কিশোর মুক্তিযোদ্ধা থেকে জাতীয় দলের ফুটবলার মনি

আহসান হাবীব সুমন
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৪, ১৫:৪৬

মজিদুল ইসলাম মনি। ফাইল ছবি
মো. মজিদুল ইসলাম মনি। জেলা পর্যায়ে মাতিয়েছেন হকির মাঠ। ছিলেন আন্তঃজেলা অ্যাথলেটিক্সের ১০০ এবং ২০০ মিটার স্প্রিন্ট চ্যাম্পিয়ন। তবে ফুটবলার হিসেবেই পেয়েছেন সর্বোচ্চ সাফল্য। ফুটবলের সোনাল সময়ে খেলেছেন মোহামেডান, আবাহনী আর ব্রাদার্সের মতো দেশের শীর্ষ ক্লাবে। দীর্ঘ পাঁচ বছর বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
সাবেক ফুটবলার মনি একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে অংশ নেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। পাক হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চের গণহত্যার পরেই পুরো দেশ হয়ে উঠেছিল অগ্নিকুণ্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র প্রতিরোধ। পাক-বাহিনী নৃশংস আক্রমণে মনির জন্মস্থান পাবনা শহরও ততদিনে আক্রান্ত। সেই সময় তিনি পাবনা জেলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতি বুঝতেন না। কিন্তু দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানিদের দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার তাগিদ ঠিক অনুভব করেছিলেন। কিশোর মনি সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের।
মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পণ নিয়ে মনি প্রথমবার ভারত গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। কিন্তু হুট করে কোনো খোঁজ-খবর না নিয়ে চলে যাওয়া মনি পাননি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পের সন্ধান। তাই ব্যর্থ মনোরথে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ফের মে মাসে ফের পাড়ি জমান ভারতে। চার দিন পায়ে হেঁটে পেরিয়েছিলেন কুষ্টিয়া সীমান্ত। দ্বিতীয় দফায় সফল হন দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ মনি। নদীয়া জেলার করিমপুরের কচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানেই নেন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ট্রেনিং। ক্যাম্পে সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মনি। জুনে দেশে ফিরে মনি যুদ্ধ করেছেন ৭ নম্বর সেক্টরে। অংশ নিয়েছেন বিপজ্জনক সব অপারেশনে। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের দিনে ছিলেন পাবনা শহরেই।
যুদ্ধ শেষে মনি পাবনা জেলা স্কুল থেকে পাস করেন মাধ্যমিক পরীক্ষা। আর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন পাবনারই বুলবুল কলেজ থেকে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। খেলাধুলায় পারঙ্গম মনি স্কুল জীবনেই অংশ নেন পাবনার স্থানীয় ফুটবল লিগে। পাবনা জেলার হয়ে খেলেছেন জাতীয় ফুটবল লিগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের নিয়মিত সদস্য হিসেবে দুবার জিতেছেন শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ।
ঢাকার ফুটবলে মনি প্রথম অনুশীলনের সুযোগ পান অধুনা বিলুপ্ত অফিস দল ওয়াপদায়। তবে ১৯৭৬ সালে তার অভিষেক হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সিতে। পরে ব্রাদার্স ইউনিয়ন হয়ে ১৯৮১ সালে যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। তত দিনে ফুটবলার হিসেবে নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সময় দেশের অন্যতম সেরা ‘স্টপার-ব্যাক’ হিসেবে মনিকে চিনেছে মানুষ। আবাহনীতে তিন মৌসুম খেলা মনি সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু আর গাফফারদের মতো ফুটবলার। আবাহনীর হয়ে তিনটি ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগ জিতেছেন। ব্রাদার্স আর আবাহনীর হয়ে জিতেছেন ফেডারেশন কাপ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার দুটি ফেডারেশন কাপ শিরোপাই ভাগাভাগি করতে হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে। ১৯৮৪ সালে মনি খেলেছেন মোহামেডানের সাদা-কালো জার্সিতেও। চাকরির সুবাদে খেলেছেন চট্টগ্রাম লিগে কাস্টমসের হয়ে। সেই সময় ঢাকা এসে কিছু ম্যাচ খেলেছেন পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির পক্ষে।
জাতীয় দলে মনির অভিষেক ১৯৮১ সালে। যুব দলের হয়ে এশিয়ান যুব চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ খেলেছেন ঢাকা আর থাইল্যান্ডে। এ ছাড়া জাতীয় দলের হয়ে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে মনির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। মনির মতো কিশোর বয়সে দীর্ঘ ৯ মাস রণাঙ্গনে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়া ফুটবলার বাংলাদেশের জাতীয় দলে বিরল। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলার মনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কার পাননি! যদিও স্বীকৃতি না পাওয়ায় কোনো আক্ষেপ নেই তার। বলেছেন, যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। দেশ তখন পাক-হানাদার বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারে বিপর্যস্ত। মনে একটাই চিন্তা ছিল, মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হবে। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব, নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু তখন সেই চিন্তার সুযোগ কোথায়? বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়াশোনা, ফুটবল আর পেশাগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
রাষ্ট্র থেকে স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্ট নেই? মিষ্টভাষী মনি জানালেন, নেই। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় আমরা প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সংগীত গাইতাম। অস্ত্র হাতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। জাতীয় ফুটবল দলে খেলার সময় জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীতে হৃদয় উদ্বেলিত হয়েছে। সে সব কথা মনে হলে এখনো শিহরণ জাগে। আমি তো বরং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। মাতৃভূমির জন্য কিছু হলেও অবদান রাখতে পেরেছি। এটাই যথেষ্ট। আর পুরস্কারের কথা যদি বলেন, আমি সত্যি জানি না পুরস্কার অর্জনের মাপকাঠি কী!