
আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও ফারুক আহমেদ। ফাইল ছবি
ঠিক ৯ মাস আগে রাজসিকভাবে ক্রিকেট বোর্ডে পা রেখেছিলেন ফারুক আহমেদ। ফুলেল শুভেচ্ছা আর স্লোগানে স্লোগানে তাকে বরণ করতে বিসিবি-পাড়ায় ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। এক বছর না যেতেই সেই একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন হলো মিরপুরের ‘হোম অব ক্রিকেটে’। তবে এবার দৃশ্যটা ভিন্ন।
এক সভাপতির বিদায়ের পরপরই এলেন আরেক সভাপতি। দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পদে বসলেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী আমিনুল ইসলাম বুলবুল। যে পথে আনা হলো ফারুককে সে পথেই ছুড়ে ফেলা হলো। সঙ্গে তিনি হারালেন গোছানো ক্রিকেট ক্যারিয়ার ও প্রধান নির্বাচক হয়ে অর্জন করা সম্মান। যে সভাপতিকে নিয়ে এক সপ্তাহ আগেও নেচেছিল দেশের ক্রিকেট, তিনিই এখন হলেন ব্রাত্য! মাস কয়েকের ব্যবধানে দুইবার দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পদে রদবদল হলো। অতীতে এমন ইতিহাস দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, এতটা সম্মানহানির মধ্য দিয়ে আর কাউকে পদ হারাতেও দেখা যায়নি আগে। অথচ দেশের ক্রিকেটের বড় নাম হয়েও এমন ঘটনার সাক্ষী হলেন ফারুক।
সবার প্রিয় ফারুক কেন অল্প কদিনেই এত চোখের বিষ হলেন? এই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় অনেকেই। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দায়িত্বে এসে রাজনীতির খেলায় ঠিক চালটা বুঝতে হয়তো ভুল করে ফেলেছেন ফারুক। আগের বোর্ড থেকে নিজের বোর্ডে পাওয়া পরিচালকদের ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। এমনকি ফারুকের সঙ্গেই বোর্ডে পরিচালক হয়ে আসা নাজমুল আবেদীন ফাহিমের দ্বন্দ্বে জড়ানোয় হয়তো নিজের বিপদ ডেকে আনেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) একাদিক ভুল সিদ্ধান্ত, অধিক মুনাফা লাভের আশায় একাধিক ব্যাংকে ফান্ড ট্রান্সফার, কোচ চন্দ্রিকা হাথুরুসিংহের বিদায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিতর্ক, স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি চেক অনুমোদন না দেওয়াসহ নিজের সহকর্মীদের বেশি গুরুত্ব না দেওয়াই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।
আরেকটা জায়গায় বড় ভুল করে ফেলেছিলেন ফারুক। সেটি হলো, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা অনেক আগেই জানিয়ে দেওয়া এবং সেই অনুসারে প্রস্তুতি নেওয়া। ঘরোয়া লিগে ক্লাবগুলোর মধ্যকার পার্থক্যও বড় একটি কারণ হয়ে থাকল। নির্বাচনে তার আকাক্সক্ষা বাইরেও হয়তো অনেককে প্রভাবিত করেছে ক্রিকেট রাজনীতিতে অংশ নিতে। সবকিছু মিলিয়ে অনেকের জমানো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি হলো না তার পতনের ঘটনায়? রাতের আঁধারে পদ হারালেন সাবেক এই ক্রিকেটার। নানা অভিযোগ এনে অনাস্থা জ্ঞাপন করলেন তারই সহকর্মীরা। যার মধ্যে প্রথম নামটা দেখে চোখ কপালে উঠতে পারে যে কারো। প্রথম নামটিই ছিল ফাহিমের। ফারুক আমলে সবচেয়ে বড় বিভাগ (ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি) পেয়েছেন তিনি। গত ৯ মাসে একাধিক বিদেশ ট্যুর পাওয়া পরিচালকও ফাহিম।
যে পথে ফারুক এসেছিলেন সে পথেই দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক হয়ে এলেন আমিনুল। আইসিসিতে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি করা বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান দেশের ক্রিকেটের এই রাজনীতির খেলায় কতটা ভালো করবেন? সেটি সময়ের হাতে তোলা। সূচি অনুসারে অক্টোবরে নির্বাচন হলে সময়টাও বেশি নেই আমিনুলের হাতে। মাস তিনেকের মধ্যে দেশের ক্রিকেটের আহামরি পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাহলে হঠাৎ বোর্ডে এত পরিবর্তন, এত আয়োজন, এত রাজনীতি- এসবের কারণ কী? দিনশেষে সবই তো ক্রিকেটের ভালোর জন্য। সেই ভালোটা কী হচ্ছে আসলে? একের পর এক বোর্ডে মুখ পরিবর্তন হচ্ছে; কিন্তু ক্রিকেটের কোনো পরিবর্তন নেই। ক্রমেই ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং থেকে শুরু করে ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস; কোথাও নেই জয়ের গান।
টেস্টে বাংলাদেশ গড়পড়তা দল। যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেটা ওয়ানডেতে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন নামতে নামতে গিয়ে ঠেকেছে র্যাংকিংয়ের ১০ নম্বরে! সর্বশেষ টি-টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশের অবস্থান ১০! সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হেরে এই অবনতি লিটন দাস-নাজমুল হোসেন শান্তদের।
এত ক্রিকেটীয় রাজনীতির কাছে সত্যিকারের খেলার উন্নয়নের কোনো খবর নেই। মাঠে লড়াই বাদ দিয়ে সবাই লড়ছে চেয়ার দখলের জন্য। বোর্ডে একজন গেলেন, আরেকজন এলেন- এই আসা-যাওয়ার মিছিলে সত্যিকারের পরাজয়টা যেন হলো শুধু ক্রিকেটেরই! বিসিবির এই অবস্থা দেখে হতাশ সবাই। হতাশ তামিম ইকবালও। এসব দেখে জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক বলেছেন, ‘আমি একটাই রিকোয়েস্ট করব, যারা আছেন বা যারা আসবেন ক্রিকেটটা নিয়ে একটু ভাবেন। কারণ ক্রিকেট তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। পুরো ক্রিকেটের প্রতিটি জায়গা থেকে আমরা স্ট্রাগল করছি। এই জিনিসটি স্বীকার করে, মেনে নিয়ে কিভাবে এখান থেকে ভালোর দিকে এগোতে হবে এই বিষয়টি ভাবা উচিত।