Logo
×

Follow Us

খেলাধুলা

যেসব বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা

Icon

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ২২:২৩

যেসব বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনা

আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনা। তার আবির্ভাব যেন টের পাচ্ছিল ফুটবল-দুনিয়া। ঠিকই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে ফুটবলকে নতুন করে চেনালেন নিজের দক্ষতায়। মাঠ কাঁপিয়ে বুঁদ করে রাখতেন তামাম বিশ্বকে। ফুটবলপ্রেমীদের প্রিয় হতে সময় নেননি বেশি দিন। কিন্তু এত কিছু ছাপিয়ে বিশ্ব অপ্রস্তুত হলেও দেখেছিল আরেক ম্যারাডোনাকে। মাদক, মাফিয়ার সঙ্গে সঙ্গিনী নিয়ে জেলে পার্টি, সাংবাদিকদের ওপর গুলি, কর ফাঁকি─কোন বিতর্কে জড়াননি দিয়েগো ম্যারাডোনা?

নিম্নবিত্ত পরিবারে দারিদ্র্য ছিলো শৈশবের নিত্যসঙ্গী। ঘরে অর্থাভাব থাকলেও নামের পাশে বসে গিয়েছিল সোনার ছোঁয়া। ফুটবলে অসামান্য দক্ষতার সুবাদে দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা ফ্রাঙ্কোর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘এল পিবে দে ওরো’। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘সোনার বালক’। সোনার চেয়েও উজ্জ্বল প্রতিভা পাশে ছিলো আজীবন। আবার সময়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল বিতর্ক ও বর্ণ।

জীবনের উত্থান-পতনে পাশে থাকা স্ত্রী ক্লদিয়ার সঙ্গে ২০ বছরের দাম্পত্য ভেঙে গিয়েছিল ২০০৪ সালে। সে সময় ম্যারাডোনা স্বীকার করেন, ইতালির নাগরিক দিয়েগো সিনাগ্রার জন্মদাতাও তিনি!

সিনাগ্রার জন্ম ১৯৮৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তখন ম্যারাডোনা-ক্লদিয়ার দাম্পত্যের বয়স ২ বছর। বড় মেয়ে ডালমার জন্ম হতে দেরি আছে আরো ১ বছর। কিন্তু বরাবরই সিনাগ্রার পিতৃত্ব অস্বীকার করে গেছেন ম্যারাডোনা। রাজি হননি ডিএনএ পরীক্ষাতেও।

ম্যারাডোনা তখন স্বীকার করেন, ইতালির ক্লাবে খেলার সময় স্থানীয় তরুণী ক্রিস্টিনা সিনাগ্রার সঙ্গে সম্পর্কের পরেই দিয়েগো সিনাগ্রার জন্ম। বাবার নাম ও মায়ের পদবি নিয়ে বড় হওয়া এই তরুণ নিজেও একজন ফুটবলার। জন্মের ১৯ বছর পর সিনাগ্রা বাবা ম্যারাডোনাকে প্রথম দেখেছিলেন গলফের মাঠে।

দুই মেয়ে ডালমা, জিয়ানিন্নাসহ ম্যারাডোনার সাথে প্রায়ই দেখা যেত সাবেক স্ত্রী ক্লদিয়াকে। এই বিতর্ক ছাড়াও আর কী কী অনুঘটক হয়েছিল কৈশোরের প্রেমিকা ক্লদিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য ভাঙার সময়? সেসব প্রশ্ন প্রকাশ্যে এনে সম্পর্ককে ছিন্ন করার সিলমোহর দেননি ম্যারাডোনা বা ক্লদিয়া কেউই। ক্লদিয়া বলেছিলেন, বিচ্ছেদই তাদের সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। কিন্তু তার পরও ম্যারাডোনা-ক্লদিয়ার সুসম্পর্ক ব্যাহত হয়নি।

আশির দশকে ইতালিতে থাকাকালীন আরো এক বিতর্কে জড়ান তিনি। শোনা যায়, সে সময়েই তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তবে মাদক সেবন নাকি শুরু করেছিলেন স্পেনে, বার্সেলোনার হয়ে খেলার সময়। মাদকাসক্তির প্রভাব প্রচণ্ডভাবে পড়ে তার কেরিয়ারে। ১৯৯১ সালে মাদক সেবনের দায়ে তাকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিত করে নাপোলি। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল বিশ্বকাপের অন্যতম অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায় ম্যারাডোনার। নিষিদ্ধ মাদক সেবনের কারণে ফুটবলের রাজপুত্রকে ফিরে যেতে হয় দেশে।

তবে ম্যারাডোনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ অভিযানের কাছে বাকি সবকিছু মলিন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে তার ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে করা গোল ছাড়া বিশ্বকাপের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। চিরবিতর্কিত সেই গোলের ঠিক ৪ মিনিটের মাথায় এসেছিল আজীবন বন্দিত আর এক পায়ের জাদু। ব্রিটিশ ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে হতভম্ব করে করেন সেই গোল। ফুটবলপ্রেমীরা চোখ বন্ধ করে এখনো দেখতে পান অভিনব সেই গোল।

১৯৮৬ সালের ফুটবল ট্রফি আর্জেন্টিনায় পৌঁছেছিল ম্যারাডোনার পায়ের জাদুতে। ফাইনালে ৩-২ গোলে চূর্ণ হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। পরের বছর ইতালি বিশ্বকাপে তার শোধ নিয়েছিল জার্মানরা। ফাইনালে ১-০ গোলে তাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল ম্যারাডোনার দল।

ম্যারাডোনা আবার ফিরেছিলেন প্রতিযোগিতায়। ২০১০ সালে। তবে এবার মাঠের ভেতরে নয়, পাশেই, কোচ হয়ে। তিনি কোচ ছিলেন আর্জেন্টিনার। আরো একবার তার জাদু দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সারা বিশ্বের ভক্তরা। কিন্তু এবারো অপ্রাপ্তি।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে চূর্ণ করে দেয় জার্মানি। এরপর ম্যারাডোনা বিশ্বকাপে হাজির থেকেছেন শুধুই আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে।

অতিরিক্ত মাদক ও সুরার নেশার পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যাতেও জেরবার হয়েছেন তিনি। ২০০০ সালের পর থেকেই অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালে একবার হৃদরোগেও আক্রান্ত হন। সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কলম্বিয়ায় গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারিও করান তিনি। এরপর তার খাওয়াদাওয়ার ওপর চরম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু সমস্যা থেকেই গিয়েছিল।

২০০৭ সালে বুয়েনস এইরেসের হাসপাতালে চিকিৎসা হয় হেপাটাইটিসের। এরপর থেকে তার শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে ক্রমেই গুজব ছড়াতে থাকে। রটে গিয়েছিল তার মৃত্যুর গুজবও। সে বছরই আর্জেন্টিনার এক টেলিভিশন চ্যানেলে এসেছিলেন ম্যারাডোনা। জানান, তিনি মদপান ছেড়ে দিয়েছেন। গত আড়াই বছর স্পর্শ করেননি মাদক।

জীবনযাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও অসুস্থতা তাকে ছেড়ে যায়নি। ছেড়ে যায়নি বিতর্কও। দর্শক হিসেবেও ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রে। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ গোলে আর্জেন্টিনার নাটকীয় জয়ে তার অশালীন আচরণ এবং আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে সঞ্চালকের প্রতি বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য—সব সময়ই ম্যারাডোনা ছিলেন শিরোনামে।

প্রকাশ্যে মেজাজও হারিয়েছেন বারবার। ১৯৯৪ সালে বুয়েনস এইরেসে নিজের বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন। তার এয়ার রাইফেলের গুলিতে আহত হন চারজন। ঘটনার জন্য ২ বছর ১০ মাসের কারাদণ্ড নির্ধারিত হয়েছিল তার জন্য। ম্যারাডোনার অভিযোগ ছিলো, সাংবাদিকরা তার ব্যক্তিগত পরিসর বিঘ্নিত করেছেন।

ম্যারাডোনার বদমেজাজ ও কটূক্তির শিকার থেকে বাদ যাননি সাধারণ ভক্তরা। একবার খেলায় অসুবিধা হওয়ার জন্য তিনি আঘাত করেছিলেন সমর্থকের হাতে। তার অভিযোগ ছিলো, ওই সমর্থক তার পোস্টার তুলে ধরায় খেলায় সমস্যা হচ্ছিল।

কটূক্তির শিকার থেকে বাদ যাননি লিওনেল মেসিও। পেলের সঙ্গে কথোপকথনে ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, মেসি প্রতিভাবান ফুটবলার হতে পারেন। কিন্তু তার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। নেতৃত্ব দেয়ারও ক্ষমতা নেই মেসির।

বর্ণময় কেরিয়ারে মুখোমুখি হয়েছেন আর্থিক সমস্যারও। ইতালি সরকারের অভিযোগ ছিলো, সে দেশে বহু অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়েছেন ম্যারাডোনা।

শারীরিক বা আর্থিক কোনো সমস্যাই ম্যারাডোনাকে বিতর্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। কলম্বিয়ার কুখ্যাত মাদক মাফিয়া পাবলো এসকোবারের সঙ্গে তিনি পার্টি করেছিলেন জেলের ভেতরেই। হাজির ছিলেন বহু সঙ্গিনীও। অবশ্য ম্যারাডোনার দাবি ছিলো, ফুটবলপ্রেমী এসকোবারের অন্য পরিচয় তিনি জানতেন না।

বর্ণময় জীবন গত ২ বছর ঘন ঘন বিধ্বস্ত হয়েছিল শারীরিক সমস্যায়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তার হার্নিয়া অস্ত্রোপচার হয়। ছিলো লিভারে রক্তক্ষরণের সমস্যাও। চলতি বছরের নভেম্বরে তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন বাড়িতেও। কিন্তু আর ফিরতে পারলেন না চেনা জীবনের পুরোনো ছন্দে।

সেই তামাম বিশ্ব আর অগণিত ভক্তকে বিমর্ষ করে গতকাল নিজ বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ম্যারাডোনা। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি শুধু অদৃশ্য। তবে আর্জেন্টিনার জাতীয় টুপি মাথায় দেয়া ১৬ বছরের কিশোর এখনো রাজপুত্র হয়ে খেলে চলেছেন।

তাকে ঘিরেই বেঁচে থাকে ফুটবলপাগল বাঙালির রূপকথার নটেগাছ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫