ঘরের মাঠে একচ্ছত্র দাপট দেখানো বাংলাদেশ নারী দল বৈশ্বিক মঞ্চে এসে পথ হারাল। পাকিস্তানকে হারানোর পর টানা চার ম্যাচে পরাজয়, সেমিফাইনালের দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়া-এই ব্যর্থতা কেবল মাঠের পারফরম্যান্স নয়, বরং বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের সামগ্রিক কাঠামো এবং সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। অপ্রতিরোধ্য থেকে হঠাৎ নির্বাক হয়ে যাওয়ার এই চিত্রের নেপথ্যে ঠিক কী কী কারণ কাজ করেছে; সেগুলো একে একে আলোর নিচে আনা যাক-
ভঙ্গুর টপ-অর্ডার : ইনিংসের শুরুতেই পতনের অভ্যাস
বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপে ধারাবাহিকতার অভাব পুরোনো রোগ। টুর্নামেন্টে বারবার দেখা গেছে, দলের দু-তিনজন মূল ব্যাটার দ্রুত সাজঘরে ফিরলেই মিডল-অর্ডার সেই চাপ সামলাতে পারছে না। দীর্ঘ সময় ধরে ওয়ান-ডাউন বা ওপেনিং স্লটে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটারের অভাব ভোগাচ্ছে দলকে। বড় মঞ্চে ভিত্তি গড়ার যে দৃঢ়তা দরকার, সেটাই অনুপস্থিত। স্বর্ণা আক্তারের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড বা সোবহানা মোস্তারির অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস-এগুলো ব্যক্তিগত ঝলক। কিন্তু দলীয়ভাবে বড় স্কোর গড়ার জন্য যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত।
চাপের মুখে নড়বড়ে স্নায়ু : জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও হার
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচগুলো ছিল চরম হতাশার। প্রায় নিশ্চিত জয়ের পথ থেকে শেষ মুহূর্তে ম্যাচ ফসকে যাওয়া প্রমাণ করে দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুর্বলতা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ওভারে গিয়ে হার বা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একই ধরনের পরিণতি-এগুলো জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণের অভাবকেই চিহ্নিত করে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যাচ ফসকে যাওয়া এবং ফিল্ডিংয়ের সামগ্রিক মান ছিল হতাশাজনক। ক্রিকেটে এই ছোট ভুলগুলোই বড় ব্যবধান গড়ে দেয়, যা ক্রিকেটারদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
প্রস্তুতিতে বড়সড় ফাঁক
বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিযোগিতার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, বাংলাদেশ নারী দল তা পায়নি। বাছাইপর্বের পর শক্তিশালী কোনো দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ না পাওয়ায় অভিজ্ঞতার ঘাটতি প্রকট হয়েছে। বিশ্বমানের দলগুলো নিয়মিত শীর্ষ সারির দলের সঙ্গে খেলে নিজেদের প্রস্তুত করে। সেখানে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের প্রস্তুতি সারতে হয়েছে বিকেএসপির অনূর্ধ্ব-১৫ পুরুষ দলের সঙ্গে, যা এমন টুর্নামেন্টের আগে বড্ড বেমানান।
পেস আক্রমণে বৈচিত্র্যের অভাব
ঘরের মাঠে ধীরগতির পিচে স্পিন দিয়ে সাফল্য এলেও বিদেশের দ্রুতগতির উইকেটে শুধু স্পিন-নির্ভরতা জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে স্পিন-নির্ভর। কিন্তু বৈশ্বিক মঞ্চে জয় ছিনিয়ে আনতে যে গভীরতা ও বৈচিত্র্যের পেস আক্রমণ প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে। অভিজ্ঞ মারুফা আক্তারকে বিশ্রাম দেওয়ায় পেস আক্রমণের ধার কমে যায়। স্পিনাররা কিছু সফলতা পেলেও প্রতিপক্ষের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে ধারাবাহিকভাবে চাপে রাখার মতো গতি বা বৈচিত্র্য বাংলাদেশের বোলিংয়ে অনুপস্থিত ছিল। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে পরাজয় প্রত্যাশিত হলেও রেকর্ড ১৯৯ রান করেও ১০ উইকেটে হার স্পষ্ট করে যে ব্যাটিংয়ের সামান্য উন্নতি বিশ্বমানের দলের সামনে যথেষ্ট নয়। এই ব্যর্থতা দেশের নারী ক্রিকেটে বিদ্যমান পরিকাঠামোগত এবং সুযোগের অভাবকে তুলে ধরেছে। ঘরের মাঠে সাফল্য আর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য যে কঠোর প্রস্তুতি, মানসিক দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের নারী দলে এখনো অনুপস্থিত। এই পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করাই এখন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত।
