কেউ বলছেন, ‘কোচ কাবরেরাকে বাদ দিতে হবে’। কারো অভিযোগ, ‘মিতুল মারমার কারণে ম্যাচ হেরেছে’। দেশের ফুটবলে জোয়ার এসেছে। দর্শক মাঠমুখী হয়েছেন। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সও খারাপ নয়। আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। তবে কিছু ভুল যে চোখে পড়ছে না তা নয়। ৯ অক্টোবর যেমন জাতীয় স্টেডিয়ামে হংকং, চায়নার বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গিয়ে হারল, সেটির দোষ বর্তায় আদতে রক্ষণের ঘাড়ে। কিন্তু ফুটবল পুরোপুরি টিম ওয়ার্ক বা দলীয় খেলা। এখানে হারলেও দায় যেমন টিম ও কোচের ওপর বর্তায়, তেমনি জিতলেও কৃতিত্ব খেলোয়াড় ও কোচের। তবে খড়গটা বেশির ভাগ সময় নামে কোচের গর্দানে!
কিন্তু হংকংয়ের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হারের পর হাভিয়ের কাবরেরাও যেন পুরো দায় নিতে ভুলে গেলেন। কিছু দায় নিলেন নিজে, কিছু দিলেন শিষ্যদের। দলের লড়াকু মানসিকতার প্রশংসা করলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ কোচও সংবাদ সম্মেলনে বলে ফেললেন, ‘দল আধিপত্য বিস্তার করলেও খেলোয়াড়দের ভুলগুলো শেষ পর্যন্ত দলকে ডুবিয়েছে।’
অবশ্য হারের দায় কাবরেরা শিষ্যদের দিকে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও যে নেননি এমন নয়। ম্যাচ শেষে সেই দায় নিয়ে তার কথা, ‘আমি সব দায় নিচ্ছি, পুরো টিমও নিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দায় আমারই।’ কোচের মতো খেলোয়াড়, সমর্থক-সবাই চায় প্রিয় দলের জয়। হারলে কষ্ট যে হয় না এমন নয়। তবে জয়-পরাজয় তো খেলারই অংশ। সেটি মেনে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াতে হয় প্রত্যেককে।
গত জুনে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচের পর থেকে মূলত কাঠগড়ায় কাবরেরা। সেই ম্যাচে নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকে বেঞ্চে রাখা, ম্যাচের শেষ দিকে ফরোয়ার্ড রাকিব হোসেনকে রক্ষণে নামিয়ে আনাÑএর সবকিছু নিয়ে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি স্প্যানিশ কোচকে। এরপর অবশ্য ভুটান ও নেপালের বিপক্ষে দুই প্রীতি ম্যাচের পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হংকংয়ের বিপক্ষে কাবরেরা ও তার শিষ্যরা কিছু মারাত্মক ভুল যে করেননি, তা নয়। বড় ম্যাচের চাপ বলে কথা!
তবে এমন দুর্দান্ত এক লড়াইয়ের পরও তাদের যেভাবে ‘মুণ্ডুপাত’ চলছে সেটি কি ঠিক? সব দোষ কি কাবরেরার? নাকি মিতুলের? মাঠের পরিস্থিতি কেমন, সেসব কোচ ও খেলোয়াড়দের চেয়ে আর কারা বা বেশি বুঝতে পারেন? আরেকজন নতুন কোচ আনলেই কি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে? জয়ের পর জয় তুলে নিতে পারবে বাংলাদেশ? সাফল্যের জন্য অবশ্য সময়ের দরকার। কয়েক দিন পর পর কোচ পরিবর্তন দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বেশি। সে কারণে বড় দলগুলো ব্যর্থতার পরও হুট করে কোচ ছাঁটাই করে না। আগে সময় নিয়ে দেখে, এরপর ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
তার পরও সব সময় কোচেরা যে আস্থার প্রতিদান দিতে পারেন, এমন নয়। এই যে একের পর এক ব্যর্থতার দায়ে এরিক টেন হাগ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ছাঁটাই হলেন, তিনি কিন্তু কম সময় পাননি। তার পরিবর্তে যিনি ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসেছেন সেই রুবেন আমোরিমও। কিন্তু এখনো সাফল্য পাননি। তবে আর্সেনালের মিকেল আর্তেতা এখনো কিছু না জিতলেও দলকে শিরোপা লড়াইয়ে রেখেছেন কয়েক মৌসুম ধরে। এই দুজনের ওপর আস্থা এখনো রেখেছে ক্লাব দুটি।
কোচের কাজ কী? প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলার কৌশল কেমন হবে, কোন ফর্মেশন হবে সেটি সাজান তিনিই। শিষ্যদের ভেতর থেকে সেরাটা কীভাবে বের করে নিয়ে আসবেন সেটিও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দলের জন্য উপযুক্ত খেলোয়াড় খোঁজাটাও তার কাজ। ম্যাচের পরিস্থিতিতে কাকে নামাবেন, কৌশল পাল্টাবেন-এসব কিছু তাকেই মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়। কাবরেরা সেটি করছেন কি না, সে ব্যাপারেও দেখা দরকার। তবে তাকে একেবারে ঢালাওভাবে দোষ দেওয়ার কিছুই নেই। আমাদের খেলোয়াড়দের হুটহাট রক্ষণে ভুল করে বসা নতুন নয়। আর ফিনিশারের অভাব তো সেই অনেক পুরোনো সমস্যা। তার পরও হামজা-ফাহমিদুল-জায়ানদের মতো প্রবাসী ফুটবলাররা আসায় দলের শক্তি বেড়েছে। জয়ের ক্ষুধা এসেছে। সেই কারণে হুটহাট কোচ না পাল্টিয়ে ক্ষুধাটা ও খেলার ধারটাই এখন ধরে রাখা জরুরি।
নতুন একজন এসেই হুট করে হামজা-জামালদের বুঝতে পারবেন না। খেলোয়াড়দেরও তার কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। আর বাংলাদেশের ম্যাচ তো হয় বছরে কয়েকটি। তার মধ্যে হামজা-শমিতদের পাওয়া যায় ম্যাচের মাত্র দিন দুয়েক আগে। তাদের নিয়ে হঠাৎ করে সাফল্য পেপ গার্দিওলা-হোসে মরিনহোর মতন কোচও এনে দিতে পারবেন না কিনা সন্দেহ।
মাঠে শুধু একজন হামজা সবকিছু করে দিতে পারবেন না, যদি তিনি সতীর্থদের সমর্থন না পান। তেমনি কোচও ডাগআউটে চিৎকার করে জয় এনে দিতে পারেন না। তবে তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় যখন তার শিষ্যরা ভুল করেন। হংকং ম্যাচে সেই ভুলগুলো কী কী? জায়ানকে শুরুতে না নামানো? জামাল-ফাহামিদুল-শমিতদের শুরুর একাদশে না রাখা? অভিষেক ম্যাচ বলেই জায়ানকে হয়তো একটু পরে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছেন কাবরেরা। তেমনি জামালের বয়স হওয়ায় সেই পুরোনো কৌশল নিয়েছেন। আর শমিতের তো ভ্রমণক্লান্তি ছিলই। কিন্তু রক্ষণে যে তিন গুরুত্বপূর্ণ ভুল, সেসব কোচের পাশাপাশি সাদ উদ্দিনের কাঁধেও বর্তায়। অবশ্য অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার তপু বর্মণ শুরুর একাদশে না থাকার অভাবটা ঠিকই টের পাওয়া গেছে। তবে এসব ভুলে এখন চোখ রাখা উচিত, রক্ষণ কীভাবে আরো জমাট করা যায়, সেদিকে। কীভাবে ভুল আরো কমানো যায়, সেসব নিয়েই শিষ্যদের সঙ্গে কোচকে বসতে হবে বারবার। লিড ধরে রাখা বা পিছিয়ে পড়লে ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবলও দিতে হবে শিষ্যদের। আর কোচকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে যতদিন তিনি দায়িত্বে থাকবেন। এরপর বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন কিনা সেসব দেখেই নিতে হবে ব্যবস্থা।
হোক না এএফসি এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার স্বপ্ন প্রায় শেষ। তবে গ্রুপে পরের তিন ম্যাচে কেমন লড়াই করে বাংলাদেশ সেটিও দেখার বিষয়। আর ওসবের পরই নেওয়া যাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কাবরেরার সঙ্গে বাংলাদেশ ফুটবলের সম্পর্ক অবশ্য তিন বছর হয়ে গেল। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে, তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো শুরুর একাদশে বারবার পরিবর্তন। বিশেষ করে রক্ষণভাগে। এক্সেপেরিমেন্টের দিকে না ঝুঁকে দলের প্রয়োজনে এবার একটু হয়তো স্থির চিন্তা করতে পারেন কাবরেরা।
