
মোহাম্মদ রফিক। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা এনে দেওয়া ক্রিকেটারদের অন্যতম মোহাম্মদ রফিক। এ দেশের ক্রিকেটে অনেক ‘প্রথমের’ সাক্ষী ও অর্জনকারী তিনি। আইসিসি ট্রফি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে কিংবা প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয়েও তার রয়েছে অনন্য ভূমিকা।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ বিমানের হয়ে রফিকের পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু। শুরুতে ছিলেন বাঁ-হাতি মিডিয়াম পেসার। কিন্তু পাকিস্তানি ওয়াসিম হায়দারের পরামর্শে স্লো অর্থোডক্স স্পিন বোলার হিসেবে তার রূপান্তর। ভাগ্যিস পরামর্শ শুনেছিলেন রফিক!
১৯৯৫ সালে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে রফিকের আন্তর্জাতিক অভিষেক ম্যাচে ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারকে সরাসরি বোল্ড করে একমাত্র উইকেটটি নিয়েছিলেন রফিক। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার টিকিট। সেই টুর্নামেন্টে রফিক ছিলেন অনবদ্য। নেন ৯ ম্যাচে ১০.৬৮ গড়ে ১৯ উইকেট। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নেন ২৫ রানে ৪ উইকেট। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে করেন ২৫ বলে মহামূল্যবান ২৬ রান।
বাংলাদেশের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের নায়ক রফিক। ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ওপেনার হিসেবে খেলতে নেমে করেন ৮৭ বলে ৭৭ রান। আতহার আলী খানের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটিতে যোগ করেন ১৩৬ রান। বল হাতে নেন দুই উইকেট। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতকে বিদায় করেছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে রফিক নেন সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড় আর মহেন্দ্র সিং ধোনির উইকেট।
মোহাম্মদ রফিক বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন ৩৩ টেস্ট আর ১২৫ ওয়ানডে। টেস্ট ক্রিকেটে পেয়েছেন পুরো ১০০ উইকেট। আর তার ওয়ানডে উইকেটের সংখ্যা ১২৫টি। টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ১৬৩০ আর ওয়ানডেতে ১৬৬৩ রান আসে রফিকের ব্যাট থেকে। তিনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ১০০ উইকেট আর হাজার রানের মাইলফলক গড়া ক্রিকেটার। যাকে বলে তুখোড় অলরাউন্ডার, রফিক ছিলেন তাই।
২০০৫ সালের শুরুতেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে রফিক ব্যাট হাতে ৬৯ রান করেন। হাত ঘুরিয়ে পান পাঁচ উইকেট।
তিনি এমন একটা সময়ে টেস্ট খেলেছেন, যখন বাংলাদেশ প্রায় সময় দ্বিতীয় ইনিংসে বলই করতে পারেননি। অথচ দ্বিতীয় ইনিংসেই উইকেট কব্জা করে বেশির ভাগ স্পিনার! যেমন-২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে অল্পের জন্য ১০ উইকেট পাওয়া হয়নি রফিকের। প্রথম পাঁচ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে চারটি উইকেট শিকার করেন এই বাঁহাতি স্পিনার।
মোহাম্মদ রফিক বল কিংবা ব্যাট হাতে ছিলেন আগ্রাসী। বাংলাদেশের ‘পিঞ্চ হিটিং’ ব্যাটিংয়ের প্রথম নজির তিনি। তাই তো রফিকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মের আগেই আমি কিন্তু টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং করেছি।’
মোহাম্মদ রফিক মানবিক ক্রিকেটারও। ঐতিহাসিক মুলতান টেস্টে উমর গুলকে নিশ্চিত ‘মানকাট’ আউট না করে মহানুভবতার পরিচয় দেন। বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায়। পরে রফিককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তার সরল ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আউটটা করলে আমরা জিতে যেতাম ঠিক; কিন্তু মানুষ আমাদের ছোটলোক ভাবত। আমরা ছোট লোক নই।’
১৯৭০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে জন্ম নেওয়া রফিক মানুষ হিসেবেও মানবিক সত্তার অধিকারী। আইসিসি ট্রফি জয়ের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া জমি তিনি দান করেন স্কুল গড়ায়। কারণ তিনি নিজে পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি। এ ছাড়া নিজের পৈতৃক জমি তিনি দান করে দিয়েছিলেন চক্ষু হাসপাতালে তৈরিতে। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার চাওয়া ছিল, ‘নিজের জন্মস্থান বুড়িগঙ্গার কাছে বাবু বাজারে একটা ব্রিজ’, যাতে মানুষের যাতায়াতে সুবিধা হয়!’
তিনি নিঃসন্দেহে একজন কিংবদন্তি। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে রফিকের ক্যারিয়ার বিচার করা যাবে না। তার সময়ে বাংলাদেশ ওয়ানডে হোক কিংবা টেস্ট খেলারই নিয়মিত সুযোগ পায়নি। কিন্তু সেই অনিয়মিত সুযোগেই রফিকদের হাত ধরে লেখা হয়েছে ক্রিকেটের ভাগ্যলিপি। তাই ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো রফিক এখনো আছেন বাংলাদেশের মানুষের মনে, মননে। চিরদিন থাকবেন শ্রদ্ধার আসনে।