
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ ভুটান। হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত ভূটানকে ‘পর্বতের দেশ’ নামে ডাকা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দেশটির নামকরণ হয়েছে সংস্কৃত শব্দ
‘ভূ-উত্থান’ (উঁচু ভূমি) থেকে। স্থানীয়রা ভুটানকে নিজেদের মাতৃভাষায় বলে ‘দ্রুক ইয়ুল’ বা ‘বজ্র ড্রাগনের দেশ’ নামে। ২০২৪ সালের জনশুমারি অনুসারে ভুটানের জনসংখ্যা আট লাখ পেরিয়েছে। অথচ সীমিত জনবল নিয়েই ভুটান ফুটবল ব্যবস্থাপনায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশকে লজ্জা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন। জাতীয় দল কিংবা বয়সভিত্তিক পর্যায়ের সাফ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের মেয়েরা শিরোপা জিতে চলেছে মুড়িমুড়কির মতো। তুলনায় ভুটানের নারী ফুটবল দল খুব বেশি শক্তিশালী নয়। ২০২৪ সালের সাফ নারী টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ভুটানকে ১-৭ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। চলতি বছর জুলাইয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলে দুই দেখায় ভুটানকে ১-৪ আর ০-৩ গোলে পরাভূত করে আমাদের মেয়েরা। বলা বাহুল্য, দুটি আসরেই শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। আরো একটি তথ্য, ফুটবলে ভুটানের কাছে কোনো পর্যায়ে বাঘিনীরা কখনো হারেনি।
ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবল যোজন এগিয়ে। কিন্তু ভুটানের নারী ফুটবল লিগ কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। নিয়মিত লিগ আয়োজন আর খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে ভুটানকে ‘আদর্শ’ বললেও ভুল হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের জন্য ভুটানের লিগ হয়ে উঠেছে আশা-ভরসার প্রতীক। ২০২৫ সালে ভুটানের নারী লিগে খেলছেন বাংলাদেশের একঝাঁক ফুটবলার। রয়্যাল থিম্পু কলেজে তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র ও শাহেদা আক্তার রিপা খেলেছেন। পারো এফসিতে খেলছেন সাবিনা, ঋতুপর্ণা, সুমাইয়া ও মনিকা। রয়্যাল থিম্পু কলেজে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক আফেঈদা খন্দকার ও স্বপ্না রানী।
২০২৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে এএফসি উইমেন্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, যা এশিয়ার ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের কোনো ক্লাব নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের মেয়েরা পা রেখেছে এএফসি এশিয়ান কাপের চূড়ান্তপর্বে। কিন্তু আমাদের কোনো ক্লাব যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি উইমেন্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ জানিয়েছেন, এএফসি টুর্নামেন্টে খেলতে হলে ঘরোয়া লিগে ১০টি দল এবং প্রত্যেককে ৮টি করে ম্যাচ খেলতে হয়। কিন্তু সর্বশেষ বাংলাদেশের মহিলা লিগে খেলেছে ৯টি দল আর সিঙ্গেল লিগ পদ্ধতিতে প্রত্যেক ক্লাব খেলেছে ৮টি করে ম্যাচ। তাই চ্যাম্পিয়ন হয়েও নাসরিন স্পোর্টিং ক্লাব সুযোগ পায়নি এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে।
কিরণ এএফসির মহিলা উইংয়ের প্রধান ছিলেন। এশিয়ার ফুটবলের রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তিনি। দীর্ঘদিন বাফুফের মহিলা উইংসের প্রধান হয়েও তিনি এএফসি মানদণ্ড অনুযায়ী দেশের ফুটবল লিগ কাঠামোকে দাঁড় করাতে পারেননি, যা পেরেছে ভুটান। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া ভুটান ন্যাশনাল উইমেন্স লিগের ক্লাব নিয়মিত খেলছে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে। চলতি ২০২৫ সালের প্রতিযোগিতায় রয়্যাল থিম্পু কলেজের হয়ে খেলবেন লাল-সবুজ অধিনায়ক আফেঈদা আর স্বপ্না। ভুটানের ক্লাবে খেলেই এশিয়ার সর্বোচ্চ ক্লাব ফুটবল আসরে খেলার স্বপ্নপূরণ করতে চলেছেন স্বপ্নারা।
২০১১ সাল থেকে মাঠে গড়ানো বাংলাদেশের নারী লিগ নিয়মিত না। স্থানীয় বড় ক্লাবের আগ্রহ নেই নারী লিগে খেলার। ফলে পারিশ্রমিক নিয়ে হতাশায় থাকতে হয় ফুটবলারদের। আবার অভাবিত সাফল্য এনে দিয়েও নারীরা বঞ্চিত। জানা গেছে, বিগত বছর থেকে ১১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ‘ফি’ বাফুফে পরিশোধ করেনি। ২০২৪ সালের অক্টোবরে সাফ জয়ের পর বাফুফে ঘোষিত দেড় কোটি টাকা মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। বাফুফের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ নারী ফুটবলারদের বেতনও অনিয়মিত। অথচ ভুটানের মতো ছোট আর ফুটবলে অজনপ্রিয় দেশে এএফসির বেঁধে দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট। খেলোয়াড়রা বুঝে পাচ্ছেন নিজেদের প্রাপ্য।
সেখানে বাংলাদেশে কি হচ্ছে? বেতন-ভাতা, বোনাস পরিশোধ কিংবা একটি মানসম্মত লিগ নিয়মিত আয়োজনে ব্যর্থতা বাদই দিলাম; নারী উইংসের প্রধানকে তোপের মুখে পড়তে হয় খেলোয়াড়দের ক্যাম্পে মানসম্মত খাবারের প্রশ্নে। ক্যাম্পে মেয়েদের খাবারের পাতে চাষের পাঙ্গাশ নাকি ইলিশ দেওয়া হয়, সেই প্রশ্ন ওঠে। পুরো বিষয়টি যে বাংলাদেশের জন্য লজ্জার তা বোঝার ক্ষমতা হয়তো বাফুফে কর্তাদের নেই।