
জার্মানিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে উচ্ছ্বাস জাপানি ফুটবলারদের। ছবি: সংগৃহীত
ফুটবলের ওপর ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকার শাসন চিরকালীন। প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজিত ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে শিরোপা জিতবে ইউরোপ কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশ, এই নিয়মের ব্যত্যয় কখনো ঘটেনি। নিকট ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনাও নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার প্রতিনিধি জাপান রীতিমতো চমক দেখাচ্ছে। জাপানের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে জার্মানি, স্পেনের মতো পরাশক্তিরা। বলা যায়, জাপান হয়ে উঠছে ফুটবল বিশ্বের নতুন আতঙ্ক। কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল থেকেই দুর্দান্ত ছন্দে জাপান। ‘ব্লু সামুরাই’ নামে পরিচিত দলটির কাছে গ্রুপ পর্বে হার মানে জার্মানি আর স্পেন । নক আউট পর্বে জাপান দারুণ লড়াই করেও টাইব্রেকারে হেরে যায় ক্রোয়েশিয়ার কাছে। ২০২৩ সালে জাপান যেন অপ্রতিরোধ্য। ইতোমধ্যে ৭ ম্যাচের মধ্যে ড্র আর হার একটি করে। জুন থেকে টানা ৫ ম্যাচে বিধ্বংসী জয় পেয়েছে ব্লু সামুরাইরা। যেখানে ৫ ম্যাচে তাদের গোলের সংখ্যা ২২টি। জুন থেকে টানা পাঁচ জয়ের শুরুটা উত্তর আমেরিকার এল সালভেদরকে ৬-০ গোলে হারিয়ে। পরে পেরু, জার্মানি, তুরস্ক আর কানাডাকে চারটি করে গোল দিয়েছে ব্লু সামুরাইরা।
২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সঙ্গে ফিফা বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক কানাডা। ২০২২-২৩ মৌসুমের কনকাকাফ নেশন্স লিগ ফাইনালে খেলেছে কানাডা। কিন্তু জাপানের কাছে পাত্তা পায়নি আগামী বিশ্বকাপের স্বাগতিকরা। সেপ্টেম্বরে জার্মানির ভলভবার্গ স্টেডিয়ামে জাপান নাস্তানাবুদ করেছে স্বাগতিকদের। জার্মানিকে উড়িয়ে দিয়েছে ৪-১ গোলে। বিশ্বকাপসহ টানা দুই ম্যাচে জার্মানিকে হারিয়ে জাপান প্রমাণ করেছে, বিশ্ব ফুটবলের কোনো পরাশক্তি তাদের কাছে নিরাপদ নয়। আর যে তুরস্ক ইউরো বাছাইয়ে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে গ্রুপের শীর্ষে অবস্থান করছে তাদেরও হারিয়েছে জাপান।
টানা সাফল্যে জাপান বর্তমানে ফিফা র্যাংকিংয়ের ১৯তম অবস্থানে রয়েছে। যা এশিয়ার সর্বোচ্চ। তবে ১৯৯৮ সালের মার্চে ফিফা র্যাংকিংয়ে রেকর্ড নবম স্থানে ওঠার রেকর্ড জাপানের রয়েছে, যা এশিয়ার অন্য কোনো দেশের নেই। বর্তমানে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা জাপান নভেম্বর থেকে মাঠে নামছে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। জানুয়ারিতে রয়েছে এএফসি এশিয়া কাপ। ধারাবাহিক সাফল্য পেলে নিকট ভবিষ্যতে জাপানের ফিফা র্যাংকিংয়ের শীর্ষ দশে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব, যা হবে এশিয়ার জন্য গর্বের। জাপানের ফুটবল উন্নতি খুব বেশিদিনের ঘটনা নয়। শুরুটা ৯০-এর দশকে জে-লিগের হাত ধরে। জিকো, মাইকেল লাউড্রপ, ফ্রেড্রিক লিওনবার্গ, রিস্টো স্টয়চকভ, দুঙ্গা, লুকাস পোডোলস্কিসহ বিশ্বতারকাদের আগমনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে জাপানের ঘরোয়া ফুটবল। সঙ্গে পেশাদার ফুটবলে বাধ্যতামূলক একাডেমি দলের পরিচালনায় উঠে আসে হিদোতিশি নাকাতা, সুনসুকে নাকামুরা, মুকাতো হাসেবে আর কেইশিকি হোন্ডার মতো দুর্ধর্ষ ফুটবলার। তাদের সহায়তায় জাপান ১৯৯৮ সালে প্রথম পা রাখে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে। সেই থেকে কখনো বাদ পড়েনি ফিফা আয়োজিত সর্বোচ্চ আসর থেকে। টানা সাতবার বিশ্বকাপ অংশগ্রহণে জাপান তিনবার খেলেছে নক আউট পর্বে। প্রতিটা আসরে জাপান পেয়েছে ফুটবল বোদ্ধাদের প্রশংসা।
বর্তমানে জাপান ফুটবল দলের কোচ হাজিমে মোরিয়াসু। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে তার অধীনে ৬৯ ম্যাচের ৪৬টি জিতেছে ব্লু সামুরাইরা। পরাজয় ১০ ম্যাচে, ড্র ১৩টি। জাপানের খেলার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য আক্রমণাত্মক ফুটবল। যা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের বিপক্ষে নক আউট পর্বে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল জাপান। কিন্তু সেই সময়েও তারা চড়াও হয়ে খেলেছে বেলজিয়ামের ওপর। কাউন্টার অ্যাটাকে তিনটি গোলে ম্যাচ জিতে নেয় বেলজিয়াম। সেই ম্যাচে একটু রয়েসয়ে খেললে জাপান কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যেত। যদিও জাপানের স্বভাব ‘রয়েসয়ে’ খেলা নয়। আক্রমণে তেড়েফুঁড়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করাই তাদের লক্ষ্য। যা অনেক সময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে জাপানের ছোট পাসের আক্রমাত্মক ফুটবলের সঙ্গে ল্যাটিনের মিল খুঁজে পান অনেকেই। সঙ্গে ইউরোপিয়ান দ্রুতগতির মিশেলে জাপানের ফুটবল অনিন্দ্য-সুন্দর। প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনকও বটে।
জাপানের বর্তমান তারকাদের মধ্যে তাকেফুসা কোবে, কেইতো নাকামুরা, তাকুমি মিনামিরো আর অধিনায়ক ওয়াতারু ওন্ডোরা মাতাচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন লিগ। খেলছেন স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ আসরে। দেশের হয়েও দিচ্ছেন নিজেদের সেরাটা। তাতে অচিরেই জাপানের পক্ষে ফুটবলের পরাশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। যা এশিয়ার ফুটবলের জন্য সুখবর বটে।