
ছবি: সংগৃহীত
শেষ হয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের ২০২২-২৩ ঘরোয়া মৌসুম। গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে স্বাধীনতা কাপ দিয়ে যা মাঠে গড়িয়েছিল। পরে ফেডারেশন কাপ আর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ফুটবল চলেছে যুগপৎভাবে। এবারেই প্রথম ফেডারেশন কাপ টুর্নামেন্টের খেলা টানা আয়োজন করা হয়নি। বরং ইউরোপের অনুসরণে লিগের মাঝে খেলা হয় ফেডারেশন কাপের।
বিপিএল শিরোপা জয়ে অনন্য মাইলফলক সৃষ্টি করেছে বসুন্ধরা কিংস। প্রথম দল হিসেবে টানা চারবার পেশাদার লিগের শিরোপা জিতেছে কর্পোরেট দলটি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা লিগে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের রেকর্ড আছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আর আবাহনী ক্রীড়া চক্রের। ঢাকা আবাহনী পেশাদার লিগেও হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতেছে। শুধু পেশাদার লিগ না, বসুন্ধরা জিতেছে স্বাধীনতা কাপ। আর ফেডারেশন কাপ গেছে মোহামেডানের ঘরে। ২০০৯ সালের পর প্রথম ফেডারেশন কাপ ঘরে তুলেছে মোহামেডান। তবে সদ্য শেষ হওয়া ফুটবল মৌসুম জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু প্রশ্নের। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে আমাদের স্ট্রাইকার সংকট। একটা সময় বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরোয়া আসরগুলোয় সেরা গোলদাতা হয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন, মেজর হাফিজউদ্দিন, এনায়েত, সালাম মুর্শেদিরা। শেখ মোহাম্মদ আসলাম আর ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব তো ঢাকা লিগে টানা চারবার করে সেরা গোলদাতা হয়েছেন। ১৯৮২ সালে মোহামেডানের জার্সিতে সালামের ২৭ গোল এখনো এক ঘরোয়া মৌসুমে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
পেশাদার ফুটবল লিগ প্রবর্তনের পূর্বে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ ছিল দেশের সর্বোচ্চ আসর। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে ইরানের ভিজেন তাহিরি প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে জেতেন ঢাকা লিগের ‘গোল্ডেন বুট’। পরে আজমত রহিমভ, আন্দ্রে কাজাকভ, ওলেগ জিভৎনিকভরা সেরা গোলদাতা হয়েছেন। কিন্তু বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে পারেননি দেশীয় স্ট্রাইকারদের। ২০০৭ সাল থেকে পেশাদার লিগ চালুর পর থেকে দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র। এখন পর্যন্ত ১৪টি পেশাদার লিগে ১৩ বার সেরা গোলদাতা হয়েছেন বিদেশিরা। শুধু ২০০৯-১০ মৌসুমে ঢাকা আবাহনীর এনামুল হক ২১ গোল করে পেয়েছিলেন ‘গোল্ডেন বুট’। পরবর্তী আসরগুলোতে বিদেশিদের একচেটিয়া দাপট।
২০২২-২৩ মৌসুমের পেশাদার লিগে ২০ গোল করে বসুন্ধরার ব্রাজিলিয়ান ডরিয়েল্টন গোমেজ সবার ওপরে। এ তালিকায় বাংলাদেশিদের খুঁজে পাওয়া যাবে না অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ গোল বসুন্ধরার এলিটা কিংসলের। তিনিও নাইজেরিয়ান থেকে বাংলাদেশি হয়েছেন। ইকবাল হোসেন, নাবিব নেওয়াজ জীবন, ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, রাকিব হোসেন আর সাখাওয়াত রনিরা চার থেকে পাঁচ গোলে শেষ করেছেন মৌসুম। এদের মধ্যে জীবন ছাড়া কেউ আবার স্ট্রাইকার না। ফরোয়ার্ড পজিশনের মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সুমন রেজা আর আমিনুর রহমান সজীবদের নাম স্কোরশিটে কালেভদ্রে উঠেছে দুই-একবার। স্বাধীনতা কাপেও ৯ গোল করে সেরা গোলদাতা ছিলেন ডরিয়েল্টন। ফেডারেশন কাপে আট গোল করে সেরা গোলদাতা হয়েছেন মোহামেডানের সোলেমান দিয়াবাতে।
স্ট্রাইকার সংকটের মধ্যেই অন্যান্য পজিশনে শেখ মোরসালিন, রাকিব হোসেন, তারিক কাজী, আহসান হাবীব বিপু, আনিসুর রহমান জিকো, আলমগীর মোল্লা, জাফর ইকবাল, সোহেল রানা, রহমত মিয়া, জামাল ভূঁইয়া, শাহরিয়ার ইমনরা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে সবার নজর কেড়েছেন। রাকিব ছিলেন স্বাধীনতা কাপের সেরা খেলোয়াড়। তবে দেশের প্রতিটা ক্লাবের আক্রমণভাগ বিদেশি-নির্ভর। যে কারণে মোরসালিনের মতো তরুণরা পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার সুযোগ পান না। বর্তমানে প্রতি ম্যাচে একটি দল চারজন বিদেশি খেলোয়াড় মাঠে নামাতে পারে। দেশি খেলোয়াড়দের সুবিধার্থে অনেকেই ম্যাচপ্রতি বিদেশি খেলোয়াড় সংখ্যা কমিয়ে আনার পক্ষে কথা বলছেন।
একটা সময় বাংলাদশের ঘরোয়া ফুটবল নিম্নমানের বিদেশিতে সয়লাব হয়েছিল। বর্তমানে সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন কোস্টারিকার হয়ে বিশ্বকাপে খেলা ড্যানিয়েল কলিন্দ্রেস কিংবা আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা হার্নান বার্কোসরা বাংলাদেশে আসছেন। ডরিয়েল্টন, রবসন রবিনহো কিংবা দিয়াবাতের মতো উঁচুমানের বিদেশিরা বিপিএলের অংশ হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা উপকৃত হচ্ছেন, সন্দেহ নেই। তবে ম্যাচপ্রতি তিনজন বিদেশি খেলোয়াড়ের পক্ষে মত দিচ্ছেন সাবেক খেলোয়াড়রা। অথচ শোনা যাচ্ছে, আগামী মৌসুমে প্রতিটা ক্লাব ছয়জন বিদেশি ফুটবলার রেজিস্ট্রেশন করাতে পারবে। যার মধ্যে পাঁচজন যে কোনো দেশের আর একজন এশিয়ান খেলোয়াড়। এমন হলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের স্থান আরও সংকুচিত হবে।
২০২২-২৩ ফুটবল মৌসুম সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে। বিশেষ করে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে মোহামেডান বনাম আবাহনীর লড়াই সাড়া ফেলেছিল দেশজুড়ে। যা প্রমাণ করে দেশের ফুটবল থেকে মানুষ পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। আগামীতে সঠিক পরিকল্পনা আর গোছানো আয়োজনে বাফুফে দর্শকদের করতে পারে মাঠমুখী। সেই স্বপ্ন দেখিয়ে গেছে ২০২২-২৩ ফুটবল মৌসুম।