Logo
×

Follow Us

দক্ষিণ এশিয়া

মিয়ানমার: গৃহযুদ্ধে ঐক্যের সম্ভাবনা

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২, ১৫:৪৩

মিয়ানমার: গৃহযুদ্ধে ঐক্যের সম্ভাবনা

পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) গেরিলা বাহিনীর একাংশ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। জয় পায় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ তুলে অভ্যুত্থান করে সামরিক বাহিনী। আটক করা হয় রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের। সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হন।

অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। সার্বিক পরিস্থিতিও সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল। কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে সময় লাগেনি মিয়ানমারবাসীর। দেশটির জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আর আগের মতো সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায়নি। ফলে অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ক্ষমতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তাতমাদাও (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে মিয়ানমারের জনগণের। রাজপথ থেকে সংগ্রাম ছড়িয়েছে গহিন জঙ্গলে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এখন রূপ নিয়েছে সহিংস গেরিলা যুদ্ধে। বহুধা বিভক্ত দেশটি নিয়ে কার্যত সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমারের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। কারণ এখন সব পক্ষের সাধারণ শত্রু সামরিক বাহিনী।

মিয়ানমারের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনী বা সরকারের সংঘাতের ইতিহাস বহু পুরনো। তবে এখন সে ইতিহাসে নতুন বাঁক রচিত হচ্ছে। বিভিন্ন জাতিসত্তার সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করেছে গণতন্ত্রপন্থি সেনাশাসনবিরোধী গ্রুপগুলো। সীমান্ত বা দূরবর্তী অঞ্চলগুলো একসময় সংঘাতপ্রবণ হলেও এখন সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলেও।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, অভ্যুত্থানের পর থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ২৩ হাজার ৫২১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই হাজার ৩৯ জন বেসামরিক জনগণ। সময়ে প্রায় ১২ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ৩১ মে পর্যন্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। প্রায় ১২ হাজার বেসামরিক সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে গৃহযুদ্ধে।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সমূলে বিনাশের চেষ্টা করেছে। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে অহিংস বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেনাবাহিনী। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয়, এই মৃত্যুটিই প্রথম নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে বিক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। তখন বিভিন্ন মতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র প্রতিরোধও শুরু করে।

বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ মনে করছে, এখন সশস্ত্র সংগ্রামও দরকার। তাই কারেন প্রদেশের জঙ্গলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা। মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলের কারেন প্রদেশের থাইল্যান্ড সীমান্ত সংলগ্ন জঙ্গলের প্রশিক্ষণ শিবিরে রয়েছে বহু বেসামরিক নাগরিক। ঘরে তৈরি বোমা ছুড়ে মারা এবং রাইফেলে গুলি ভরার প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে তাদের। প্রশিক্ষণরতদের মধ্যে এমন তরুণও আছেন যারা মিয়ানমারে ভালো বেতনের চাকরি করতেন।

অনেক কষ্টার্জিত সংসদীয় ব্যবস্থার শাসনের অবসান ঘটানোর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন তারা। মিয়ানমারের তিন লাখ সদস্যের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা কিছু মানুষ।

বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ রয়েছেন সেখানে। তাই তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের নাম দিয়েছেন পিপল ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র জাতিগত সংগঠন কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) গত বছরের অক্টোবর নাগাদ দেশটির মধ্যাঞ্চলের অনেক শহরেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে পিডিএফ।

মিয়ানমারের আরাকান, কাচিন, কারেন, শান ওয়া বাহিনীর মতো ১১টি জাতিগত গোষ্ঠী, যারা বহুদিন ধরে মিয়ানমারের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার দাবিতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তারা নিজেদের আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করে। সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের শীর্ষ সাতটি সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্যরা ওয়া রাজ্যের পাংসাংয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর বৈঠক করেছে।

আরাকান আর্মির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রয়োজনের কারণেই তারা বৈঠক করেছেন, যার মূল লক্ষ্য আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করা। স্থানীয় বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, নাগরিক সমাজ, ক্ষমতাচ্যুত জনপ্রতিনিধি আর জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদের একটি সরকার গঠন করে, যার নাম দেওয়া হয় ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট (এনইউজি) তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখা করেছেন আসিয়ান মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মতপার্থক্য নিরসন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এনএলডি, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি আর সরকারবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী জাতিগত গোষ্ঠীগুলো মিলে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটা জোট গঠন করে, যার নাম দেওয়া হয় ন্যাশনাল ইউনিটি কনসালটেটিভ কাউন্সিল (এনইউসিসি)

বিবিসির বার্মিজ সার্ভিস জানিয়েছে, এখন উত্তর রাখাইন, চিন, শান কাচিন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে তাতমাদাও। তারা ভারী অস্ত্র ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে, অনেক শহরে যুদ্ধ ছড়ালেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। গ্রামে গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। গৃহযুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়া থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চারটি সুখোই যুদ্ধবিমান পাচ্ছে বলে এক মুখপাত্র জানিয়েছেন।

ভারী অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সেনা সরকারের রণকৌশলে বড় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আগে যেখানে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপর ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হতো, এখন সেখানে এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মান জাতিগোষ্ঠীর উপর। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতেও এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যাই বেশি। এবারই প্রথম দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিসত্তার এত বড় একটি অংশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর সশস্ত্র বিদ্রোহে যুক্ত হলো।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মান জনগোষ্ঠী, যারা এর আগে অস্ত্র হাতে নেয়নি, তারা এখন সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দল ছাড়াও সুশীল সমাজের লোকজনও রয়েছেন।

এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে একই সঙ্গে বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশগুলোয় জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ করতে হচ্ছে, তেমনি দেশটির মধ্যাঞ্চলে বিভিন্ন প্রদেশে পিডিএফ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এই বহুমুখী সশস্ত্র আন্দোলন ঠেকাতে যেভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে, এর ফলে তারা কোনো জায়গাই ঠিকমতো সামলাতে পারছে না। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পক্ষত্যাগ করা। তাতমাদাও বাহিনীর ভেতরের অবস্থাও ভালো নয়।

প্রচুর সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মাঝারি থেকে সৈনিক পর্যায়ের অনেকের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা গেছে। তারা পিডিএফ বা অন্য কোনো জাতিগত বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, কেউ পালিয়ে যাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসি বলেন, ‘দেড় বছরের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপরও প্রভাব পড়েছে। সেনাবাহিনী এখন মনোবল নিয়োগ সংকটের মধ্যে আছে।তবে এসব চ্যালেঞ্জের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়বে বলে মনে করেন না হোরসি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংকটের কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হচ্ছে, স্কুল হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে পড়ছে, অনেকে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর উপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিলেও পাশে আছে চীন-রাশিয়া।

যার ফলে তা তেমন কার্যকর করা সম্ভব না। আবার চীন-রাশিয়াকে মোকাবিলায় মিয়ানমারকে পুরো খারিজ করেও দেবে না মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বলয়। আর এমন বাস্তবতায় মিয়ানমার সংকটের শিগগিরই কোনো সমাধানের পথ কারও জানা নেই।

তবে জনগণ বাঁচার জন্য সম্ভবত প্রথমবারের মতো এতটা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আর তাই ভবিষ্যতে জাতিগত ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমারের স্বপ্নও দেখছেন অনেকে।

 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫