Logo
×

Follow Us

খেলাধুলা

শামীম ওসমানের দুর্নীতিতে বদলে যায় ফতুল্লা স্টেডিয়ামের নাম

Icon

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৩১

শামীম ওসমানের দুর্নীতিতে বদলে যায় ফতুল্লা স্টেডিয়ামের নাম

বছরের পর বছর ফতুল্লা স্টেডিয়াম ছিলো ওসমান পরিবারের টাকার গাছ। ছবি: সংগৃহীত

ফতুল্লা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত স্টেডিয়ামের প্রকল্পটির শুরুতে নাম ছিলো ওসমানী স্টেডিয়াম-২। ১৯৯১-১৯৯৫ সালের বিএনপি আমলে অর্থবরাদ্দ করে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। কিন্তু ’৯৬ এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই শামীম ওসমান তার প্রভাব খাটিয়ে স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে তার দাদা ‘খান সাহেব ওসমান আলী’র নামে নামকরণ করেন। 

শুরুতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের চাইতে দুই ফুট বেশি উচ্চতায় স্টেডিয়ামের মাঠ হওয়ার কথা থাকলেও স্টেডিয়ামে গড়ে ছয় ফুট কম বালি ভরাট করে সে টাকা আত্মসাৎ করেন শামীম ওসমান। এরপর বছরের পর বছর এ স্টেডিয়াম ছিলো ওসমান পরিবারের টাকার গাছ।  

নারায়ণগঞ্জ নগরীর ইসদাইরে অবস্থিত ওসমানী স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের একটি অংশ দখল করে শামীম ওসমান তৈরী করেছেন এ কে এম শামসুজ্জোহা ক্রীড়া কমপ্লেক্স। সেখানেও রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। 

ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অফিস। ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো কয়েকজন খেলোয়ার, সংগঠক বসে গল্প করছেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে শামীম ওসমান ও তার সিন্ডিকেটের নানা দুর্নীতির তথ্য দিলেও নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননা তারা। কারণ, শামীম ওসমান না থাকলেও তাদের লোকজন মিশে গেছে বিএনপি’র সাথে। এমনকি সে সিন্ডিকেটের একজন ক্রিকেটার আবার দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নেতা। 

নাম প্রকাশ না করে তারা জানালেন, ১৯৮৭ সালে ইসদাইরে সিটি কর্পোরেশনের দেয়া ৮ দশমিক ৬৪ একর জায়গায় ওসমানী স্টেডিয়াম হয়। কিন্তু এ স্টেডিয়ামে একটি পূর্নাঙ্গ ফুটবল বা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাঠ তৈরি করা সম্ভব না জায়গার স্বল্পতার কারণে। অথচ জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে ৫৫টি খেলা রয়েছে। তাই একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স করার দাবি উঠেছিলো। এ দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে ইসদাইরে ওসমানী স্টেডিয়ামের পাশে জমি হস্তগত করার উদ্যোগ নেয় সে সময়ের বিএনপি সরকার। এজন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। 

কিন্তু ক্রীড়া সংগঠক কুতুব উদ্দিন আকসির সে সময়ের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের জানান, জমি হস্তগত করতে গেলে ১৬টি বসত বাড়ি উচ্ছেদ করতে হবে। যাতে সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হতে পারে। এছাড়া স্টেডিয়ামের ভেতর দিয়ে এলাকাবাসীর একটি রাস্তা রয়েছে যেটি বন্ধ না করলে স্টেডিয়ামের জন্য হস্তগত জায়গা কোনো কাজে আসবে না। আর বিকল্প রাস্তা তৈরী করে দিতে গেলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বিকল্প স্থানে স্টেডিয়াম করার প্রস্তাব দেন।

পরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার রামারবাগে স্টেডিয়াম করার প্রস্তাব দেয়। সে অনুযায়ী রামারবাগে ২৭ একর জমি হস্তগত করা হয়।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে বরাদ্দ হয় ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। টাকা বরাদ্দ হলেও স্টেডিয়ামের কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদার। ঠিকাদার কাজ করতে এলে শামীম ওসমানের ক্যাডাররা ককটেল ফাটিয়ে ধাওয়া করে ঠিকাদারকে।

পরে ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি দে এই স্টেডিয়ামের কাজের ঠিকাদারি পান। সাবকন্ট্রাক্ট দেন সে সময় প্রথমবার এমপি হওয়া শামীম ওসমানকে।

টেন্ডার অনুযায়ী গড়ে জায়গাটিতে বারো ফুট বালি ফেলার কথা থাকলেও তারা গড়ে ছয় ফুট বালি ফেলেন। গড়ে ছয় স্কয়ার ফুট বালি না ফেলেই তারা বিল উত্তোলন করেন।

এ টাকা উত্তোলনের সুবিধার্থে তারা স্টেডিয়ামকে মূল ডিজাইন উপেক্ষা করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে আরো পশ্চিমে সরিয়ে নেন। কারণ স্টেডিয়ামের জন্য নির্ধারিত জায়গার রাস্তার পাশের অংশে পনেরো ফুটেরও বেশি গভীর ছিলো। অন্যদিকে পশ্চিম দিক আগে থেকেই ভরাট ছিলো। পশ্চিম দিক ছিলো ‘তক্কার মাঠ’ এর অংশ। যেখানে আগেই স্থানীয় খেলা হতো। 

স্টেডিয়াম তৈরীর সময় তিন ধাপে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু প্রথম ধাপে ব্যাপক দুর্নীতির কারনে পরের দুই ধাপের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করা হয়। প্রতিবছর স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য টাকা আসলেও সে টাকা ব্যবহার না করে বিল করে টাকা খেয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। ফলে দিনে দিনে জরাজীর্ণ হতে থাকে স্টেডিয়াম।

এক পর্যায়ে স্টেডিয়ামটি ব্যাপক জলাবদ্ধতায় পড়ে যায়। অথচ স্টেডিয়ামের পাশে কালভার্ট নির্মাণের জন্য দুইবার টাকা আসলেও কাজ না করেই সে টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বশেষ স্টেডিয়ামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সামান্য বালি ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজই হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম ওসমানী স্টেডিয়ামের মাঠ সাইট কমিটির সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সদস্য ছিলেন।

তিনি বলেন, মতিন চৌধুরী স্বরাস্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন তার ও সোনারগাঁয়ের সাবেক এমপি রেজাউল করিমের সহযোগিতায় সেসময়ের ক্রীড়া মন্ত্রী ফজলুর রহমান ‘ওসমানী স্টেডিয়াম’ নামে ফতুল্লা স্টেডিয়ামটি নারায়ণগঞ্জের জন্য বরাদ্দ দেন। তিনি বলেন, শুরুতে স্টেডিয়ামের বালি ফেলার জন্য বরাদ্দ করা টাকার অর্ধেকই বালি না ফেলে শামীম ওসমান, মৃণাল কান্তিসাহা মেরে দেয়। তখন ঠিকমতো বালি ফেললে এখন আবার জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন করে বালি ফেলতে হতো না।

মাসুম আরও বলেন, গত পনেরো বছর আর সর্বশেষ ত্রিশ কোটি টাকার বরাদ্দের বেশিরভাগ অংশ শামীম ওসমান, তার শ্যালক তানভীর আহাম্মেদ টিটুসহ শামীম ওসমানের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট লুটপাট করে খেয়েছে। স্টেডিয়ামটি তাদের টাকার গাছে পরিণত হয়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।  

ফতুল্লা থানা বিএনপি’র সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু জানান, শুরুতে স্টেডিয়ামটি ওসমানী স্টেডিয়াম-২ নামে শুরু করা হয়। কিন্তু পরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পরেই আমরা দেখি সেখানে ‘খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম’ নামে একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এক পর্যায়ে এটি এ নামে রেজিস্ট্রেশন করে নাম ছিনতাই করা হয়। লক্ষ করবেন মানুষ এটিকে ‘খান সাহেব ওসমান আলী’ স্টেডিয়াম বলে না। বলে ফতুল্লা স্টেডিয়াম। খুনি ওসমান পরিবারের প্রতি ঘৃণা থেকে মানুষ এটাকে ‘খান সাহেব ওসমান আলী’ স্টেডিয়াম না বলে ফতুল্লা স্টেডিয়াম বলে। তিনি পুরোনো নাম ফিরিয়ে আনার দাবী জানান।

এ প্রসঙ্গে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মোস্তফা কাওসার বলেন, একাত্তর সালে জাতির সাথে যারা বেঈমানী করেছে তারা ‘রাজাকার’। আর ব্রিটিশ আমলে যারা এদেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করে ব্রিটিশদের তাবেদারি করেছে তাদের ব্রিটিশ সরকার খান সাহেব, খান বাহাদুর, মিয়া সাহেব, রায় বাহাদুর উপাধি দিয়েছে। ব্রিটিশদের তোষণ করা এক ব্যাক্তির নামে স্বাধীন বাংলাদেশের স্টেডিয়ামের নামকরণ হয় কিভাবে?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫