নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মত যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের শীর্ষ নেতারা। তার এই বিষয়টিকে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশী প্রথম’- সেসময় এমন বৈদেশিক নীতিকেই তুলে এনেছিল।
বলা বাহুল্য, ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নয়াদিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সমন্বয় গড়ে তোলা। তবে সীমান্ত বিরোধ এবং দ্বিপাক্ষিক মতানৈক্য, ভারতের পক্ষ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বিলম্বিত সম্পাদন এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মোদির সেই বৈদেশিক নীতিটি খুব শিগগিরই ব্যর্থ হয়ে যায়।
তবে, এই নীতির অধীনে বাংলাদেশের সাথে ভারত ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয় বলে আপাতদৃষ্টে তা প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা — যিনি এই মাসে চাপের মুখে পদত্যাগ করার আগে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন — মোদির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন; তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উভয় দেশের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও পরবর্তীতে হাসিনা একজন কর্তৃত্ববাদী শাসকে রূপান্তরিত হন। তার বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে; আর সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছিল সেই ক্ষোভের চূড়ান্ত ট্রিগার। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে হাসিনা গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে হাসিনার দারুণ অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার এই পদত্যাগ ভারতীয় রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংস্থার জন্য বড় একটি ধাক্কা হিসাবে সামনে এসেছে। ভারত তার শাসনামলে হাসিনাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে গেছে, আর সেটিও আবার অন্যান্য স্টেকহোল্ডার এবং বাংলাদেশের জনগণের উদ্বেগ উপেক্ষা করে। নরেন্দ্র মোদির অধীনে নয়াদিল্লি তার বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশের সাথে এই নীতি ও পদ্ধতিই গ্রহণ করেছে। আর এর ফলে কখনও কখনও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে ভারতকে।
এটা স্পষ্ট যে, নিজের প্রতিবেশী দেশে ভারতের এই নীতিগত ব্যর্থতা শুধুমাত্র বহিরাগত ঘটনার কারণে নয়। এগুলো ভারতের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও বহিঃপ্রকাশ। কূটনীতির নিরাপত্তাকরণ থেকে শুরু করে মোদির শক্তিশালী ভাবমূর্তি, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে নিজের উদারপন্থি পরিচয়কেও ক্ষুণ্ন করেছে নয়াদিল্লি। মোদির পছন্দসই কর্পোরেট স্বার্থের জন্য হাসিনার মতো সরকারগুলোর সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক আচরণ নয়াদিল্লির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আনুগত্য ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ, বিশেষ করে বাংলাদেশে ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৯ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) মুসলমানদের বাদ দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল এবং এটি বাংলাদেশি জনসাধারণের কাছ থেকেও সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকারের অশোভন আচরণও বিদেশে মোদির সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালে মোদির বাংলাদেশ সফর দেশটিতে সহিংস দাঙ্গার সূচনা করেছিল।
হাসিনার পদত্যাগ ভারত সরকারের জন্য আত্মদর্শনের সুযোগ হয়ে সামনে এসেছে, কিন্তু এরপরও দেশটি তাদের নীতি সংশোধনে যুক্ত হতে পারেনি বলে মনে হয়। বাংলাদেশে ভারতের কলঙ্কিত ভাবমূর্তি দক্ষিণ এশিয়ায় মোদি সরকারের প্রথম বড় ব্যর্থতা নয় এবং এটি শেষ ব্যর্থতাও হবে না। প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও সেই পথ অনুসরণ শুধুমাত্র ভারতের জন্যই ক্ষতিকর নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও নয়াদিল্লির ফলাফল হবে বিপর্যয়কর।
[ফরেন পলিসিতে মোদির রাজনীতি নিয়ে এই নিবন্ধটি লিখেছেন সুশান্ত সিং। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির লেকচারার এবং ভারতের ক্যারাভান ম্যাগাজিনের কনসাল্টিং এডিটর। তিনি আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ডেপুটি এডিটর ছিলেন এবং দুই দশক ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। তার নিবন্ধের আংশিক এখানে তুলে ধরা হল।]
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh