আর্লিং হালান্ড
সিংহের মতো মাথা ভর্তি লম্বা সোনালি চুলের ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটাকে ফুটবল ময়দানে আলাদা করে ফেলা যায় খুব সহজে। যদিও প্রথম দর্শনে তাকে ফুটবলার নয়, বরং কোনো হলিউড মুভির অ্যাকশন হিরো বলে মনে হতে পারে যে কারো। অবশ্য খেলার মাঠে তার কাজটাও অ্যাকশন মুভির হিরোদের মতো প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা। বলা হচ্ছে, বর্তমান সময়ে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক স্ট্রাইকার নরওয়ের আর্লিং হালান্ডের কথা।
২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ১১ অক্টোবর নরওয়ে ৫-০ গোলে হারিয়েছে ইসরায়েলকে। ম্যাচে হালান্ড হ্যাটট্রিকের সঙ্গে দেশের হয়ে ৫০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। নরওয়ের প্রথম ফুটবলার হিসেবে আন্তর্জাতিক গোলের হাফসেঞ্চুরি করেছেন। মাত্র ৪৬ ম্যাচ খেলেই তার আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যা ৫১! ফুটবলের রাজা পেলে ব্রাজিলের জার্সিতে ৫০ গোল করেছিলেন ৪৯ ম্যাচ খেলে। আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি ১০৭ এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের মালিক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ১১৪ ম্যাচ খেলে পেয়েছিলেন ৫০ গোলের দেখা।
হালান্ড ফুটবলের নিখুঁত শিল্পী নন। তার খেলায় নেই মেসি, রোনালদো, নেইমার এমনকি কিলিয়ান এমবাপ্পে আর ভিনিসিয়াস জুনিয়রদের মতো চোখ ধাঁধানো ছন্দ। তবে ফুটবল তো গোলের খেলা। আর গোল করার ক্ষেত্রে নিপুণ কারিগর হালান্ড। তার জন্মই হয়েছে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে বুনো উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য। আর ফুটবলটাও তার রক্তে মিশে আছে। বাবা আলফি হালান্ড ফুটবলার ছিলেন। নটিংহাম ফরেস্ট, ম্যানচেস্টার সিটি ও লিডস ইউনাইটেডের মতো বিখ্যাত ইংলিশ ক্লাব এবং নরওয়ে জাতীয় দলের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন আলফি। ২০০০ সালের ২১ জুলাই আর্লিং হালান্ডের জন্ম ইংল্যান্ডের লিডস শহরে।
আলফি রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ছিলেন। আর হালান্ড আক্রমণভাগের যোদ্ধা। বাবার মতোই ফুটবলে হাতেখড়ি নরওয়ের স্থানীয় ক্লাব ব্রাইনের একাডেমি দলে। একই ক্লাবের মূল দলে পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরু। বাবার মতোই নরওয়ের বয়সভিত্তিক দল হয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া। আর ক্লাব ফুটবলে প্রথম আলো কাড়েন রেড বুলস সালজবুর্গের হয়ে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০১৯-২০ মৌসুমে অস্ট্রিয়ান ক্লাবটির হয়ে ৬ ম্যাচেই করেন ৮ গোল। আর মৌসুমে তার গোলের সংখ্যা ছিল সবমিলিয়ে ২২ ম্যাচে ২৮টি। নির্বাচিত হন অস্ট্রিয়ান লিগের বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে।
অস্ট্রিয়ায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা হালান্ডকে মৌসুমের মাঝপথে দলভুক্ত করে জার্মানির বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সেখানে তিনি মাত্র আড়াই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৮৯ ম্যাচে ৮৬ গোলের দেখা পান। ২০২০-২১ মৌসুমে বুন্দেসলিগার সেরা খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। ২০২২-২৩ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটিতে নাম লিখিয়ে গড়েন ইতিহাস। প্রিমিয়ার লিগে নিজের অভিষেকে ৩৬ গোল করে গড়েন এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। একই মৌসুমে একাধারে হালান্ড জিতে নেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়, সেরা গোলদাতা, সেরা উদীয়মান তারকা আর ইউরোপিয়ান ‘গোল্ডেন শু’র পুরস্কার, যা এক অনন্য রেকর্ড। ২০২২-২৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র ৪৯ ম্যাচ খেলে দ্রুততম ৫০ গোলের রেকর্ড গড়েছেন হালান্ড। ভেঙেছেন ৬২ ম্যাচ খেলে ৫০ গোল করা ডাচ স্ট্রাইকার রুদ ফন নিস্টলরয়ের রেকর্ড। বর্তমান দল ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ১৫৫ ম্যাচে ১৩৬ গোল করা হয়ে গেছে তার।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে রেকর্ড যেন লুটোপুটি খাচ্ছে হালান্ডের পায়ে। তবু অনেকেই দুঃখ করেন, তার জন্ম নরওয়েতে না হয়ে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স কিংবা জার্মানির মতো দেশে হলে তিনি থাকতে পারতেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। নরওয়ে বিশ্ব ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি নয়। দেশটিকে বিশ্বকাপে দেখা গেছে মাত্র তিনবার-১৯৩৮, ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে একবার সুযোগ পেয়েছিল উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের মূল মঞ্চে খেলার। তবে হালান্ডে ভর করে নরওয়ে দেখছে ২০২৬ সালের বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন। নিজেদের গ্রুপে টানা ছয় ম্যাচে জয় নিয়ে শীর্ষে রয়েছে তার দেশ। যেখানে ইতালি রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।
চলতি বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইউরোপীয় অঞ্চলে ১২ গোল করে শীর্ষে রয়েছেন হালান্ড। ২০২০-২১ আর ২০২২-২৩ উয়েফা নেশনস লিগে সর্বোচ্চ গোলের মালিকও ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-২০ ফিফা বিশ্বকাপে ৯ গোল করা হাল্যান্ড জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। নরওয়ে দলকে বর্তমানে হালান্ডের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ বললে ভুল হবে না। নরওয়ে দলে তিনি এখন একাই একশ।
