
২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রবেশ করে পেশাদার ফুটবলের যুগে। ২০২৪-২৫ মৌসুমে, অর্থাৎ কাটায় কাটায় ১৮ বছর পর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব জিতেছে পেশাদার লিগে নিজেদের প্রথম শিরোপা। দেশের সবচেয়ে সফল ক্লাব হয়েও মোহামেডানের পেশাদার লিগ জিততে না পারার গ্লানি মিটেছে। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী দলটির সাফল্যে পেশাদার লিগও হয়তো পেয়েছে পূর্ণতা।
ব্রিটিশ শাসকদের বিপক্ষে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মোহামেডানের রয়েছে রাজসিক সাফল্যের গল্প। অবিভক্ত বাংলা থেকে পাকিস্তানি শাসনামল স্বাধীন বাংলাদেশেও মোহামেডান দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। তবে দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটিকেও দুঃসময় পেরোতে হয়েছে।
রেকর্ড ১৯টি ঢাকা লিগ, ১১টি ফেডারেশন কাপ, তিনটি আগা খান গোল্ডকাপসহ অগণিত ট্রফি রয়েছে মোহামেডানের ক্যাবিনেটে। কিন্তু ২০০৬ সালের জাতীয় লিগ জয়ের পর শুরু হয় ব্যর্থতার চক্র। সবশেষ দুই দশকে মোহামেডান জিতেছে শুধু তিনটি ফেডারেশন কাপ, দুটি সুপার কাপ আর একটি স্বাধীনতা কাপ।
পেশাদার লিগে শিরোপা দূরে থাক, মোহামেডানকে ‘রেলিগেশন’ চোখ রাঙিয়েছে। মোহামেডান তখন কৌলিন্য হারিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত। তবে কি মোহামেডান পতিত কুলীন ভিক্টোরিয়া আর ওয়ান্ডারার্সের পরিণতি ভোগ করতে চলেছে? শঙ্কা জেগেছে।
সব শঙ্কা উড়িয়ে পৌরাণিক গল্পের ‘ফিনিক্স’ পাখির মতোই পুনর্জন্ম হয়েছে মোহামেডানের। ২০২৩ সালে ফেডারেশন কাপ জয়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এক দশকের শিরোপা খরা কাটিয়েছিল মোহামেডান। আর ২০২৪-২৫ মৌসুমের পেশাদার লিগের শিরোপা চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে
থাকা সাদা-কালো ভক্তদের জন্য এনে দিয়েছে মুষল বর্ষণে অবগাহনের আমেজ। ১০ দলের পেশাদার লিগে এবার তিন ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোহামেডান। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকা আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে সুস্পষ্ট ১০ পয়েন্টের ব্যবধান। বাকি ম্যাচ মোহামেডান হারুক বা জিতুক, শিরোপা ফয়সালা হয়ে গেছে।
পেশাদার লিগে মোহামেডানের সাফল্যের প্রধান কারিগর কোচ আলফাজ আহমেদ আর অধিনায়ক সুলেমান দিয়াবাতে। মালের ফুটবলার দিয়াবাতে প্রথম বিদেশি হিসেবে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ১০০ গোলের নজির গড়েছেন। চলতি লিগে ১৫ ম্যাচে ১০ গোল করেছেন।
বসুন্ধরা কিংস আর আবাহনীর নাইজেরিয়ান ইমানুয়েল সানডের গোল সংখ্যাও ১০। উজবেক মিডফিল্ডার মোজাফর মোজাফরভ করেছেন তিন গোলের সঙ্গে ৫ অ্যাসিস্ট। গোলরক্ষক সুজন হোসেন আস্থার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
মেহেদি মিঠু, মিনহাজুল আবেদিন, মাহবুব আলম, শাকিল আহাদ তপুর মতো তরুণ ফুটবলাররা নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন। মোহামেডানের সাফল্য পুরো টিম ওয়ার্কের ফসল।
আলফাজ ১৯৯৬ সালে মোহামেডানকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে। ১৯৯৯ সালে ছিলেন লিগজয়ী মোহামেডানের অধিনায়ক। আর ২০২৫ সালে জিতলেন কোচ হিসেবে। অনন্য রেকর্ড। ২০১৩ সালে মোহামেডানের ফুটবলার হিসেবে অবসর নেন আলফাজ। ২০২০ সালে প্রিয় ক্লাবে ফেরেন তৎকালীন কোচ শন লেনের সহকারী হিসেবে।
২০২২-২৩ মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে নেন প্রধান কোচের দায়িত্ব। মোহামেডান তখন ধুঁকছে। সেই মোহামেডানকে ৯ বছর পর জেতালেন ফেডারেশন কাপ। দেড় বছরের ব্যবধানে আলফাজের মোহামেডান জিতেছে পেশাদার লিগ।
তবে মোহামেডানের সাফল্যের কৃতিত্ব একা নিতে নারাজ আলফাজ। দলটির কোচ বলেছেন, ‘মোহামেডানের সাফল্যের পেছনে প্রত্যেক খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, কর্মকর্তা ও সাবেক ফুটবলারদের অবদান রয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে সমর্থকদের অকৃত্রিম সমর্থন। বহু বছর কোনো সাফল্য নেই। কিন্তু আমাদের সমর্থকরা বাংলাদেশের যেখানে খেলা হয়েছে, হাজির থেকেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
মোহামেডানের কিংবদন্তি গোলরক্ষক সাইদ হাসান কানন বর্তমানে ক্লাবের গোলরক্ষক কোচ। তিনি বললেন, ‘আমাদের সভাপতি সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আব্দুল মুবিন (অব.) এবং ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান আলমগীর ভাই ক্লাবের জন্য সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন। উনাদের এফোর্টের জন্য আমাদের কাজ সহজ হয়েছে।’
বাংলাদেশে মোহামেডানের কোটি ভক্ত রয়েছে। দীর্ঘ ব্যর্থতায় যারা এখন স্টেডিয়াম বিমুখ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পেশাদার লিগের শিরোপা জয় মোহামেডান ভক্তদের নতুন করে জাগিয়ে তুলবে।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাস মানেই মোহামেডান আর আবাহনীর দ্বৈরথ। ফুটবলের সোনালি সময় ফিরিয়ে আনতে মোহামেডান ও আবাহনীর সমর্থকগোষ্ঠীর পুনর্জাগরণের কোনো বিকল্প নেই।