Logo
×

Follow Us

খেলাধুলা

খেলাধুলাতেও সাফল্যের পাশাপাশি বৈষম্য

Icon

সোহাগ আহমেদ

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২০, ১৫:৫৬

খেলাধুলাতেও সাফল্যের পাশাপাশি বৈষম্য

বাংলাদেশের মেয়েরাও যে ফুটবল পায়ে মাঠ কাঁপাতে পারেন, ক্রিকেট ব্যাট হাতে ছক্কা হাঁকাতে পারেন, ভারোত্তোলনে আন্তর্জাতিক আসরকে উল্লসিত করতে পারেন, দুই যুগ আগেও এমনটি ভাবা যেত না। 

এবারের এসএ গেমসে ১৯টি সোনায় বড় অবদান রেখে একটু বেশিই অভিনন্দন পাবেন লাল-সবুজের মেয়েরা। ছয়টি ব্যক্তিগতসহ মোট ১১টি সোনার সঙ্গে যুক্ত তারা। এতেই বোঝা যায়, খেলাধুলায় বাংলাদেশের মেয়েরা কতটা এগিয়েছে। 

ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা মেয়েদের মানায় না- এ ধারণা থেকে দেশবাসীর মানসিকতাকে তারা অনেকটাই সরিয়ে এনেছেন। সাফল্যের শুরুটা যাদের হাত ধরে এসেছে, সেই নারী খেলোয়াড়দের বহুরৈখিক সংগ্রাম ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। 

নারী ফুটবলের সাফল্যের কথা আসলেই অবধারিতভাবে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের মেয়েদের কথা উঠে আসে। চরম সুবিধা-বঞ্চনার মধ্যে থাকা এই মেয়েদের সামনে ছিল হাজার বাধা। প্রান্তিক পরিবারের দরিদ্র এই মেয়েরা গোড়ার দিকে না পেয়েছেন উন্নত প্রশিক্ষণ, না পেয়েছেন উৎসাহ-উদ্দীপনা। উল্টো সামাজিকভাবে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে তাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বাধা ডিঙিয়ে তারা সাফল্যের মুকুট ছিনিয়ে এনেছেন। কলসুন্দরকন্যারা এখন বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেন।

নারী খেলোয়াড়দের সেই স্বপ্ন যে দিবাস্বপ্ন নয়, তা তারা বারবার প্রমাণ করেছেন। সর্বশেষ বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ফুটবলে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা তা প্রমাণ করেছেন। কলসুন্দরকন্যা তহুরা খাতুন যখন জাতীয় দলের স্ট্রাইকার হিসেবে রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে ‘বর্ষসেরা নারী’র সংবর্ধনা নেন, তখন তার দরিদ্র বাবা ফিরোজ মিয়ার চোখে আনন্দাশ্রু নামে। সে আনন্দে গোটা বাংলাদেশ উদ্বেলিত হয়।

এই তো কদিন আগেই অনূর্ধ্ব ১৯ দলের ছেলেরা দেশের হয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নের ট্রফি পেল। কিন্তু গত বছরের জুনে বাংলাদেশের মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট দল ছিনিয়ে এনেছিল এশিয়া কাপ। এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা জিতে বাংলাদেশের মাবিয়া আক্তার পদক নেয়ার সময় যখন স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সুরে অঝোর ধারায় কাঁদেন, তখন কোটি কোটি বাংলাদেশির চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।

সদ্য সমাপ্ত বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাংলাদেশের কিশোরী মনিকা চাকমা। সাতক্ষীরার ফুটবলার সাবিনা খাতুন বিদেশি কোটায় ভারতে ও মালদ্বীপের ক্লাবে খেলেছেন। 

ভারতে মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগে (আসরটিকে মেয়েদের আইপিএলও বলা চলে) বাংলাদেশের প্রথম কোনো নারী ক্রিকেটার হিসেবে খেলছেন বাংলাদেশের জাহানারা আলম।

ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের এই সাফল্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ। বলা যায়, দেশের মেয়েরা তাদের প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। এখন সেই প্রতিভার যথাযথ পরিচর্যা দরকার। তার দায় সরকারের। সেই দিকে খেয়াল রেখে প্রান্তিক পর্যায়ের নারী খেলোয়াড়রাও যাতে পর্যাপ্ত পুষ্টি পান, তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

খেলাধুলার পাশাপাশি প্রেম বা বিবাহিত জীবন খুব সহজেই সমন্বিত করে নিচ্ছেন ছেলেরা। বিয়ের পর খেলোয়াড়ি জীবন হয়ে ওঠে আরো গোছানো। মাশরাফি-সাকিব-তামিমরা উদাহরণ হয়েই সামনে। ক্রিকেটের জন্য তাদের বিসর্জন দিতে হয়নি সংসার গড়ার স্বপ্ন। সেখানে দেশের নারী খেলোয়াড়দের বেলায় বাস্তবতা উল্টো। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করাই যেন কঠিন সালমা-জাহানারাদের। 

নারীরা খেলাধুলায় বেশ এগিয়ে গেলেও এখনো নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। প্রত্যেকটি বোর্ডেই রয়েছে বেতন বৈষম্য। বিসিবির তথ্য বলছে, বর্তমানে বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ১৭ নারী ক্রিকেটারের বেতন সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা! আর ছেলেদের ক্রিকেটে সর্বনিম্ন বেতন প্রায় এক লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয় ছেলেদের জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ২৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্তরের ২০ হাজার টাকা। মেয়েদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাচ ফি এক হাজার টাকা। তাও সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের প্রতি বৈষম্য কি ক্রিকেটেই শুধু? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, অবশ্যই নয়। ফুটবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিক্সসহ সবক্ষেত্রেই শুধু আর্থিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও বৈষম্যের শিকার নারীরা, যার শুরু পরিবার থেকেই।

যেমন- ময়মনসিংহের কলসুন্দরের মেয়েরা। ফুটবল খেলতে গিয়ে তাদের প্রথমেই বাধা আসে পরিবারের কাছ থেকে। পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, ফুটবল খেললে মেয়ের আর বিয়ে হবে না। তার ওপর দু’বেলা খাবারের জোগানই যেখানে বাহুল্য, সেখানে ফুটবল খেলা তো আকাশ-কুসুম কল্পনা। অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এই মেয়েরা আজ দেশ ও দেশের ফুটবলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ঢিম ঢিম করে জ্বলতে থাকা বাংলাদেশ ফুটবলকে আলো দেখিয়েছেন এরা। অথচ এ দেশে মেয়েদের পেশাদার ফুটবলের জরাজীর্ণ অবস্থা।

শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, যেসব মেয়ে সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সে সুনাম কুড়িয়ে এনে দেশের মুখ আলো করছেন, হয়তো নিজের ঘরে আলো জ্বালাবার সামর্থ্যটুকু তাদের নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫