‘ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি’

আহসান হাবীব সুমন
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৮

রাফায়েল টুডু
রাফায়েল টুডু-এই নামের সঙ্গে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা খুব বেশি পরিচিত নন। অনেকের কাছে বিদেশিও মনে হতে পারে। তবে টুডু এ দেশেরই ফুটবলার। সাঁওতাল সম্প্রদায় থেকে লড়াই করে উঠে এসেছেন। টুডু চলতি মৌসুমে নাম লিখিয়েছেন মোহামেডানে। স্বপ্ন দেখেন জাতীয় দলে খেলার। তার সেই স্বপ্ন ও লড়াইয়ের কথা শুনলেন আহসান হাবীব সুমন।
রাফায়েল টুডু নামটা শুনলেই বিদেশি বলে ভুল করে অনেকে। এই নামের কোনো বিশেষত্ব আছে?
আমি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের মধ্যে প্রায় ১২-১৩টি গোত্র আছে। যেমন-মুরমু, মার্ডি, টুডু, কিসকু ইত্যাদি। আমরা টুডু গোত্রের। আর খ্রিষ্ট ধর্মে রাফায়েল খুব সাধারণ নাম।
বাংলাদেশে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কোনো ফুটবলারের কথা কখনো শোনা যায়নি। আপনি ফুটবলে এলেন কী করে?
হ্যাঁ, সাঁওতালরা খেলাধুলা কিংবা অন্য কোনো পেশায় সহজে আসে না। আমাদের মূল পেশা কৃষিকাজ। আমি মা-বাবার চার ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। আমার পরিবারও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আমার তো ফুটবলের নেশা প্রবল। ছোটবেলায় পাড়ায় নিজেদের মধ্যে ফুটবল খেলতাম। একসময় আশপাশের এলাকায় ‘খেপ’ খেলার সুযোগ পেতে থাকি। যদিও সম্প্রদায়ের মানুষই আমাকে নিরুৎসাহিত করত। তাদের ভাষ্য ছিল, সাঁওতালদের ভিন্ন পেশায় উন্নতি করার সুযোগ নেই। আমিও যেন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে
কৃষিকাজে মন দিই। তবে পরিবার আমাকে সব সময় পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছে। আমার বাবা মানিক টুডু খুব করে চেয়েছিলেন আমি যেন ফুটবলার হই। ২০১৭ সালে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। বাবা মারা যাওয়ার সময় আমি প্র্যাকটিসে ছিলাম। খবর পেয়ে বাসায় ছুটে আসি। আজ বাবা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।
প্রথম কোচ কে?
আমার জন্ম রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি থানার ঋষিকুল ইউনিয়নের আমতলি পাড়ায়। আমাদের পাশের চব্বিশনগর এলাকার নওশাদ আলী ভাই আমার কোচ। তিনি কোনো পেশাদার কোচ নন। শখের বশে এলাকার ছেলেদের ফুটবল শেখাতেন।
কোন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন?
রাজশাহীর কিশোর ফুটবল একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমাকে ফুটবলার হিসেবে পরিশীলিত করে তুলেছেন একাডেমির কোচ এবং পরিচালক মামুনুল ইসলাম জেড ভাই। শুরুতে গোলরক্ষক পজিশনে খেলতাম। তবে স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলার ঝোঁক ছিল। বিভিন্ন ‘খেপ’ টুর্নামেন্টে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলে গোল পেয়েছি। এমনকি ভিন্ন দলের হয়ে কিশোর একাডেমির বিপক্ষেও আমার গোল আছে।
ঢাকার ক্লাব ফুটবলে সুযোগ পেলেন কীভাবে?
২০২০-২১ মৌসুমের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ভিক্টোরিয়া ক্লাবের স্কোয়াডে সুযোগ পাই দলের তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে। মাত্র ২-৩টি ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ হয়। ভিক্টোরিয়া দুর্ভাগ্যজনকভাবে রেলিগেটেড হয়ে যায়। আমাকেও ফিরে যেতে হয় রাজশাহীতে। ঢাকায় কোনো দল আগ্রহও দেখায়নি। রাজশাহীতে ফিরে স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে আমি স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা শুরু করি। নিয়মিত গোলও পেতে থাকি। মূলত তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, গোলরক্ষক পজিশন ছেড়ে পাকাপাকিভাবে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার। এই সুযোগটা আমাকে জেড ভাই করে দিয়েছেন।
ঢাকার ফুটবলে ফিরলেন কীভাবে?
প্রায় দুই বছর পর ইয়াংম্যান্স ফকিরেরপুল ক্লাবে সুযোগ পাই আমার স্থানীয় সম্পর্কে ভাই শিব টুডুর সহায়তায়। তিনি ফকিরেরপুল স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু খুব বেশি সুযোগ পাননি খেলার। জেড ভাইও সহায়তা করেন। তবে গোলরক্ষক পজিশন থেকে স্ট্রাইকার পজিশনে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। ট্রায়াল আর অনুশীলনে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। ২০২৩-২৪ মৌসুমের বিসিএলে স্ট্রাইকার হিসেবে ফকিরেরপুলের পক্ষে ১২ গোল করি। ফকিরেরপুল চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে উঠে আসে। আমি বিসিএলের সেরা গোলদাতা আর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলাম। ২০২৪-২৫ মৌসুমে ফকিরেরপুলের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে আমার অভিষেক। ফেডারেশন কাপে মোহামেডানের বিপক্ষে ফকিরেরপুলের হয়ে আমার গোল আছে।
চলতি মৌসুমে সেই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেই নাম লিখিয়ে কেমন লাগছে?
ছোটবেলা থেকেই বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। মোহামেডানের মতো দেশসেরা ক্লাবে সুযোগ পেয়ে স্বপ্নের প্রথম ধাপ পূরণ হয়েছে।
স্বপ্নের পরবর্তী ধাপ?
মানুষের স্বপ্নের কোনো সীমা নেই। দেশের হয়ে খেলতে চাই। মোহামেডানের মতো বড় দলে ভালো করতে পারলে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নপূরণ সহজ হবে বলে আমি মনে করি।
মোহামেডানের মতো বড় দলে নিয়মিত সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন?
আমি জানি কাজটি কঠিন। আমার ক্যারিয়ার মাত্র শুরু। অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবে যতটুকু গেম টাইম পাব, সেটাকে কাজে লাগাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
বাংলাদেশে বর্তমানে দেশীয় উঁচুমানের স্ট্রাইকারের খুব অভাব। এই বিষয়ে কি বলবেন?
আমাদের দেশেও ভালো স্ট্রাইকার আছে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় প্রতিটি ক্লাবে স্ট্রাইকার পজিশন দখলে রেখেছে বিদেশিরা। দেশীয়রা খুব বেশি গেম টাইম পায় না। তাই হয়তো জাতীয় দলে হঠাৎ সুযোগ পেয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দেশীয় স্ট্রাইকাররা ভালো করেন না।
তাহলে উপায়?
দেশের সর্বোচ্চ ঘরোয়া ফুটবলের প্রতিটি ক্লাবে অন্তত একজন দেশীয় স্ট্রাইকার বাধ্যতামূলকভাবে মাঠে নামানোর নিয়ম করা উচিত। তাতে স্ট্রাইকাররা নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাবেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য আমাদের স্ট্রাইকারদের আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।
ধন্যবাদ টুডু আপনাকে।
ধন্যবাদ সাম্প্রতিক দেশকালকেও।