
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ছবি: সংগৃহীত
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ১৯ ফেব্রুয়ারি মাঠে গড়িয়েছে। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা আট দল নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্টির মূল আয়োজক পাকিস্তান। তবে রাজনৈতিক বৈরিতায় পাকিস্তানের মাটিতে খেলতে যাচ্ছে না ভারত। তাই টিম ইন্ডিয়ার ম্যাচ আয়োজনে বেছে নেওয়া হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। ৫ মার্চ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের ভেন্যু লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। তবে ভারত ফাইনালে উঠলে বদলে যাবে ভেন্যু। শিরোপা লড়াই অনুষ্ঠিত হবে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। বলা যায়, ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আয়োজক পাকিস্তান হলেও ‘দাদাগিরি’ অব্যাহত ভারতের!
পেছন ফিরে দেখা
মূলত নন-টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর ক্রিকেটের উন্নতির জন্য তহবিল সংগ্রহের নিমিত্তে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজনের পরিকল্পনা। ১৯৯৮ সালে আইসিসি সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার উদ্যোগে মাঠে গড়ায় প্রথম টুর্নামেন্ট। শুরুতে নাম ছিল ‘উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ’। তবে তা পরিচিতি পায় ‘আইসিসি নক-আউট ট্রফি’ হিসেবে। সেই সময় টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলন ছিল না। ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট হিসেবে এটি পরিচিতি পায় ‘মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ’ হিসেবে। প্রথমদিকে শুধু টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো সুযোগ পেয়েছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার। পরবর্তী সময়ে ১০টি পূর্ণ সদস্য দেশ ও আরো দুটি সহযোগী দেশ টুর্নামেন্টে অংশ নিত। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে টুর্নামেন্ট শুরুর ছয় মাস আগে শুধু ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা আটটি দল সুযোগ পেয়েছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে।
রোল অব অনার
১৯৯৮ সালে আইসিসি নক-আউট ট্রফির প্রথম আসরের স্বাগতিক ছিল বাংলাদেশ। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ২৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় টুর্নামেন্ট। তবে টেস্ট মর্যাদা না থাকায় বাংলাদেশ খেলার সুযোগ পায়নি। অভিষেক আসরের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে শিরোপা জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকা, যা যেকোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র সাফল্য। ২০০০ সালে কেনিয়ার মাটিতে শিরোপা জয় করে নিউজিল্যান্ড। ২০০২ সালে শিরোপা ভাগাভাগি করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা আর ভারত। ইংল্যান্ডের মাটি থেকে ২০০৪ সালে ট্রফি নিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দখলে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ২০০৯ সালেও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শিরোপা ধরে রাখে অজিরা। ২০১৩ আর ২০১৭ সালের আয়োজক ছিল ইংল্যান্ড। শিরোপা যায় ভারত আর পাকিস্তানের ঘরে।
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ২০২৫
নবম চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ফরম্যাট বদলেছে। ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের লিগ পর্বের সেরা সাত দল পেয়েছে অংশগ্রহণের টিকিট। এ ছাড়া পাকিস্তান ছিল স্বাগতিক হিসেবে অটো চয়েজ। নিয়মের গ্যাঁড়াকলে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ পায়নি দুই সাবেক চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কা। এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ‘এ’ গ্রুপে রয়েছে স্বাগতিক পাকিস্তান, ভারত, নিউজিল্যান্ড আর বাংলাদেশ। ‘বি’ গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ড। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল খেলবে সেমিফাইনালে।
কিছু উল্লেখযোগ্য রেকর্ড
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সর্বোচ্চ ২৯টি ম্যাচ খেলে ১৮ জয় রয়েছে ভারতের নামের পাশে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫ ম্যাচে ১৪টি জয় পাওয়া ইংল্যান্ড দুটি ফাইনাল খেলেও শিরোপা পায়নি। ২৭ ম্যাচে ১৪টি জয় রয়েছে শ্রীলঙ্কার। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সবচেয়ে বেশি ৭৯১ রানের মালিক ক্রিস গেইল। এক আসরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও ইউনিভার্সেল বসের। ২০০৬ সালে তিনি করেছিলেন ৪৬৪ রান। আবার তিন সেঞ্চুরি নিয়ে যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছেন শিখর ধাওয়ান, সৌরভ গাঙ্গুলী আর হার্শেল গিবসের সঙ্গে। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসে যৌথভাবে শীর্ষে নিউজিল্যান্ডের নাথান অ্যাস্টেল আর জিম্বাবুয়ের গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। ফ্লাওয়ার ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে আর ২০০৪ সালে অ্যাস্টল ১৪৫ রান করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। ২০০৯ সালে শেন ওয়াটসন আর রিকি পন্টিং দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৫২ রান যোগ করে গড়ে রেখেছেন সর্বোচ্চ পার্টনারশিপ রেকর্ড। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৮ উইকেটের মালিক নিউজিল্যান্ডের কাইল মিলস। আর ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগার শ্রীলঙ্কার ফারভিজ মাহরুফের। ২০০৬ সালে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে তিনি নিয়েছিলেন ১৪ রানে ৬ উইকেট। আর এক আসরে সর্বোচ্চ ১৩টি উইকেটের রেকর্ড পাকিস্তানের হাসান আলী আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেরোমি টেইলরের।
২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ড গড়ে ৪ উইকেটে ৩৪৭ রানের সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংসের রেকর্ড। সর্বনিম্ন ইনিংস ৬৫ রানের। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ব্যক্তিগত অলরাউন্ড পারফরমেন্সে রাজার আসনে গেইল আর জ্যাক ক্যালিস। প্রোটিয়া ক্যালিস ১৭ ম্যাচ খেলে ৬৫৩ রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ২০ উইকেট। সমান ম্যাচে গেইলের রয়েছে ৭৯১ রান আর ১৭টি উইকেট।
কতদূর যাবে বাংলাদেশ
মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। আট বছর পর ফের মাঠে গড়ানো চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে টাইগাররা খেলবে নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, তাসকিন আহমেদ, সৌম্য সরকার, মোস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গী ভারত, পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ড শিরোপার দাবিদার। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিন দলের কাছেই বাজেভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ। গ্রুপে আন্ডারডগ তকমা নিয়েও টাইগার অধিনায়ক জানিয়েছেন, ‘আমরা শুধু অংশ নিতে যাচ্ছি না। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি যে আমাদের সেই সামর্থ্য আছে।’
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ
আইসিসির অন্যতম বৃহৎ আসরে ষষ্ঠবারের মতো অংশ নিতে চলেছে বাংলাদেশ। ২০০০ সালে নাইরোবিতে কোয়ালিফাইং ম্যাচে টাইগাররা ৮ উইকেটে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নেন। ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন নাইমুর রহমান দুর্জয়। ওপেনার জাভেদ ওমর করেছিলেন ৬৩ রান। অধিনায়ক নাসের হোসেনের ৯৫ রানের সুবাদে বাংলাদেশের ২৩২ রানের ইনিংস সহজেই টপকে যায় ইংলিশরা।
২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ বিদায় নেয় গ্রুপপর্ব থেকে। আবার ২০০৯ ও ২০১৩ সালের আসরে বাংলাদেশ সুযোগই পায়নি। ২০০৬ সালে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ দেখে প্রথম জয়ের মুখ। ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে। তবে গ্রুপের শেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়ে যায় ১০১ রানের বিশাল জয়। ওপেনার শাহরিয়ার নাফিস করেছিলেন অপরাজিত ১২৩ রান। সাকিব তিনটি আর মোহাম্মদ রফিক এবং আব্দুর রাজ্জাক দুটি করে উইকেট নেন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ গড়ে ইতিহাস। প্রথমবারের মতো আইসিসি আয়োজিত কোনো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠে যায় টিম টাইগার। ওভালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তামিম ইকবালের (১২৮) দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ ৩০৫ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে। কিন্তু জো রুটের হার না মানা ১৩৩ রানের সুবাদে ৮ উইকেটে জয় পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার ভেস্তে ভেসে যায় বৃষ্টিতে। সেই ম্যাচেও তামিম করেছিলেন ৯৫ রান। কিন্তু অজি ইনিংসের মাঝপথে বৃষ্টির বাগড়া আর পয়েন্ট ভাগাভাগি। শেষ গ্রুপ ম্যাচে সাকিব আল হাসানের ১১৪ রানের অনবদ্য ইনিংসে বাংলাদেশ ৫ উইকেটে হারিয়ে দেয় কিউইদের। কার্ডিফের ঐতিহাসিক জয়েই বাংলাদেশ পা রাখে সেমিফাইনালে। তবে সেমিতে পাত্তা পায়নি ভারতের কাছে। তামিমের ৭০ রান সত্ত্বেও হেরে যায় ৯ উইকেটের শোচনীয় ব্যবধানে। তবু ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এখন পর্যন্ত আইসিসি ইভেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়ে আছে।
২০২৫ সালে অনুপস্থিত তারকারা
তামিম ইকবাল অবসর নিয়েছেন, সাকিব আল হাসান দলে নেই। বাদ পড়েছেন লিটন কুমার দাস। বাংলাদেশ দলে তিনজন বড় তারকার অনুপস্থিতি। ইনজুরির জন্য ভারতীয় স্কোয়াডে নেই জাশপ্রিত বুমরাহ। অস্ট্রেলিয়া পাচ্ছে না বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজেলউড, মিচেল স্টার্ক, মিচেল মার্শ আর মার্কাস স্টয়নিস। নিউজিল্যান্ড পাবে না লকি ফার্গুসন আর রাচিন রবিন্দ্রর সার্ভিস। পাকিস্তানের হারিস রউফ, সাইম আয়ুব, দক্ষিণ আফ্রিকার এনরিক নরকিয়া আর আফগানিস্তানের বিস্ময় স্পিনার আল্লাহ মোহাম্মদ গজনফরকেও দেখা যাবে না চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বিজয়ী অধিনায়করা
১৯৯৮ সালে অভিষেক আসরে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন প্রয়াত হ্যান্সি ক্রোনিয়ে। পরবর্তী সময়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বিজয়ী অধিনায়কের তালিকায় নাম লেখান নিউজিল্যান্ডের স্টিফেন ফ্লেমিং, ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী এবং শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়াসুরিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান চার্লস লারা, ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি আর পাকিস্তানের সরফরাজ আহমেদ। ২০০৬ আর ২০০৯ সালে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলীয় রিকি পন্টিং টানা দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের অনন্য রেকর্ড গড়েন।