প্রতিবাদী মাশরাফি-সাকিব: বিব্রত ক্রিকেট বোর্ড

মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩৯

মাশরাফি ও সাকিব
ক্রিকেটে কোড অব কন্ট্রাক্ট বলে একটা কথা রয়েছে। জাতীয় দলে যারা খেলেন তাদের মিডিয়ার সামনে অনেক ধরনের কথা বলায় বারণ রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ই ক্রিকেটাররা এই নিয়ম মেনে থাকেন।
তবে হঠাৎ হঠাৎ এই নিয়মের ব্যত্যয়ও ঘটে থাকে। যেমন করে ঘটিয়েছেন সাকিব আল হাসান। যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটি বক্তব্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে ক্রিকেট মহলে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে এমন কথা বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের মুখ থেকে আগে সেভাবে শোনা যায়নি। সাকিবের কথাগুলো মিডিয়াতে আসার পরপরই বিসিবির নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে তোপ দাগেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর না নিলেও এখন আর বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে নেই ম্যাশ। তার কথা বলাটাকে খুব বেশি অস্বাভাবিক হিসেবে দেখা হচ্ছে না।
তবে যে ভাষায় মাশরাফি-সাকিব কথা বলছেন, এই ভাষায় তারা কখনোই কথা বলেননি। অনেক অপ্রকাশিত আর না জানা কথাও শোনা গেছে। দু’জনের কথায় একটি বিষয় পরিষ্কার, বহুদিনের পঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই তারা এমনটি বলছেন।
২০১৯ সালে সেই আলোচিত আন্দোলন থেকে শুরু করে সবখানেই ক্রিকেটাররা একমত হয়েই সবকিছু করে থাকেন। সেই আন্দোলনে সাকিব নেতৃত্ব দিলেও পেছনে থেকে সবকিছু করেছেন মাশরাফি। সে সময় বলা হয়েছিল নড়াইল এক্সপ্রেস সবকিছু জানেন, ক্রিকেটারদের দাবির প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এবার যখন সাকিব নিজের ক্ষোভের কথা বলেছে তারপরই মাশরাফির কথা আর বুঝতে বাকি থাকে না এখানেও দু’জন মিলিতভাবেই সবকিছু করছেন। তাদের কথা ক্রিকেটারদের মনের কথা বলেই অনেকটা প্রতীয়মান হচ্ছে। আলোচিত অন্দোলনে বেশকিছু দাবি দাওয়া পূরণ হলেও বাকি রয়েছে অনেককিছু; কিন্তু এতটা আগ্রাসী ভূমিকায় কখনো না দেখতে পাওয়ায় বেশি আশ্চর্য হয়েছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা।
বিসিবি পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন মাশরাফি ও সাকিবের এমন কথাবার্তায় নিজে ও বোর্ড বিব্রত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তাদের দু’জনের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে নাকি তারা প্রস্তুত ছিলেন না। সাকিবের কথার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিসিবি জরুরি বৈঠকে বসেছিল। অনেকেই ধারণা করেছিলেন সাকিবের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও আসতে পারে। আটকে যেতে পারে আইপিএল (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) যাত্রা; কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি।
অনেকটা হঠাৎ করেই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই আয়োজনে খেলতে চলে গেছেন সাকিব। বিসিবি কর্মকর্তারা কার কথায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন সেটাও পরিষ্কার নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে মাশরাফি ও সাকিব দু’জনেই দেখা করেছেন। পরদিন সকালে কাউকে না জানিয়ে কলকাতার বিমানে চেপে বসেছেন। শুধু কি তাই, ৪৮ দিনের ছুটি মঞ্জুর করে তবেই আইপিএলে খেলতে গেছেন জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক।
যেহেতু বিসিবি কর্মকর্তারা চুপসে গেছেন তাহলে বোঝাই যায়, সাকিব ইস্যুটি আপাতত চাপা পড়ে গেছে। তবে সাকিব যতটা রাখঢাক রেখেছেন ততটাই খোলামেলা ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ইনজুরির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা এই সাবেক টাইগার কাপ্তান অনেককিছুই বলতে চান না। হঠাৎ করে যখন টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছিলেন তখনো কিছু বলেননি; কিন্তু এবার বললেন, এমনভাবে বললেন যা শুনতে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না বোর্ড কর্তারা।
ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকফ্রেঞ্জির আয়োজনে ফেসবুকে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে গত ২০ মার্চ সাকিব বিসিবির বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ তোলেন। সাকিব কাঠগড়ায় দাঁড় করান বিসিবির পরিচালক ও দেশের সাবেক দুই অধিনায়ক আকরাম খান ও নাঈমুর রহমানকে। ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খান সাকিবের আইপিএল খেলার এনওসি (অনাপত্তি পত্র) পুনর্বিবেচনা করা হবে বললেও আদতে কিছুই হয়নি।
মাশরাফি তো দু’জন নির্বাচককে একহাত নিয়েছেন। মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও হাবিবুল বাশার সুমনকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন। সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভালো খেলতে পারেননি মাশরাফি। ওই সময়ে নাকি ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে ভক্ত-সমর্থকদের সামনে মাশরাফির ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুই বোর্ডকর্তা টিভি চ্যানেলে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, মাশরাফিকে ভিলেন বানানোর এটাই সময়! কথাগুলো বললেন মাশরাফি নিজেই। এ নিয়ে এক অনলাইন সংবামাধ্যমের সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মাশরাফি। তার কথায় বোর্ড কর্তাদের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে।
নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি কষ্টের বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘ক্যারিয়ারে ভালোমন্দ সবকিছুই দেখেছি। ক্রিকেটে যদি কোনোদিন কষ্ট পেয়ে থাকি, এই একটা জিনিসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। তখন আমি বুঝেছি, অন্যান্য ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে কত কী হয়েছে বা হতে পারে কিংবা হয়। আগে আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি, করতে চাইওনি; কিন্তু আমি যখন জানতে পারলাম যেসব মিডিয়ায় ফোন করেছে, ইংল্যান্ডে বসে (বিশ্বকাপের সময়) আমাদের বোর্ড পরিচালকদের দু’জনের তথ্য আমি জানি, যারা টিভি চ্যানেলে ফোন করে বলেছিলেন, ‘এটিই সুযোগ, আমাদের সামনে সুযোগ আসছে। মানুষের সামনে মাশরাফিকে কালার করে দেন, ভিলেন বানিয়ে দেন’।
বিশ্বকাপে খারাপ খেলার কারণে ভিলেন তো এমনিতে হয়েই ছিলেন ম্যাশ। তখন তো ক্রিকেট বোর্ড তার পাশে দাঁড়ায়নি। মাশরাফি বলেছেন, বোর্ডে এমন কিছু লোক আছে, যাদের জন্য ক্রিকেটের ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি ফ্রিতে বিদেশ ভ্রমণ, ক্রিকেটারদের চরিত্রহনন ছাড়া বোর্ড পরিচালকদের কাজটা কি? বোর্ডের লোকজনই ভেতরের কথা মিডিয়াকে বলে ক্রিকেটারদের চরিত্রহননের চেষ্টা করেন! পাশাপাশি বিসিবি প্রেসিডেন্ট বক্সে ক্রিকেটারদের উলঙ্গ করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন মাশরাফি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাকিব-বিসিবি যে যুদ্ধ চলছে সেখানে জয়টা কার হয়েছে। ক্রিকেটারদের সাথে সম্পর্কটা যে বোর্ড কর্তাদের ভালো যাচ্ছে না, সেটা প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ এতজন সাবেক ক্রিকেটার থাকার ফলে সেখানে তারা খেলোয়াড়দের পক্ষ নেবেন; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হচ্ছে ঠিক উল্টোটা।
মাশরাফির বক্তব্য যদি অযাচিত হতো তাহলে বড় প্রতিবাদ করা হতো। সাকিবের ব্যাপারে করা হলেও মাশরাফির বিষয়ে অনেকটাই চুপ রয়েছেন তারা। ক্রিকেটের ইমেজ হয়তো কিছুটা নষ্ট হয়েছে, তবে যে কথাগুলো জানা প্রয়োজন ছিল, তার অনেকটাই জানা হয়ে গেছে।