Logo
×

Follow Us

খেলাধুলা

প্রতিবাদের ভাষা যখন ফুটবল ম্যাচ

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬

প্রতিবাদের ভাষা যখন ফুটবল ম্যাচ

পান্থকুঞ্জ পার্কে ফুটবল ম্যাচ। ছবি: সংগৃহীত

২০ ডিসেম্বর, সকাল ১০টার পর থেকেই দু-একজন করে লোক আসতে থাকে, নানা বয়সের। বেলা ১১টার মধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর-তরুণ। উদ্দেশ্য ফুটবল খেলা। তবে এই খেলার উদ্দেশ্য শরীরচর্চা কিংবা কোনো প্রতিযোগিতা নয়, বরং প্রতিবাদ।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারসংলগ্ন সার্ক ফোয়ারার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ‘পান্থকুঞ্জ’ নামে পরিচিত পার্কের ‘দখলীকৃত’ জায়গায় এই প্রতিবাদী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। তারা এটিকে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ বললেও মূলত এই আয়োজন পরিণত হয় প্রতিবাদ সমাবেশে।

পান্থকুঞ্জ পার্কের অবস্থান রাজধানীর এমন একটি জায়গায়, যার পুবদিকে প্যানপ্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও, পশ্চিমে হোটেল সুন্দরবন, উত্তরে সার্ক ফোয়ারা এবং উত্তর-পশ্চিমে বসুন্ধরা শপিং মল। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পান্থপথের প্রবেশমুখে হওয়া এই পার্কটির নাম রাখা হয় ‘পান্থকুঞ্জ’। আবার শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় ‘পান্থকুঞ্জ’ মানে পথিকের ঘর।

ত্রিভুজ আকৃতির এই পার্কটি একসময় সত্যিই ব্যস্ত নগরীর ক্লান্ত মানুষের একটি বড় আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। অনেক গাছপালা, তার ফাঁকে হাঁটার জায়গা, ছোট লেক। সব মিলিয়ে কংক্রিটের বস্তির ভেতরে পান্থকুঞ্জ ছিল একটি মরূদ্যানের মতো। ভোরে ও সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখানে আসত  হাঁটার জন্য। তপ্ত দুপুরে গাছের সবুজ ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিত পথচারীরা।

বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু ধীরে ধীরে পার্কটি অরক্ষিত হতে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে এটি পরিণত হয় মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও হিজড়াদের অভয়ারণ্যে। রাতে বাংলামোটর মোড় থেকে পার্কের পাশের ফুটপাত দিয়ে সার্ক ফোয়ারার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অসংখ্য মানুষ ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছে। রহস্যজনক কারণে ওই জায়গাটিতে পর্যাপ্ত আলোও থাকত না। রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম একটি সড়কের পাশের ফুটপাতে এ রকম অন্ধকার ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে নাগরিকের মনে অনেক প্রশ্ন আছে।

কিন্তু সেই প্রশ্নের সুরাহা করে পার্ক ও পার্কের আশপাশের পরিবেশ সুন্দর ও নিরাপদ করার আগেই এটি চলে যায় এলিভেটেডেট এক্সপ্রেসওয়ের দখলে। দীর্ঘদিন ধরে এক্সপ্রেসওয়ের সরঞ্জাম স্তূপ করে রাখা এবং এর ভেতরে নানা রকম নির্মাণকাজ করায় পান্থকুঞ্জ এখন ‘প্রবেশনিষিদ্ধ’ স্থান। প্রবেশ করেও লাভ নেই। কেননা ভেতরে হাঁটার কোনো জায়গা নেই। অজস্র গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

পান্থকুঞ্জ পার্কটি নষ্ট হওয়া শুরু করে ২০১৮ সালে। তখন ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ (ডিএসসিসি) ‘জলসবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় এর জন্য ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সে সময় বলা হয়েছিল, এক বছরের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ হলে পার্কটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার মাটি খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়া পার্কটিতে তেমন কোনো কাজ করেননি। পরে মেট্রো রেলের নির্মাণকাজ চলার সময় পার্কের বড় অংশে অনেক নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়। একসময় পার্কটির চারপাশ টিন দিয়ে ঘেরাও করে দেওয়া হয়, যাতে ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। মেট্রো রেলের নির্মাণকাজ ও এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়কের কারণে পার্কের ডিজাইন নতুন করে করা হয়। কিন্তু পার্কটি আর তার আগের চেহারায় ফেরেনি। বরং এখন এখানে গেলে বোঝাই যায় না যে এটি একসময় একটি সুন্দর পার্ক ছিল।

মূলত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত অংশ নির্মাণের থাবায় ধ্বংস হয়েছে পান্থকুঞ্জ। এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‍্যাম্প পান্থকুঞ্জ পার্কের বুক চিরে কারওয়ান বাজার গোলচত্বরের দিকে নামানোর পরিকল্পনা চলছে। সংযোগ সড়কটি পান্থকুঞ্জ পার্ক হয়ে পলাশী পর্যন্ত যাবে। এ কারণে এরই মধ্যে পার্কের নানা বয়সী বেশির ভাগ গাছ কাটা হয়েছে। তবে শুধু পান্থকুঞ্জই নয়, বরং সংলগ্ন হাতিরঝিল লেকেরও একটি বড় অংশ ভরাট হয়েছে এই এক্সপ্রেসওয়ের পিলার বসাতে গিয়ে, যা পরিবেশ ও জলাধারসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অভিযোগ আছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি শুরু থেকেই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এটি পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন ও জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান পরিবেশ, জলাধার কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নীতি ও আইন লঙ্ঘন করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট করে এর শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। 

প্রকল্পের অধীনে কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের যে উদ্যোগ, তা হাতিরঝিলের মতো এই অঞ্চলে টিকে থাকা সংবেদনশীল জলাশয়ের মারাত্মক ক্ষতি করবে। প্রকল্পের ৪১টি পিলারে হাতিরঝিলের পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশ কিছু পিলার বসানোর জন্য বালু-মাটি দিয়ে হাতিরঝিল ভরাট করা হয়েছে। এতে ঝিলের সৌন্দর্য, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

শুক্রবার পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতরে প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিতে আসা পরিবেশকর্মীরা বলেন, শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে না। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হবে। তারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিরঝিল ভরাট বন্ধ করা এবং স্থাপিত পিলারগুলো সরিয়ে নিয়ে জলাধারের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের দাবি জানান। এ ছাড়া পান্থকুঞ্জ পার্কে গাছ কাটা বন্ধ করে পার্কের আয়তন ও সীমানা অনুযায়ী ঋতুগত ভিন্নতাকে বিবেচনায় রেখে দেশি প্রজাতির গাছ লাগানোরও দাবি জানান। শুধু তাই নয়, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরের পরিবেশ সুরক্ষায় হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ পার্কের মতো দুটি জায়গা ধ্বংস করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাকারী, নকশাকারী এবং বাস্তবায়নকারীদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানান।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫