দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নক্ষত্র শামস-উল-হুদা

খলিলুর রহমান ও গোলাম মোস্তফা মুন্না
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:২৭

শামস-উল-হুদা। ছবি: দেশকাল পত্রিকা
নিঃস্বার্থ, পরোপকারী, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া-এসব মানবিক গুণ বর্তমানের স্বার্থপর, অর্থপিপাসু বাণিজ্যিক দুনিয়ায় খুবই বিরল। কিন্তু শামস-উল-হুদা ছিলেন সেই বিরল মানুষদেরই একজন যিনি সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে গেছেন। স্থাপন করে গেছেন ত্যাগ আর বিসর্জনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
চারদিকে স্বার্থপরতা আর নিজেকে বড় প্রমাণের প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে যখন মনটা হাঁপিয়ে ওঠে, তখন অজান্তেই ভেসে ওঠে শামস-উল-হুদার প্রতিচ্ছবি। বহুগুণে গুণান্বিত এই মানুষটি কতভাবে যে সমাজ বিনির্মাণে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন! চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সমাজসেবী, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠক, শিক্ষানুরাগী-এসব বিশেষণ জুড়ে গিয়েছিল একজন শামস-উল-হুদার নামের সঙ্গে।
তবে বাকি সবকিছু ছাপিয়ে ‘ক্রীড়া সংগঠক শামস-উল-হুদা’ পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠেছিল। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন আপাদমস্তক দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক। এই পরিচয়ের মধ্যে যেন তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। যশোর জেলার ক্রীড়া উন্নয়নে সবকিছুই করেছিলেন শামস-উল-হুদা। যশোরের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি অবদান রেখেছিলেন দেশের ক্রীড়া উন্নয়নেও।

মৃত্যুর ৩৬ বছর পরও যশোর জেলার ক্রীড়াঙ্গন মাথা উঁচু করেশামস-উল-হুদার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। যশোরের শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম, যশোর শহরের অদূরে হামিদপুরের শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি তো তাঁর নামেই নামকরণ। শুধু এই দুটিই নয়, আরও অনেক ক্রীড়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই মাথা উঁচু করে মহান শামস-উল-হুদার জয়গান করে চলেছে। যশোরের ক্রীড়া সংস্থা এবং ক্রীড়াঙ্গন শামস-উল-হুদার অস্তিত্ব, ত্যাগ আর অবদানের সাক্ষ্য দেবে চিরকাল। ৭০ বছরের জীবনে ৫৬ বছরই যিনি যশোর এবং দেশের খেলাধুলার উন্নয়নে নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন, এমন একজন কিংবদন্তিকে কি ভুলে থাকা যায়?
পড়ালেখা, খেলাধুলা আর কঠোর পরিশ্রম-নিজেকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে বিকশিত করার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান। শামস-উল-হুদা হৃদয় দিয়েই এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাই ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রমী শামস-উল-হুদা নিজের জীবনে যেমন এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, সমাজের মানুষদের জীবন গড়ে দিতেও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সব সময়। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে কাজ করেছেন অসংখ্য ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে।
চিন্তা-ভাবনায়, কর্মে হয়ে উঠেছিলেন মানবতার এক ফেরিওয়ালা। মহান এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শুরু-শেষের গল্পটা জানতে হলে সওয়ার হতে হবে অতীতের ডানায়। ফিরে যেতে হবে একশ বছরেরও বেশি পেছনে।
শামস-উল-হুদার জন্ম ১৯১৮ সালে, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর গ্রামে, এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর বাবা শেখ আবুল বারী, চাকরি করতেন যশোরের সিভিল কোর্টে। মাতা মোছাম্মৎ আশরাফুন নেছা ছিলেন গৃহিণী। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে শামস-উল-হুদা ছিলেন সবার বড়। পারিবারিকভাবেই ‘অভিভাবক’ সত্তাটা হৃদয়ে গেঁথে নেওয়ার সুযোগ পান। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী জীবনে মানব সমাজেরই ‘অভিভাবক’ বনে যান।

শামস-উল-হুদার শিক্ষা জীবনের শুরু যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে। পরে যশোর জেলা স্কুল হয়ে এসএসসি (তৎকালীন ম্যাট্রিক) পাস করেন কালিগঞ্জ হাটপুল স্কুল থেকে। যশোর এমএম কলেজ থেকে তৎকালীন আইএ ও বিএ পাস করেন। বিএ পাস করেই পা রাখেন কর্মজীবনে। চাকরি করেন খুলনা মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরির পাশাপাশি চালিয়ে যান ব্যবসাও। শুধু কি তাই?
চাকরি-ব্যবসার পাশাপাশি ক্রীড়া সংগঠকের ভূমিকাটাও পালন করেন পাল্লা দিয়ে। ছাত্র হিসেবে যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনি ফুটবল প্রতিভাও ছিল। গোলরক্ষক হিসেবে বিশেষ দক্ষতা ছিল তাঁর। ১৯৩০ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখনই সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গোলরক্ষক হিসেবে যশোরের খ্যাতনামা চিত্তরঞ্জন ক্লাবে যোগ দেন।
যশোর জেলা স্কুলে পড়ার সময় আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্টে অল বেঙ্গল দলের হয়ে শিরোপা জেতেন। পরে টাউন ক্লাব, ইয়ং মুসলিম ক্লাব, যতীন্দ্র মোহন ক্লাবের হয়ে যশোর লিগে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। এর মধ্যে খেলোয়াড় থাকাকালেই ইয়ং মুসলিম ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই নিজের ভেতরের ‘ক্রীড়া সংগঠক’ প্রতিভার প্রকাশ ঘটান তিনি। জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতেও। সুনাম কামিয়েছিলেন ‘রেফারি’ হিসেবেও। তবে খেলোয়াড় বা রেফারি সত্তার তুলনায় হাজারো গুণ বেশি আলো ছড়ান ‘ক্রীড়া সংগঠক’-এর ভূমিকায়।
ক্রীড়া সংগঠক সত্তাই মূলত তাঁকে যশোরবাসীর মনে গেঁথে দিয়েছিল, বানিয়েছিল ভালোবাসার প্রতীক, বসিয়েছিল শ্রদ্ধার আসনে। যশোরের মানুষ শাম্স-উল-হুদাকে কতটা ভালোবাসত-বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মফিজুর রহমান মুন্নার কথাতেই স্পষ্ট, ‘শামস-উল-হুদার বদনাম করার মতো মানুষ যশোরে ছিল না। বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনে।’
শামস-উল-হুদা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন তরুণ সমাজকে মাদকের নেশা থেকে দূরে রাখতে খেলাধুলার বিকল্প নেই। তাই তিনি সমাজের বেশ কিছু আগ্রহী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা গঠনের লড়াই।
তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর হার না মানা নেতৃত্বেই ১৯৫০ সালে গঠিত হয় যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা। প্রতিষ্ঠার পরের বছর থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬ বছর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টাতেই ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা যশোর স্টেডিয়াম। যে স্টেডিয়ামটি পরে তাঁরই নামে নামকরণ হয়েছে ‘শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম’। তাঁর মৃত্যুর পর যশোরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৮৮ সালে তাঁর নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়।
প্রতিষ্ঠার সময় স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য ইট কেনার সামর্থ্যও ক্রীড়া সংস্থার ছিল না। শামস-উল-হুদা তাই নিজের পৈতৃক বাড়ি থেকে ইট এনে স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে স্টেডিয়ামের চারদিকে টিনের বেড়া দিতেও নিজের পকেটের অর্থ ব্যয় করেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁর প্রচেষ্টাতেই টিনের বেড়া ভেঙে নির্মাণ করা হয় দেওয়াল।
শুধু নিজের বাড়ির ইট ব্যবহার করা নয়, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও স্টেডিয়াম নির্মাণে অর্থের জোগান দিতেও বড় ভূমিকা রাখেন জনাব শামস-উল-হুদা। সরকারের কাছে তদবির, স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য দেন-দরবার, সমাজের ধনাঢ্য ক্রীড়ামোদী ব্যক্তিদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনুদান সংগ্রহ, ক্রীড়া সংস্থার ক্রীড়া কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয় মেটাতে কী করেননি তিনি! কখনো কখনো নিজের ব্যবসা এবং বেতনের টাকা দিয়েও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যয় মিটিয়েছেন। ক্রীড়া সংস্থার কাজ করতে গিয়ে কত রাত যে তিনি স্টেডিয়ামেই কাটিয়েছেন তার হিসেব নেই।
অবকাঠামোগত উন্নতি শুধুৃ নয়, শামস-উল-হুদা যতদিন বেঁচে ছিলেন, একের পর এক টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে যশোর স্টেডিয়ামকে পুরো দেশেরই শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৭৬ সালে ঢাকার বাইরে সর্বপ্রথম যশোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় দেশের চতুর্থ জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা। এছাড়াও আরও অনেক জাতীয় ক্রীড়া টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে যশোর স্টেডিয়ামে। স্থানীয়ভাবে তো সারা বছরই আয়োজন করা হতো নানা টুর্নামেন্ট।
যশোরের যুব সমাজও সব নেতিবাচক নেশা ভুলে খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। শামস-উল-হুদার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যশোর থেকে উঠে আসে অনেক তারকা ফুটবলার। যারা পরে ঢাকা আবাহনী, মোহামেডান, ওয়ারী, আজাদ স্পোর্টিংসহ ঢাকার বড় বড় ক্লাবে খেলেছেন। খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলেও। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই ১৯৭৬ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় যশোর জেলা দল। রানার্সআপ হয় বেশ কয়েকবার। একাধিকবার শিরোপা জেতে হকিতেও।
যশোর এবং জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ১৯৭৭-৭৮ সালে শামস-উল-হুদাকে শ্রেষ্ঠ জাতীয় ক্রীড়া সংগঠকের পুরস্কার প্রদান করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি। ১৯৮৭ সালে ক্রীড়া ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার-জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয় তাকে।
শুধুই কি যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থায় অবদান রেখেছেন? এছাড়াও যশোরের আরও ক্লাবসহ অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজের ক্রীড়া চেতনার বীজ ছিটিয়েছেন শামস-উল-হুদা। বাংলাদেশ ক্রীড়া উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সদস্য ছিলেন। জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন ও খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গেও।
এ তো গেল যশোর জেলা ও জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানেও নিজের মেধা-দক্ষতা-সততার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। দীর্ঘদিন যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে যশোর শহরের উন্নয়নে কাজ করেছেন। এছাড়া যশোর ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি, যশোর শিল্পকলা একাডেমির সহসভাপতি এবং যশোর ক্লাবের সহসভাপতির দায়িত্বে থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ছিলেন যশোর পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সভাপতি, বিএভিএসের সভাপতি, দায়িত্ব পালন করেছেন যশোর রেডক্রসের সহসভাপতি হিসেবেও।
একইভাবে আলো জ্বেলেছেন শিক্ষা ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছিলেন যশোরের এনএম খান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাহমুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি, যশোর উপশহর কলেজের সভাপতি। ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন যশোর রেলওয়ে মহিলা কলেজ, নব কিশলয় কিন্ডারগার্টেন স্কুল, মোমিন গার্লস স্কুল এবং যশোর আলিয়া মাদ্রাসার সঙ্গেও। মোদ্দাকথা খেলাধুলা, শিক্ষা, বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান-জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই আলো জ্বেলেছেন। জনাব শামস-উল-হুদা ছিলেন মানব সমাজের জন্য সত্যিকারের আলোর মশাল।
বিস্ময়কর হলো, এই যে এত এত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু কখনোই তাঁর নামে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তোলার সাহস দেখাতে পারেননি। সেই সুযোগও পাননি। কতটা সৎ, নীতিবান, নিষ্ঠাবান হলে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থেকে একজন মানুষের পক্ষে এতগুলো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন সম্ভব ভাবা যায়! নিজের জীবন দিয়ে শামস-উল-হুদা স্থাপন করে গেছেন সততা, একাগ্রতা আর পরোপকারে আত্মনিবেদনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শিখিয়ে গেছেন পরের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করাই মানুষের ধর্ম। প্রমাণ করে গেছেন সততা আর ত্যাগের মাধ্যমেই সমাজ এবং সমাজের মানুষকে এগিয়ে নেওয়া যায়। ক্রীড়া, শিক্ষা, সামাজিক দায়িত্বের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ হিসেবেও ঈর্ষণীয় উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শামস-উল-হুদা। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ছিলেন এক ভরসারস্থল; নিরাপত্তার নাম। বর্তমানের সংঘাতময় হিংসাত্মক রাজনীতি বিবেচনায় যা সত্যিই বিরল দৃষ্টান্ত।
শামস-উল-হুদা নিজ পরিবারের জন্যও আদর্শ এক মানুষ। পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ পিতা। সন্তানদের একদিকে যেমন সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, তেমনি তাঁদের অন্তরে জ্বালিয়ে গেছেন মানবতার চেতনা। ১৯৮৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৭০ বছর বয়সে যশোরবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। যশোরের মানুষ জনাব শামস-উল-হুদাকে কতটা ভালো বাসত, তার জ্বলন্ত প্রমাণ মেলে তাঁর মৃত্যুর পর।
শামস-উল-হুদার মৃত্যু সংবাদ পুরো যশোরে আনে শোকের ছায়া। সর্বস্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করে রাস্তায় নেমে। যশোরের স্থানীয় সব পত্রপত্রিকা তো বটেই; তৎকালীন দেশের জাতীয় পত্রপত্রিকাতেও ঠাঁই করে নেয় শামস-উল-হুদার মৃত্যু সংবাদ। তাঁর নামাজে জানাজায় শরিক হন হাজার হাজার মানুষ।
মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও শামস-উল-হুদাকে হারানোর শোক-কষ্ট ভুলতে পারেনি যশোরবাসী। ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই যশোরবাসীর হৃদয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠে শামস-উল-হুদার কর্মময় জীবনের স্মৃতি। যশোরের ‘শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম’, হামিদপুরের ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি’সহ অসংখ্য শিক্ষা-সামাজিক প্রতিষ্ঠান তো সব সময়ই তাঁকে, তাঁর কীর্তিকে, তাঁর ত্যাগের মহিমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শামস-উল-হুদার মতো পরের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষের মৃত্য নেই। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের কর্মে, আদর্শে, ভালো কাজের সুখস্মৃতি হয়ে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শামস-উল-হুদা ওপারে চলে যাওয়ায় যশোরের ক্রীড়াঙ্গনও যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। হারিয়ে ফেলেছে সেই মর্যাদার আসন। আগের সেই জৌলুস আর নেই। তার সময়ে যেখানে নিয়মিতভাবে জাতীয় টুর্নামেন্ট আয়োজন হতো, আজ সেখানে স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, শামস-উল-হুদার নামে যে টুর্নামেন্টের প্রচলন করা হয়েছিল, সেই শামস-উল-হুদা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টও নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় না।
যশোর ক্রীড়াঙ্গনের এই ঘুম পাড়ানি চেহারাটা যেন ক্রীড়া সংগঠক শাম্স-উল-হুদার শূন্যতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যা দেখে একটা আফসোসই আসে- শামস-উল-হুদা যদি বেঁচে থাকতেন, যদি আবার ফিরে আসতেন!
শামস-উল-হুদা স্মরণে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন, অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা, একাগ্রতা, আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে শামস-উল-হুদা যশোরবাসীর মনে কতটা জায়গা করে নিয়েছিলেন তা যশোর এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কথাতেই স্পষ্ট।
যশোরের শামস-উল-হুদা সম্পর্কে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমার ফুটবল ক্যারিয়ার যখন শুরু হয় তার কিছুদিন পরই আমি শামস-উল-হুদার নাম শুনে আসছি। উনি শুধু যশোর নয়, সারা দেশের ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁর কাজের কারণে তাঁকে সবাই চিনতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নানা ভূমিকা পালন করে আলাদা একটা পরিচিতি পাইয়ে দিয়েছিলেন। মরহুম শামস-উল-হুদা ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেও যশোরে একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি নিজেকে এবং নিজের অবস্থানকে আলাদাভাবে তুলে ধরে অনুকরণীয় হয়ে আছেন। একজন আপাদমস্তক ক্রীড়া সংগঠক হতে যে যে গুণের প্রয়োজন ছিল তাঁর সবই ছিল।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই সদস্য বলেন, ‘২০১১ সালে শামস-উল-হুদার নামে ফুটবল একাডেমি চালু করা হয়। এর আগে তার নামে জেলা স্টেডিয়ামেরও নামকরণ করা হয়েছিল। তবে আমি খুব খুশি হয়েছি ফুটবল একাডেমি চালু করায়। এটি দেশের ফুটবলে আরও বড় অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করছি। যতদূর জানি ২০১৮ সালে বাফুফের অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় এই একাডেমির ছিল।’
কাজী সালাউদ্দিন আরও বলেন, ‘একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে শামস-উল-হুদার নাম যশোরের পাশাপাশি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলেই বিশ্বাস করি। এমন গুণী মানুষের কদর যারা করবে তারা নিজেরাও তার অংশীদার হতে পারবে। নতুন প্রজন্মের সংগঠকরা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, “৭০, ৮০ এবং ৯০ দশকে যে কয়জন বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যশোরের মরহুম শামস-উল-হুদা। শুধু যশোর নয়, সারা দেশেরই পুরনো ক্রীড়া সংগঠকরা তাকে চিনতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নানা ভূমিকা পালন করেন। মরহুম শামস-উল-হুদা ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেও যশোরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি নিজেকে এবং নিজের অবস্থানকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে পারতেন। সেই গুণ তাঁর ছিল। তিনি তাই সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন এবং নিজের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নেই বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন। যশোরের ক্রীড়া উন্নয়নে তিনি শ্রম, সময়, অর্থ সবকিছুই ব্যয় করেন। তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক যদি আরও থাকত, তাহলে ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য রকম ইতিহাস রচিত হতো বলেই আমি বিশ্বাস করি।”
উল্লেখ্য, যশোরবাসীর দাবির মুখে শেখ শহিদুল ইসলাম যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী থাকাকালেই যশোর স্টেডিয়ামের নামকরণ হয় ‘শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম।’ সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “ওনার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে যশোরের সর্বস্তরের মানুষ তার অবদানস্বরূপ যশোর স্টেডিয়ামটি তাঁর নামে করার দাবি জানায়। তখন আমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম। মানুষের সর্বসম্মত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আমার মন্ত্রণালয়ে যশোর স্টেডিয়ামটি তার নামে করার আবেদন করলে আমরা অনুমোদন দিই।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান আব্দার বলেন, “ক্রীড়াবিদ শামস-উল-হুদা, যশোরের ক্রীড়ায় বিশাল অবদান রেখেছেন বলেই স্বাধীনতার অনেক পরে হলেও তাঁর নামে যশোর স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়। যশোরের ক্রীড়া ও সামাজিক উন্নয়নে হুদা সাহেবের অবদান যশোরবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান ও যশোর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম বলেন, “শামস-উল-হুদা সাহেব ক্রীড়া অনুরাগী মানুষ ছিলেন। যশোর এবং দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তার প্রশংসনীয় ভূমিকা চিরস্মরণীয়।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা আমিরুল ইসলাম রন্টু বলেন, “আমি আমার ছাত্রজীবনে যশোরের যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম শুনেছি, তার মধ্যেশামস-উল-হুদা সাহেব ছিলেন অন্যতম। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। ১৯৬৫ সালে আমি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম। কিন্তু এই পেশাটা আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমার শ্বশুর একদিন আমাকে শামস-উল-হুদা সাহেবের কাছে তাঁর ঘোপের বাড়িতে পাঠালেন।
হুদা সাহেব ট্যাক্সিতে করে আমাকে খুলনার মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে নিয়ে গেলেন। তিনি ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির খুলনার বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি আমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিলেন। এরপর ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে আমাকে যশোর ভিত্তিক একজন অফিসার হিসেবে চাকরি দিলেন। তিনি যশোরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছেন। যশোর ক্রীড়া সংস্থা ও যশোর স্টেডিয়াম নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার সাহসী পদক্ষেপগুলো সত্যিই প্রশংসনীয় এবং চিরস্মরণীয়।”
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপূর্ব সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পুত্র মাহমুদ হারুন চৌধুরী শামস-উল-হুদা সাহেবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার বাবা সিরাজুল হক চৌধুরী ৪৭-এর পর কলকাতা থেকে যশোরে এসে আইন প্র্যাকটিস করতেন। ৬০-এর দশকের শুরুতে ওই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। বাবা তখন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ওই কমিটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ছিলেন সহসভাপতির দায়িত্বে। বাবা যখন রাজনীতি করতেন তখন একজন অপরজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। যেমন মরহুম শামস-উল-হুদা চাচার প্রতি আব্বার যে শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান, ভালোবাসা দেখেছি তা অতুলনীয়। প্রথম যেদিন আব্বার কাছ থেকে শামসুল হুদা চাচার বিষয়ে জানি, বিষয়টি আমাকে অনেক মুগ্ধ করে।”
আব্বার ভাষ্য অনুযায়ী, “হুদা ভাই আমাদের সিনিয়র ছিলেন। তিনি তখন সরকারি দলের জেলা সেক্রেটারি। তো আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করার কারণে মাঝেমধ্যেই আমাদের জেলে যেতে হতো। সেই সময়ে আমাদের একটা বড় ভরসার জায়গা ছিলেন হুদা ভাই। উনি নিয়মিত আমাদের জেলখানায় দেখতে যেতেন, খোঁজখবর নিতেন। একবার আমাদের ১১ জনকে গ্রেপ্তার করল।
সেবার প্রায় তিন-চার মাসের বেশি সময় থাকতে হয়েছে। তো হুদা ভাই একদিন এসেছেন খোঁজখবর নিতে। অনেক কথাবার্তা হলো, তো একরামুল হক নামের আমাদের একজন বলল, ভাই অনেক দিন হয়ে গেছে দই মিষ্টি কিছুই খাওয়া হচ্ছে না। জেল থেকেও তো দেয় না। তিনি জেল চিকিৎসকের কাছ থেকে স্পেশাল ডায়েট চার্ট নিয়ে যশোরের মধু সুইট থেকে কিনে পাঠিয়ে দিলেন, আমরা রাতে খেলাম।
আমাদের আন্দোলন সংগ্রামে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন হুদা ভাই। অনেক সময় এমন হয়েছে পোস্টারিং করব কিন্তু কাগজ কেনার টাকা নেই। একবারের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। ক্যালটেক্স পেট্রল পাম্পের ওখানে হুদা ভাইসহ সিনিয়র নেতারা বসে আড্ডা দিতেন। তো আমরা ওই দিক দিয়ে যাওয়ার সময় হুদা ভাইয়ের পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে নিলাম। দেখি ২১ টাকা আছে। তো হুদা ভাই বলল বাড়ি যাওয়ার ভাড়া তো দিয়ে যা।
তখন উনাকে ১ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বাকিটা আমরা নিয়ে গেলাম। সেই টাকা দিয়ে কাগজ কিনলাম, পোস্টারিং করলাম। তুমি ভাবতে পারো, মুসলিম লীগের জেলা সেক্রেটারির পকেটে হাত দিয়ে টাকা নিয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পোস্টারিং করেছি। এমনই ছিল তখনকার রাজনীতি। হুদা ভাই অসাধারণ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মানুষ হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন।”
যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবীর বলেন, “যশোরের একজন স্বনামধন্য ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শামস-উল-হুদা। উনি একজন ভালো মানুষ এবং একজন ভালো সংগঠক ছিলেন। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে তিনি খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকতেন এবং একবারে রাতে বাসায় গিয়ে খেতেন। ওই সময়কার সমস্ত খেলা তিনি নিজ দায়িত্বে সবার সঙ্গে মিলেমিশে পরিচালনা করতেন। নিজের পকেট থেকেও খরচ করেছেন।
সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। যশোরের স্টেডিয়াম তাঁর নামে হয়েছে। আসলে ওই সময় অন্য কারও নামকরণ করার কোনো প্রস্তাবনাও ছিল না। তিনি একজন অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। যার আদর্শ এবং নীতিজ্ঞান নিয়ে আমরা চলছি। ... তিনি ছিলেন যশোরের ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণ।”
জাতীয় দলের আরেক সাবেক ফুটবলার আজিজুল হক জিল্লু বলেন, “আমার বাসা যশোরের স্টেডিয়াম পাড়ায়। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে এই মাঠে। তখনকার দিনে এখানে যারা কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের অনুপ্রেরণাতেই আজ আমি জিল্লু হতে পেরেছি। বাংলাদেশ টিমে, ঢাকা মোহামেডান ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ক্লাবে দীর্ঘসময় ধরে খেলেছি। আমরা যখন স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করি, টুকটাক খেলি, মাঝে মাঝে দেখতাম স্টেডিয়ামে খেলা হয়, পরে আস্তে আস্তে আমরাও সম্পৃক্ত হয়ে যাই। তখন যশোর ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা, খোকা সাহেব, জহুরুল হক সাহেবরা।
এদেরকে যিনি কন্ট্রোল করে রাখতেন তিনি হুদা সাহেব। তিনি যে কত বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আমি তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। বাবা ওনাদের বাড়িতে পড়াতেন। সেই সূত্রে আমার যাওয়া-আসা ছিল। হুদা সাহেব জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কী রে খেলাধূলা কি পারিস নাকি? বাসার পাশেই তো মাঠ, চলে আসিস।’ তারপর প্রাকটিস করতে করতে আরও ভালো সম্পর্ক হলো।
তিয়াত্তরে একটা ন্যাশনাল বাছাই হলো খুলনাতে। আমরা যশোর থেকে ছয়জন গেলাম সেখানে। বয়স কম থাকায় ন্যাশনালে চান্স হলো না, কিন্তু নির্বাচকদের পছন্দ হওয়ায় আমাদের দুয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকায় নিয়ে গেল। তিনি আমাদের খোঁজখবর রাখতেন সন্তানের মতো। ক্রীড়াঙ্গনে তিনি এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে নিজের পরিবারকেও ঠিকমতো সময় দেননি।
এমনও হয়েছে যে হুদা সাহেব বাজার করার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছেন, বাজারের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে তাও স্টেডিয়ামে বসে আছেন। যে সমস্ত খেলোয়াড়ের টাকার দরকার হতো, হুদা সাহেব বাজারের টাকা থেকে তদেরকে দিয়ে দিতেন। আমাদের জন্য তিনি এতটাই ত্যাগ করেছেন। আল্লাহ উনাকে পরপারে ভালো রাখুক।”
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার সৈয়দ মাশুক মুহাম্মদ সাথী স্মৃতিচারণা করেন এভাবে, “আমি ওনাকে পেয়েছি শেষের দিকে। যশোর ক্রীড়া সংস্থায় তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ের পারিবারিক খবর রাখতেন। খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করতেন। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য তিনি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। তিনি ঢাকায় গেলে যশোরের যারা ঢাকায় খেলত, তাদের সবার সঙ্গে দেখা করতেন। সব খেলোয়াড়কে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। ওনার সময় ক্রীড়াঙ্গন ক্রীড়ামুখর থাকত। প্রাকটিসের সময় আমাদের কখনো বল কিনতে হয়নি, তিনিই বলের ব্যবস্থা করতেন। দুঃখের বিষয় হলো, তাঁর মৃত্যুর পর যশোর ক্রীড়াঙ্গন ওভাবে আর কখনোই উজ্জীবিত হয়নি। তিনি আমার দেখা যশোরের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।”
যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শফিকুজ্জামান বলেন, “আমি উনিশশ ষাটের দশকে পেয়েছি হুদা সাহেবকে। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তিনি ইউনিক ছিলেন। তখনকার সময় টাকা-পয়সা কম থাকলেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁরা যশোর ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমার মতে তৎকালীন সময়ে হুদা সাহেবের মতো এত ভালো সংগঠক যশোর কিংবা পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয়জন ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে মেশার এবং চলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর ক্রীড়ায় একটা শূন্যতা দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে সংগঠক হিসেবেও তাঁর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
আমি তখন ঢাকায় খেলাধুলা করি, এরপর যখন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসাধারণ সম্পাদক আলমগীর সিদ্দিকী মারা গেলেন, হুদা সাহেব ঢাকায় এসে আমাকে বুঝিয়ে কিছুদিনের মধ্যে যশোরে নিয়ে আসলেন। আমাকে সহসাধারণ সম্পাদক বানালেন। পরে যশোরে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হলো। হুদা সাহেবের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা টুর্নামেন্টগুলো সম্পন্ন করেছি। সংগঠক হিসেবে যশোর এবং ঢাকা দুই জায়গাতেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। যশোর জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে শুরু করে সেখানকার যে সমস্ত খেলোয়াড় বিভিন্ন ইভেন্টে জাতীয় দলে চান্স পেয়েছে তার সবটুকু অবদান শুধু তাঁরই। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সবসময় খেলা নিয়েই ছিল।”
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল এবং হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় এবং জাতীয় হকি কোচ, বিকেএসপির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কোচ মোঃ কাওসার আলী শামস-উল-হুদা প্রসঙ্গে বলেন, “যশোর তথা দেশের জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রয়াত শামস-উল-হুদা কেবল একটি নামই নয়, তিনি ছিলেন সফল ব্যক্তিত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্তও। অসাধারণ কর্মদক্ষতা, তীক্ষ্ন মেধাশক্তি, অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য তাকে নিঃসন্দেহে ক্রীড়াজগতের অনন্যতর আসনে আসীন করেছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ন্যায়-নিষ্ঠা যশোর তথা দেশের ক্রীড়ার ভাবমূর্তিকে করেছে সমুজ্জ্বল। এই অসামান্য প্রতিভাধর, উদারপ্রাণ ব্যক্তিটির ভালোবাসা ও সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাঁর হাত ধরেই আমার ক্রীড়া জীবনের পথচলার সূচনা। তাঁরই প্রেরণায় আমার জীবনের যত ক্রীড়া সাফল্য।
এই মহান মানুষটি সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলব যে, হুদা ভাই না থাকলে আমার ক্রীড়া জীবনের সূচনাই হতো না। তাঁর পবিত্র স্পর্শেই আমার ক্রীড়া জীবনের যত গল্পগাথা। তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বলেন, “শামস-উল-হুদা ছিলেন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিপদে আপদে তিনি সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী বলেন, “মানুষ হিসেবে তিনি খুবই ভালো ছিলেন। এরকম মানুষ এ যুগে খুব একটা দেখা যায় না।”
ব্যবসায়ী চিন্ময় সাহা বলেন, “তিনিই ছিলেন যশোর ক্রীড়াঙ্গনের একমাত্র ব্যক্তি, যার হাত ধরে যশোরে তৈরি হয়েছে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়। যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন খেলায় যশোরের সুনাম বাড়িয়েছেন। তিনিই ছিলেন যশোর স্টেডিয়াম তৈরির প্রধান কারিগর। জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো ত্যাগ করে, ঘর-সংসার ত্যাগ করে তিনি স্টেডিয়াম ও খেলোয়াড় তৈরির পেছনে নিজের জীবন ব্যয় করেছেন।
স্বাধীনতার পরে অনেকেই মনে করতেন অনেক কিছু বদল হওয়ার দরকার কিন্তু কেউ কখনো জেলা ক্রীড়ার ঐ পদ থেকে তাকে সরানোর চিন্তাও করেনি। তারা জানতেন, তিনি একটা মহীরুহ। তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জেলা ক্রীড়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। স্টেডিয়াম গঠনে তার সঙ্গে সহযোগী ছিলেন আমার স্বর্গীয় পিতা চিত্তরঞ্জন সাহা, পৌরসভার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, বাবু সুধীর কুমার ঘোষ, শেখহাটির বজলুর রহমান তার ছোট ভাই তৈমুর রহমান, মসিয়ুর রহমান সরদার প্রমুখ।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান, যশোর শিক্ষাবোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “শামস-উল-হুদা সাহেবের অন্য কিছুর প্রতিই অতটা আসক্তি ছিল না, যতটা ছিল ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি। তিনি দিনের বেশিরভাগ সময়ই খেলাধুলার সঙ্গে থাকতেন, স্টেডিয়ামেই রাত-দিন পার করে দিতেন।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল হক (অব.) বীর বিক্রম বলেন, “শামস-উল-হুদা সাহেব একজন ভালো মানুষ ছিলেন। খেলাধুলার প্রতি তাঁর অনেক আগ্রহ ছিল। যশোর স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য তিনি জমি দিয়েছেন, টাকা দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন। আমি একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেখানে তার সেজ মেয়ে এবং সেজ মেয়ের জামাই তাঁর নামে একটি বিল্ডিং তৈরি করে দিয়েছেন।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মিকাইল হোসেন মিন্টু শামস-উল-হুদাকে মনে রেখেছেন এভাবে, “ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আমি ‘অভিযাত্রিক সংঘ’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করতাম। ঘোপ জেল রোডের ওই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শাম্স-উল-হুদা চাচা। আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। উনার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। সামাজিক কার্যক্রমেও থাকতেন অগ্রভাগে। সবাইকে সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মফিজুর রহমান মুন্না বলেন, “শামস-উল-হুদা যশোরের একজন স্বনামধন্য ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যশোর স্টেডিয়াম নির্মাণে তাঁর বিশাল অবদান ছিল। নিজের বাড়ির ইট দিয়ে স্টেডিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর ও দেওয়াল নির্মাণ করেছিলেন।”
যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, “শামস-উল-হুদা সাহেব কখনোই কারও জন্য ক্ষতিকর লোক ছিলেন না। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন।”

শাম্স-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি
কখনো কখনো কোনো প্রতিষ্ঠানও কোনো একজন মানুষের দুনিয়াবি জীবনের গল্প বলে। যশোরের হামিদপুরের ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি’ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সাদা চোখে এটা একটা ফুটবল একাডেমি। শিশু-কিশোরদের ফুটবল দীক্ষার আদর্শ স্থান। বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে প্রতিনিয়ত শত শত শিশু-কিশোর-তরুণ হইহুল্লোড় করে ফুটবল শিখছে সেখানে। দিনময়
কিশোর-তরুণদের সেই ফুটবল দীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি’ যেন বোবা কণ্ঠে পথচলতি মানুষদের ডেকে বলে, এসো হে পথিক-কীর্তিমান ‘শামস-উল-হুদা’র জীবনের গল্প বলি শোন।
পথচলতি মানুষদের কারও কানে হয়তো সেই বোবা কণ্ঠের গল্প পৌঁছায়ই না। কিন্তু যারা শামস-উল-হুদাকে চিনতেন, জানতেন, তার কর্মময় জীবনের গল্প যাদের জানা, তারা শুধু অদৃশ্য বোবা কণ্ঠের সেই গল্প শুনতেই পায় না, নিজের অন্তরে আঁকা বাস্তবের গল্পের সঙ্গে মিলিয়েও নেয়। তখন তাদের কাছে একাডেমির বিশালাকৃতির সবুজ মাঠ দুটি,
ইট-বালি-সিমেন্টের তৈরি একাডেমি ভবনের মধ্যে ফুটে ওঠে কিংবদন্তি শাম্স-উল-হুদার প্রতিচ্ছবি। মনের গহিনের অন্তরাত্মায় যেন আপনা থেকে কথার অনুরণন ওঠে-আহা কী অসাধারণ এক মানুষই না ছিলেন শামস-উল-হুদা!
যশোরবাসীর কাছে সত্যিকার এক কিংবদন্তিই শামস-উল-হুদা। বিশেষ করে যশোর ক্রীড়াঙ্গনের প্রবাদপুরুষ। যশোরের ক্রীড়া উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন যিনি, তাঁর নামই শামস-উল-হুদা। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই যশোর স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে ‘যশোর শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম।’ হামিদপুরের ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি’র নামকরণও হয়েছে তাঁর নামেই।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুটবল একাডেমিটি এখন আর সেই স্বপ্নের ছোট্ট চারাটি নেই। এক যুগ পেরিয়ে সেটি এখন প্রসারিত, হাঁটছে পরিপূর্ণতার পথে। যশোরের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলেও লেগেছে ‘শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি’র সাফল্যের সুবাতাস। একাডেমির তরুণ ফুটবলাররা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আয়োজিত বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে নিয়মিত আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
গত অক্টোবরে যে বাফুফে আয়োজিত প্রথম অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাকার শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, তাদের ওই শিরোপা সাফল্যের বড় অংশীদার ছিল শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমিও। চ্যাম্পিয়ন শেখ জামালের ২৫ সদস্যের স্কোয়াডের ২০ জন ফুটবলারই যে ছিলেন এই শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই ক্লাবটি টুর্নামেন্টের জন্য শাম্স-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির তরুণ ফুটবলারদের হায়ার করেছিল।
২০১৮ সালে ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়েও ছিল শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির বড় অবদান। তারাও সেবার দল গড়েছিল শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির ফুটবলারদের নিয়ে। ঢাকার আরও অনেক নামিদামি ক্লাবই বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টের জন্য এই একাডেমির তরুণ ফুটবলারদের ধার করে খেলিয়ে সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছে।
শুধুই কি বাফুফের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে আলো ছড়ানো? শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির তরুণরা ঢাকার বড় বড় ক্লাবের হয়ে আলো ছড়িয়ে চলেছে দেশের শীর্ষ ফুটবল লিগেও (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ)। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল, বসুন্ধরা কিংস, ব্রাদার্স ইউনিয়নসহ দেশের সব বড় বড় ক্লাবের হয়েই প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন একাডেমির ছেলেরা। এমনকি একাডেমির ছেলেরা আলো ছড়াচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়েও।