
কাচের বাক্সের ভেতর লম্বাকৃতির একটি ট্রফি। যার সামনে লেখা ‘চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯৬, ক্রিকেট বিশ্বকাপ’। পেছনের দেওয়ালে বিশ্বকাপ জার্সি, তার ঠিক ওপরে চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর সংবলিত ব্যাট। পাশের দেওয়ালজুড়েই অর্জুনা রানাতুঙ্গার বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যদের উচ্ছ্বাস আর দেওয়ালের দুই পাশ ধরে জ্বলজ্বল করছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের স্কোরকার্ড।
ওপরে চিত্রটির বর্ণনা পড়ে হয়তো বুঝতে পেরেছেন কাদের কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বলছি, ১৯৯৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার কথা। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার ২১ বছরের মাথায় ট্রফি জয়ের যে ইতিহাস তারা গড়েছিল তার চিত্রই স্বয়ং দেখতে পাবেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট মিউজিয়ামে!
শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের (এসএলসি) এই জাদুঘরে প্রবেশ করতেই মনে হবে, ক্রিকেট রাজ্যে হারিয়ে গেছেন। তবে সে রাজ্যের রাজা লঙ্কানরা। লঙ্কানদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রতিটি গল্প লেখা আছে এই জাদুঘরের দেওয়ালে। অবশ্য শুধু লঙ্কা বললে ভুল হবে। দেশটি স্বাধীন নাম পাওয়ার আগের ট্রফিও পরম যত্নে রাখা আছে এই জাদুঘরে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি ঔপনিবেশিকদের শাসন আমলে ‘সিলন’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরও সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা হতে দ্বীপরাষ্ট্রটির সময় লেগে যায় দুই যুগ। পুরোনো নাম সিলন থাকাকালে তারা এমজে গোপালন ট্রফিতে খেলে মাদ্রাজের বিপক্ষে। ১৯৫২ সালের সেই পুরোনো ট্রফিও আছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট জাদুঘরে।
এ ছাড়া ছোট বড় মিলিয়ে দেড়শর বেশি ট্রফি শোভা পাচ্ছে এই জাদুঘরে। এই জাদুঘরের একটি বিশেষ অংশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নামও। লঙ্কানরা তাদের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ২০১৪ সালে, যার আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। সেই ট্রফিটিও ঝলমল করছে কাচের কিউবের ভেতরে। পাশে মিরপুর শেরেবাংলায় ভারতকে হারিয়ে বিশ্বজয়ী লঙ্কানদের বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। সাজানো আছে সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডও। আছে কলম্বো শহরে লাসিথ মালিঙ্গাদের ট্রফি হাতে শো ডাউনের চিত্র।
এর ঠিক সামনেই আরেকটি কাচের বাক্সে রাখা শ্রীলঙ্কার ছয়টি এশিয়া কাপের ট্রফি। যে ট্রফিগুলো একেকটি দেখতে একেক রকম। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটি হলো ১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপের ট্রফি। যেটির নাম ‘জন প্লেয়ার এশিয়া কাপ গোল্ড লিফ ট্রফি’।
এরপর একে একে সাজানো আরো পাঁচটি ট্রফি। সবশেষ ট্রফিটি সোনালি আভা ছড়াচ্ছিল কাচের কিউবের ভেতরে। যেটি ২০২২ সালে জিতেছিল লঙ্কানরা। সেই এশিয়া কাপের ট্রফিটি যখন শ্রীলঙ্কা জেতে তখন দেশটি চরম সংকটময় সময় পার করছিল। দাসুন শানাকার নেতৃত্বে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সর্বোচ্চ দিয়ে লড়েছেন কুশল মেন্ডিস-ধনাঞ্জয়া ডি সিলভারা। তাদের লড়াই সফলতা পেয়েছে। পাকিস্তানকে হারিয়ে আবারও এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে শ্রীলঙ্কা।
এশিয়া কাপের ট্রফিগুলোর পেছনেই রাখা টেস্ট ক্রিকেটের ঐতিহাসিক স্মারক। যে শোকেসে আছে ট্রফি, জার্সি, ব্যাট, বল, ক্যাপসহ নানান স্মৃতির স্মারক। টেস্ট ক্রিকেটে লঙ্কানদের সব ট্রফিতে ভরা সেই শোকেস; যার প্রতিটির পেছনের গল্প যেন বলছে, টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিটি সেশনে লড়াইয়ের কথা।
জাদুঘরের প্রথম কক্ষের আরেকটি দেওয়ালে আছে বিভিন্ন সময়ে জেতা দ্বিপক্ষীয় সিরিজের ট্রফি। আছে এশিয়ার প্রথম দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে জেতা সিরিজের ট্রফিও।
দ্বিতীয় কক্ষের এক দেওয়ালজুড়ে টেস্ট ক্রিকেটারদের ‘হল অব ফেম’। আছে ২০২২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে নেতৃত্ব দেওয়া সব অধিনায়কের নাম। আছে নারী অধিনায়কদের নামও।
দুই রুমের মাঝখানে তুলে ধরা হয়েছে শ্রীলঙ্কার পাঁচটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের গল্প। যার মধ্যে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব স্টেডিয়াম ও পি সারা ওভাল রয়েছে তামিল ইউনিয়ন ক্রিকেট অ্যান্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবের অধীনে। বাকি তিনটি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে নিয়ন্ত্রিত।
সব মিলিয়ে এই জাদুঘরের ভেতরের প্রতিটি কর্নার মুগ্ধ করবে। একটা দেশের ক্রিকেটের ইতিহাস জানতে এমন একটা জাদুঘরই তো যথেষ্ট!