায় এই পরীক্ষা। ইতিমধ্যে এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ডিসিজিআইয়ের ছাড়পত্রও মিলেছে। আগামী আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই ভারত করোনাভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন আনার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এই ঘোষণাকে অবাস্তব বলছেন ভারতের একদল বিজ্ঞানী। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের এই মতামত তুলে ধরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের শীর্ষ চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) এ বছরের অগাস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের টিকা বাজারে ছাড়ার বিষয়ে বিবেচনা করছে, এরকম একটি খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
করোনাভাইরাসের টিকার ট্রায়ালের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে আইসিএমআর'এর মহাসচিব বলরাম ভার্গবের লেখা একটি চিঠি ফাঁস হওয়ার পর এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয় বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্সের খবর অনুযায়ী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের সাথে যুক্ত হয়ে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চেষ্টা করছে হায়দ্রাবাদ ভিত্তিক বায়ো-থেরাপিউটিকস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'ভারত বায়োটেক', যারা এ সপ্তাহে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে।
দোসরা জুলাই টিকার ট্রায়ালের সাথে জড়িত ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে বলরাম ভার্গব উল্লেখ করেন; সব ধরণের ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার পর জনস্বাস্থ্যে ব্যবহারের জন্য সর্বশেষ ১৫ অগাস্ট, ২০২০ এর মধ্যে এই টিকা প্রস্তুত করার বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
কোনো একটি টিকার ট্রায়ালের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ সাধারণত টিকার নিরাপত্তার মাত্রা পরীক্ষা করে। আর তৃতীয় ধাপে পরীক্ষা করা হয় টিকার কার্যকারিতা। এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হতে কয়েক মাস, এমনকি অনেক সময় কয়েক বছরও লেগে যায়।
যদিও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় করোনাভাইরাসের ওষুধ ও টিকা দ্রুত তৈরির লক্ষ্যে ফাস্ট-ট্র্যাকিং ট্রায়ালের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেই হিসেবে বিবেচনা করলেও আইসিএমআর প্রধানের লেখা চিঠিতে যতটুকু সময়ের মধ্যে টিকা তৈরির আশা প্রকাশ করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি ভাইরাসের টিকা তৈরি করার প্রচেষ্টা শুধু অভূতপূর্বই নয়, ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
মহারাষ্ট্র রাজ্যের করোনা টাস্ক ফোর্সের সদস্য ড. শশাঙ্ক জোশি বলেন, এত অল্প সময়ে একটি টিকা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। টিকা তৈরি করতে সাধারণত দুই বছর সময় লাগে। আপনি যদি ফাস্ট ট্র্যাক পদ্ধতিতেও তৈরি করতে চান, তবুও ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে। এর আগে টিকা তৈরি করা অসম্ভব।
তিনি বলেন, টিকা তৈরির সময় মানুষের নিরাপত্তা ও টিকার সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করতে হয়। যদি আইসিএমআর প্রয়োজনীয় সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে ও নিয়ম মেনে এই প্রক্রিয়া চালায়, তাহলে তাদের সাধুবাদ জানানো উচিত।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব বায়োএথিক্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. অনন্ত ভানও আইসিএমআরের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, টুইটার পোস্টে ড. ভান লেখেন, আমার জানা মতে, কখনো কোনো ধরণের ভ্যাক্সিন তৈরির প্রক্রিয়া এত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার চেষ্টা হয়নি। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুততর প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও এই সময়কাল অতি দ্রুত। কাজেই এর তৈরি প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ কম দেয়া হবে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রাও বেশি থাকবে।
আইসিএমআর মহাসচিবের চিঠিটি ফাঁস হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ঐ চিঠি সম্পর্কে জানতে আইসিএমআরের মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করলেও কোনো উত্তর পাননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিএমআরের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন যে, ওই চিঠিটি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল এবং সেটির ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চিঠিতে অগাস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে টিকার সব ধরণের ট্রায়াল সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছিল, ঐ সময়ের মধ্যে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করার কথা বলা হয়নি। টিকা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেকের মুখপাত্রও চিঠিটি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে ভারত বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষ্ণ এলা রয়টার্সকে জানিয়েছেন ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফল হলে বছরে ৩০ কোটি টিকা উৎপাদনের লক্ষ্য আছে তাদের।
এই বিষয়ে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীদের দাবি, যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে অন্তত কয়েক মাস এবং কয়েক বছর লেগে যায়। সেক্ষেত্রে এত তাড়াতাড়ি কোনোরকম উচ্চপর্যায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই করোনা প্রতিষেধক ব্যবহার জনগণের উপর হিতে বিপরীত প্রভাব ফেলতেও পারে।
এই বিষয়ে ডিবিটি ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্টট শাহিদ জামিল একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কাছে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সুরক্ষা, প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য চার সপ্তাহের মধ্যে একটি ভ্যাকসিনের দ্রুত পরীক্ষা করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, ইমিউনোজিনিটি হলো অ্যান্টিজেনের মতো একটি বিশেষ পদার্থ। যা কোনো মানুষ বা অন্য প্রাণীদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এই বিষয়ে আরো এক প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট উপসনা রায় ভারতের গণমাধ্যমে বলেন, করোনাভাইরাসের মতো মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি ভ্যাকসিন চালু হওয়া খুবই জরুরি। এই বিষয়ে প্রতিষেধক আবিস্কারক সংস্থা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে আমরা খুব দ্রুত এগোচ্ছি কিনা সেটি জানা এবং বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
কলকাতার সিএসআইআর-আইআইসিবি-র উচ্চপদস্থ এক বিজ্ঞানী এদিন সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেন, আমাদের সকলকে অবশ্যই সাবধানে এগোতে হবে। আর এই প্রকল্পের অগ্রাধিকার দেয়াটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চাপ জনসাধারণের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে।
এদিকে করোনার ভ্যাকসিন ব্যবহারের প্রসঙ্গে আইসিএমআর জানিয়েছে, হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেক এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি (এনআইভি) এর সহযোগিতায় তৈরি কোভ্যাকসিনের জন্য ১২ টি ক্লিনিকাল ট্রায়াল সাইট চিহ্নিত করা হয়েছে। ৭ জুলাইয়ের পর থেকে এগুলির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হবে।