বাজেটে অর্থনীতির ক্লান্তি ঢাকতে চান সীতারমণ

নির্মলা সীতারমণ অষ্টমবারের মতো ভারতের বাজেট পেশ করেছেন। বরাবরের মতো এবারও গোষ্ঠীতান্ত্রিক সুবিধা বহাল রেখে নতুন কিছু প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে গরিব মানুষের জন্য। ক্লান্তিকর এই একঘেয়েমি কাজের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী কার্যত দেশটির ক্লান্তিকর ও সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে ঢেকে রাখার কৌশল নিয়েছেন। ছয়বার পূর্ণাঙ্গ, দুইবার অন্তর্বর্তী বাজেটসহ মোট আটবার বাজেট দিয়েছেন সীতারমণ। বেকারত্বে রেকর্ড গড়া অর্থনীতিকে ভালো দেখাতে তাকে একই বুলি আওড়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। এসব বাজেটে কোনো নীতিগত ঘোষণা পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু নতুন প্রকল্প, অর্থাৎ নিত্যনতুন নামে প্রকল্প বরাদ্দ আসে, নীতি একই থাকে। এবারের বাজেটও ভিন্ন কিছু ছিল না।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা ও একাধিক বিধানসভা নির্বাচনে স্পষ্ট যে একদিকে যেমন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে ছোট শরিকদের দিকে তাকাতে হবে, অন্যদিকে রাজ্য স্তরের বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে। এই বাজেটে বিহারের প্রতি বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে নীতিশ কুমারকে পাশে রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি এই বার্তা দিয়েছে, যেসব রাজ্যে তাদের সরকার থাকবে সেখানে বড় বরাদ্দ থাকবে। 

আয়কর ছাড়ের কথা এ বাজেটের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, তা কার্যত বুলিসর্বস্ব। বিশ্লেষকদের মতে, জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ মধ্যবিত্ত। আর তাদের তিন শতাংশেরও কম আয়কর দাতা। টিভি চ্যানেলে কর ছাড় সম্পর্কে যারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তাদের বেশির ভাগই ওই ক্ষুদ্র অংশটির অন্তর্ভুক্ত। ভারতের অর্থনীতি যে সংকটে পড়েছে, সেখানে বাজারে চাহিদার অভাবই মুখ্য কারণ। আর এর পেছনে রয়েছে কর্মসংস্থানের ঘাটতি। বিশেষত মধ্যবিত্ত যে ধরনের চাকরি খোঁজে, ভারতের বাজারে তার অভাব প্রকট। এই সমস্যাটি অদূর ভবিষ্যতে আরো সংকট তৈরি করবে। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজের বাজারটিকে ক্রমে পাল্টে দিচ্ছে। ভারতের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়া শেষেও বসে থাকতে হচ্ছে, এমন বহু নিদর্শন গত কয়েক দশকে দেখা গেছে। এই অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার ছিল। অথচ বাজেটে এ খাতে বিশেষ কোনো বরাদ্দ নেই।

প্রতি বছর বাজেটে ভারতের ভঙ্গুর অর্থনীতি ঢাকতেই হয় অর্থমন্ত্রীকে; নজর ঘোরানোর জন্য সামনে নিয়ে আসতে হয় নিত্যনতুন প্রকল্প। গত জুলাই মাসে ভারতের অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছিলেন, সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে চালু হয়েছিল পিএম-ইন্টার্নশিপ প্রকল্প। লক্ষ্যমাত্রা ছিল পরের পাঁচ বছরে শিক্ষিত কিন্তু অদক্ষ বেকারদের জন্য এক কোটি কর্মসংস্থান করা। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছেলেমেয়েদের দেশটির ৫০০ বড় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে সুযোগ দেওয়া হবে। তাদের প্রতি মাসে নির্ধারিত টাকা দেওয়ারও কথা বলা হয়। চলতি অর্থবছরেই ১.২৫ কোটি এমন চাকরি সৃষ্টি করার লক্ষ্য ছিল। সেই মতো আবেদনের জন্য পোর্টাল খোলা হয়। ছয় লাখের বেশি আগ্রহী আবেদন করলেন। গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনেই তাদের কাজে বহাল করার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার অগ্রগতি থমকে আছে। এবারের বাজেট ভাষণে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এর বিপরীতে নতুন প্রকল্প হাজির করা হলো, ‘মেক ফর ইন্ডিয়া, মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’। স্কিল ইন্ডিয়া মিশন, প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা এবং ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন যে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে; এ নিয়েও ভারতের অর্থমন্ত্রী নিরুত্তর।

তবে দেশটির অর্থমন্ত্রী খুব স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছেন, এ বাজেট কৃষকবান্ধবও নয়; শ্রমিকবান্ধবও নয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার অর্থবরাদ্দ গত বছরের চেয়ে এক পয়সাও বাড়েনি; বরং মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এত দিন দেশের মাথাপিছু আয়ের সাড়ে তিন গুণ আয় করলে তবেই আয়কর দিতে হতো। এবার যারা আয়কর দেবেন, তারা মাথাপিছু আয়ের ছয় গুণ আয় করবেন। অতএব গরিবদের মাথায় পরোক্ষ করের বোঝা আপেক্ষিকভাবে আরো বাড়বে।

গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভারতে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে শ্রেণিগত অসাম্যও বিপুল। প্রতি বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ভারত থাকে সবচেয়ে নিচের দিকে। আর তা প্রকাশিত হলেই ‘ষড়যন্ত্রের গল্প’ তোলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এমনকি সরকারি তথ্যসূত্র অনুযায়ীও অপুষ্টির যে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে, তা আফ্রিকার অনেক গরিব দেশের চেয়েও মারাত্মক। অথচ নির্মলা সীতারমণ বাজেট ভাষণে বলেছেন, ভারতীয়রা নাকি পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া নিয়ে উত্তরোত্তর সচেতন হচ্ছে। অথচ অপুষ্টি কমানোর কেন্দ্রীয় প্রকল্প পিএম পোষণের বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh