Logo
×

Follow Us

দক্ষিণ এশিয়া

করোনাকালেও সামরিক ব্যয়ে বিপর্যস্ত পাকিস্তান

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২০, ১৫:৪৪

করোনাকালেও সামরিক ব্যয়ে বিপর্যস্ত পাকিস্তান

পাকিস্তানের কভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রতিদিন আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। সরকারি হিসাবেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। প্রতিদিন শতাধিক মানুষ এ রোগে মারা যাচ্ছেন। দেশটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। 

কভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই পাকিস্তানের স্বাস্থ্য খাত, তথা অর্থনীতির অবস্থা সঙ্গীন ছিল। করোনাকালে এর সাথে কৃষি, শ্রম, শিক্ষাসহ সেবা খাতের প্রকৃত বিপর্যস্ত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। অথচ এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায়ও সামরিক খাতে বরাদ্দ না কমিয়ে উল্টো বাড়ানো হয়েছে। 

নতুন অর্থবছরের প্রতিরক্ষা বাজেট দেখেই বোঝা সম্ভব- পাকিস্তান কোন পথে চলছে!

পাকিস্তানের অর্থনীতি পুরোপুরি ধসে পড়লেও দেশটির সরকার তাদের জনস্বাস্থ্য ও সেবা খাতকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কল্যাণমূলক বাজেটের দিকে না গিয়ে কথিত উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষাকে কেন্দ্র করে গতানুগতিক বাজেট পাস করেছে। দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) নেই, নেই ভেন্টিলেটর। স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়ায় অন্য রোগের চিকিৎসাও পাচ্ছেন না রোগীরা। এমনকি গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থাও নেই। এ কারণে মৃত্যুহার ক্রমেই বাড়ছে।

(‘পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান থাকায় এবং জাতীয় রাজনীতির ওপর সামরিক প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জেঁকে বসায় কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই সেনাবাহিনীর ইচ্ছেমতো খরচের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করেই সেনা কর্মকর্তারা খরচের সিদ্ধান্ত নেন।’)

এমন নয় যে, করোনাভাইরাস হানা দেয়ার আগে পাকিস্তানের অর্থনীতি খুব ভালো ছিল। সরকারি তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে নেমে এসেছিল, যা মহামারির প্রাদুর্ভাবে শূন্যের নিচে নেমে যায়। আগে থেকেই পাকিস্তানের ২৫ শতাংশেরও বেশি জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। এখন তা ৫০ শতাংশেরও বেশি বলে দেশটির অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর পক্ষে স্বাস্থ্যসেবা কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যে কারণে দরকার এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ ও তার যথাযথ প্রয়োগ। 

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.৪ শতাংশ ধরা হয়েছে। তবে সেটুকুও অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে নতুন অর্থবছরের বাজেটে জনগণের ওপর কোনো বাড়তি করারোপ করা হয়নি। এতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা গেলেও সরকারের আয়ের প্রধান উৎস ছোট করে ফেলা হয়েছে। আবার বিকল্প উৎসও খুব বেশি নেই। 

দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন জানায়, এবার বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ১৩৬ কোটি রুপি। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৩ লাখ ৫৬৮ কোটি টাকা। এর ৪১ শতাংশই ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। ধসে পড়া অর্থনীতির মাঝেও প্রতিরক্ষা বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বাজেটের ১৮ শতাংশ বা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি রুপি। তবে প্রকাশ্য ব্যয়ের বাইরেও সামরিক খাতে অপ্রকাশ্য বাজেট থাকে বিপুল পরিমাণ, যা অত্যন্ত গোপনীয়। সে খবর কখনোই প্রকাশ করা হয় না। উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ১৮ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে তুলনায় এবার কমই বেড়েছে, মাত্র ১২ শতাংশ! 

সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রীয় সম্পদ অধিগ্রহণ, সেনাবাহিনীর পাবলিক সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিএসডিপি), পরমাণু কর্মসূচি ও আধা সামরিক বাহিনীর পেছনে ব্যয়, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের পেনশন দেয়া, নতুন চালু করা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশন ও অন্য অনেক সেনা খাতের ব্যয় এই বাজেটের মধ্যে পড়ে না। এসব ব্যয় ধরা হলে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেটে পরিমাণ দুই লাখ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে।

সামরিক খাতের পরেই রয়েছে উন্নয়ন খাত। এ খাতে ৬৫ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে স্বাস্থ্য বাজেটের কোনো তুলনাই চলে না। যেখানে প্রায় চার কোটি পাকিস্তানি অপুষ্টি ও খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন; সেখানে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৫৫০ কোটি রুপি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ ও বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংস্থাটির তথ্যমতে, বর্তমানে এ খাতে মাথাপিছু ব্যয় মালদ্বীপে দুই হাজার ডলার, শ্রীলংকায় ৩৬৯ ডলার, ভারতে ২৬৭ ডলার, পাকিস্তানে মাত্র ১২৯ ডলার। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আট হাজার ৩৩০ কোটি রুপি। 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ত্রাণ বাবদ ৪২ কোটি ৪০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে। মহামারি মোকাবেলায় আরো বহু অর্থ খরচ করতে হবে। সে অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে- তার কোনো জবাব ইসলামাবাদের কাছে না থাকলেও, বর্ধিত সামরিক ব্যয়ের অর্থ জোগান দিতে তারা বাধ্য। পিপিই না থাকলেও চলবে, নতুন ড্রোন আর যুদ্ধবিমানের বহর বাড়ানোটা তাদের কাছে বেশি জরুরি!

বিপুল সম্পদের মালিক হলেও, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কার্যত দেশটির অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংস্থাটি কার্যত রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র রচনা করেছে। যা হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের মূল পরিচালক। বর্তমান সরকারের পক্ষে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। 

তবে ধসে পড়া অর্থনীতি খুব বেশিদিন এ অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। তাই এটি ভেঙে পড়তে পারে যে কোনো সময়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতিকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে দরকার মৌলিক জনবান্ধব অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পুনর্গঠন। এর মধ্যে রয়েছে- কর ব্যবস্থাপনা সহজ করা, সেবা খাতে ভর্তুকি বাড়ানো, প্রতিরক্ষা খাতে যৌক্তিকভাবে বরাদ্দ কমিয়ে আনা, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করা এবং সামরিক বাহিনীকে বাণিজ্যিক গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া থেকে ফিরিয়ে আনা।

এ প্রসঙ্গে দেশটির প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সোয়াসের গবেষক আয়েশা সিদ্দিকী বলেন, “পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান থাকায় এবং জাতীয় রাজনীতির ওপর সামরিক প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জেঁকে বসায় কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই সেনাবাহিনীর ইচ্ছেমতো খরচের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। বেসামরিক সরকারের সাথে কোনোরকম আলোচনা না করেই সেনা কর্মকর্তারা খরচের সিদ্ধান্ত নেন। চীনের কাছ থেকে ট্যাংক না কিনে পাকিস্তানের নিজের তৈরি ট্যাংক ‘আল-খালেদ’ ব্যবহার করা উচিত- এই কথা বেসামরিক রাজনীতিকরা সেনাবাহিনীকে বলার সাহস পান না। প্রতি বছর সেনাবাহিনীকে ২০০ কোটি ডলারের বেশি পেনশন দেয়া হলেও সরকার সামরিক বাহিনীকে এ প্রশ্ন করতে সাহস রাখে না যে, বেসরকারি ব্যবসা খাত থেকে প্রতি বছর সেনাবাহিনী যে দুই হাজার কোটি ডলার আয় করে থাকে, তা দিয়ে কী করা হয়? কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে দ্বৈরথ থাকলেও দেশটির সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ লাগার আশঙ্কা প্রায় নেই। এছাড়া বর্তমানে ভারতকে চীনের সাথে মোকাবেলা করে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ দেখা যাচ্ছে না।”

তিনি আরো বলেন, “সেনাবাহিনীর হাতে একটিই অজুহাত আছে, সেটি হলো ‘জাতীয় নিরাপত্তা’। এর দোহাই দিয়ে তারা দিনের পর দিন পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সামাজিক জীবনও কুক্ষিগত করে ফেলছে। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান দেশটির অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তদাতা পর্ষদের প্রধান কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বিস্তার করে আছেন সামরিক কর্মকর্তারা। সরকারের বেসামরিক নেতারা এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাকিস্তানে বেসামরিক রাজনীতির ছিটেফোঁটাও একসময় থাকবে না।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫