Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড়

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৪

মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড়

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। জয় পায় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ তুলে অভ্যুত্থান করে সামরিক বাহিনী। আটক করা হয় রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের। অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এ কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে সময় লাগেনি মিয়ানমারবাসীর।

দেশটির জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আর আগের মতো সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায়নি। ফলে অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ক্ষমতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তাতমাদাও (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম)। জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন সশস্ত্র গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় ২০২২ সালের শুরুর দিকে। তখন জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে বহুধাবিভক্ত মিয়ানমারের জনগণ সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এই গৃহযুদ্ধে সম্প্রতি নতুন মোড় এসেছে, যখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ শহর মংডু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতি জানায়, মংডুর দখল করা সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে কুখ্যাত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন তুনসহ জান্তা বাহিনীর কয়েক শ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আরাকান আর্মি। সশস্ত্র সংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, সেনা সদস্যরা আত্মসমর্পণের পর ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো থেকে সাদা পতাকা হাতে বেরিয়ে আসছেন। তবে আরাকান আর্মি ক্ষমতা নিলেও রোহিঙ্গাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তাদের বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকলেও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই গৃহযুদ্ধে যুক্ত। মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলের তানিনথারিতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়া এই ইউনিটের নাম ‘মুসলিম কোম্পানি’। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন জাতীয় জোট (কেএনইউ) মূলত খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেখানে মুসলিম কোম্পানি যোগ দেওয়ায় বিদ্রোহ আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মিয়ানমারবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যাশলি সাউথ আল-জাজিরাকে বলেন, ‘মিয়ানমারের মুসলমানরা খুবই নিপীড়িত। (জান্তা সরকার দ্বারা) তারাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়। তবে কারেন অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাধারণত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনকে শান্তিতে বসবাস করতে দেখা যাচ্ছে। যে কারণে মুসলিম শরণার্থীদের একটি বড় অংশ কারেন-অধ্যুষিত অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে।’

মুসলিম কোম্পানির নেতা মোহাম্মদ আইশার জানান, কিছু অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র তৈরি করতে চাইছে। তবে তানিনথারিতে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আধিপত্য নেই। যতদিন সামরিক জান্তা ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন এ দেশের মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিপীড়িত হতে থাকবে।

প্রসঙ্গত, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে গঠিত। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে আছে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি। এমএনডিএএ মূলত মিয়ানমারের চীন সীমান্ত লাগোয়া শান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী কোকাং জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। কোকাং জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে এবং নিজেদের তারা হান-চীনা হিসেবে উল্লেখ করে। এমএনডিএএ ১৯৮৯ সালে গঠিত হয়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী এবং চীন সমর্থিত গেরিলা বাহিনী বার্মা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয়েছিল এমএনডিএএ। তাং বা পালাউং নামে পরিচিত জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশের বাহিনী। তারা তাং অঞ্চলের জন্য আরো অধিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ২০০৯ সাল থেকে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের তৃতীয় বাহিনী আরাকান আর্মি (এএ) বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশের আরাকান জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে তৈরি। অন্য দুটি বাহিনীর মতোই আরাকান আর্মিও তাদের নিজেদের অঞ্চলের আরো বেশি স্বায়ত্তশাসনের জন্য ২০০৯ সাল থেকে লড়াই করছে। 

ফ্রাঙ্কফুর্টের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইয়েলং শিয়ান বলেন, ‘এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর গঠনতন্ত্র নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতোই। তারা বিদ্রোহী বাহিনী বা মিলিশিয়া থেকে বেশি সংগঠিত।’

এদিকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় দখলের পথে বিদ্রোহী যোদ্ধারা। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) গবেষক মরগান মাইকেলস বলেন, ‘এটি সামরিক সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুতর হুমকি। মান্দালয় দেশের মাঝামাঝি এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। সরকারকে পরাজিত করার জন্য ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে। তারা শান প্রদেশ থেকে মান্দালয় পর্যন্ত এগিয়েছে। সম্ভবত সেখান থেকে রাজধানী নেপিদোর দিকে এগোবে তারা।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫