সুজিত সজীব
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
সুজিত সজীব
আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
নীরা আর্য, একজন বাঙালি নারী। একজন সৈনিক। দেশের জন্য যিনি তার ব্রিটিশ স্বামীকে হত্যা করতেও পিছপা হননি। তিনি ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে গড়েছিলেন অনন্য কীর্তি। এক অনন্য সংগ্রামের সেই কাহিনি রূপকথার মতো। সেই বীর সেনানীর প্রতি ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া তিন দেশের (পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ) কেউই তাকে মনে রাখেনি।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনে সর্বত্র গান্ধী, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জিন্নাহ, হিন্দুত্ববাদিতা, মুসলিমবাদিতা ছাড়া আর বাকি সবকিছুই প্রচার হয় কম, থেকে যায় অন্ধকারে। নেতাজি সুভাষ বসু ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজনীতি, সংগ্রাম আর আর তার আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন সবই যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে মরিয়া শাসকরা।
১৯০২ সালের ৫ মার্চ, নীরা আর্য ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেঠ ছজুমাল ছিলেন সেই সময়ের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। নীরা ছাত্রজীবন থেকেই একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে ওঠেন। পিতার ব্যবসার খাতিরে হায়দরাবাদে থাকার সময় শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নীরার স্বামী ছিলেন ইংরেজ শাসকের একজন অনুগত গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাকে ইংরেজ সরকার গোপনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে হত্যা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। সম্ভবত সেই দায়িত্ব নিয়েই সস্ত্রীক রেঙ্গুনে যান জয়রঞ্জন দাস।
১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত করেন অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার। সেই আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর কন্যা ছিলেন নীরা আর্য। নীরা আর্য যখন আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন, ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের একজন সৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, তার ভাই বসন্ত কুমারও এই ফৌজের সৈনিক ছিলেন। তবে তখনও নীরা জানতেন না তার স্বামীর গোপন অভিলাষের কথা।
শ্রীকান্ত একবার সুযোগ পেয়ে নেতাজির গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায়, কিন্তু সেই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে জখম করে নেতাজির ড্রাইভারকে। এই ঘটনা জানার পর লজ্জায়, ঘৃণায় ভেঙে পড়েন নীরা। তবে কিছুক্ষণ পরেই তিনি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।
নেতাজিকে বাঁচানোর জন্য স্বামী শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে নিজ হাতে হত্যা করে রক্তমাখা শরীরে গিয়ে দাঁড়ান নেতাজির সামনে। নেতাজি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন এই বাঙালি বীর কন্যার দিকে।
কথিত আছে, এই ঘটনার পর থেকে নেতাজি নীরাকে ‘নাগিন’ বলে ডাকতেন। নেতাজির অন্তর্ধানের (এটা নিয়ে নানা মতবিরোধ রয়েছে) পরে আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করে। ১৯৪৬ সালে যখন দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার শুরু হয়; তখন সব সেনাবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে তার স্বামী হত্যার অভিযোগে আটক রাখা হয়। তার আলাদা বিচার হয় এবং যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়। তিনি আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন। সেখানে সেলের ভিতরে নীরাকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতা মীরার জীবনে নতুন কোনো মাত্রা যোগ করেনি। স্বাধীন ভারত তাকে ছুড়ে ফেলে আস্তাকুঁড়ে। নীরা আর্য স্বাধীনতার পর ফুল বিক্রি করে জীবনযাপন করেছিলেন, তবে কোনো সরকারি সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি।
বিশিষ্ট উর্দু লেখিকা ফারহানা তাজকে নীরা তার জীবনের কিছু ঘটনা শুনিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে ফারহানা নীরার জীবন নিয়ে একটি উপন্যাসও লিখেছেন, যা স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা ও অবদানকে তুলে ধরে। তার সেই জীবনী পড়ে জানা যায়, গ্রেপ্তারের পর নীরাকে প্রথম কলকাতার এক কারাগারে রাখা হয়েছিল। তারপর আন্দামান জেলে পাঠানো হয়। আর সেখানে তার সঙ্গে ঘটে নৃশংস সব অত্যাচারের ঘটনা।
একদিন নীরার সেলে ইংরেজ জেলসুপার এসে উচ্চকণ্ঠে বললেন, তোমাকে একেবারে ছেড়েই দেওয়া হবে, যদি তুমি বলে দাও তোমাদের পাণ্ডা সুভাষ বসু কোথায় আছে। নীরা গম্ভীর স্বরে বললেন, তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। জেলার বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছ, তিনি এখনও বেঁচে আছেন। নীরা ঈষৎ হেসে বললেন, আছেন, তিনি বেঁচে আছেন। জেলারের চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো, তিনি বললেন, তিনি এখন কোথায়? নীরা আর্য তখন তার বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, নেতাজি আমার হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
এই কথা শুনে জেলার গর্জে উঠল, তাহলে আমরা নেতাজিকে তোমার হৃদয় থেকেই সরিয়ে দেব। তিনি ইশারা করলেন। তারপর কারারক্ষীরা নীরার বুক থেকে শাড়ি আর জামা খুলে ফেলে। সাঁড়াশির মতো একটা যন্ত্র দিয়ে কয়েকজন কারারক্ষী নীরার ডান পাশের স্তনটিকে উন্মুক্ত করে কাটার চেষ্টা করে। যন্ত্রটির ধার কম থাকায় মাংসের স্তর খুব একটা কাটতে পারেনি।
তারপর জেলার নীরার গলা চেপে ধরে বলে, যদি আবারও জেলের স্টাফদের মুখের ওপর কথা বলো, তাহলে তোমার দুই বুকের উপরিভাগ আলাদা করে দেব। বেঁচে গেলে আজ।
এরপর নীরা ফুল বিক্রি করে বেঁচে ছিলেন স্বাধীন ভারতের বুকে, হায়দরাবাদের ফালকনামায় একটি কুঁড়েঘরে থাকতেন। সরকারি জমিতে থাকার কারণে শেষ জীবনে একদিন তার কুঁড়েঘরটিও ভেঙে ফেলা হয়। বৃদ্ধকালে অসুস্থ অবস্থায় চারমিনারের পাশে রাস্তার ফুটপাতে দিন কাটিয়েছেন। চারপাশের কেউ সম্ভবত জানতও না, ইনি সেই বীরকন্যা নীরা আর্য, সুভাষচন্দ্র বসুর অন্যতম সাহসী সহযোদ্ধা। অবশেষে ২৬ জুলাই ১৯৯৮ সালে এই গরিব অসহায় রুগ্নশীর্ণ বৃদ্ধা লড়াকু বাঙালি নারীর জীবনাবসান হয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh