
বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ১০ কোচ
শুরুতে ফুটবল খেলা হতো স্রেফ শখের বশে। ধীরে ধীরে সেই শখের ফুটবল হয়ে ওঠে বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস। এরপর প্রচলিত দুনিয়ার ধাঁচে নিখাদ বিনোদনের গণ্ডি পেরিয়ে ফুটবল ‘বাণিজ্য’ অঙ্গনেও পা রেখেছে অনেক আগে। ফুটবল এখন যতটা না বিনোদনের উৎস, তার চেয়েও অনেক বেশি বাণিজ্য লক্ষ্মী। ফুটবল মানেই এখন কাড়ি কাড়ি টাকা। বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনের আকাশে-বাতাসে এখন সত্যিই যেন টাকা ওড়ে!
অদৃশ্য হাওয়ার মতো উড়ে বেড়ানো সেই টাকা ধরতে বিশ্ব বিখ্যাত ব্যবসায়ীরা যুক্ত হয়েছেন ফুটবলে। বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে নামিদামি ক্লাবের মালিকানা কিনে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। এই বাণিজ্যের সূত্রে একদিকে ইউরোপিয়ান নামিদামি ক্লাবগুলোর মালিক-কর্তারা যেমন কামিয়ে নিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা, তেমনি ফুটবলার, কোচদের দামও এখন আকাশচুম্বি। ফুটবল অঙ্গনের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে ফুটবলাররাই এক নম্বরে। ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ-কৌতূহল ফুটবলারদের ঘিরেই।
স্বাভাবিকভাবেই ফুটবলারদের তাই এখন আকাশছোঁয়া দাম। সেই সুযোগে তারকা ফুটবলাররা টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন দু’হাতে। লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, নেইমার, কিলিয়ান এমবাপে, লুইস সুয়ারেজ, রবার্ট লেভান্ডভস্কি, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি বরুইন, হ্যারি কেন, জেরার্ড পিকে, সার্জিও রামোসদের মতো বিশ্ব তারকারা গড়ে তুলেছেন টাকার পাহাড়। বনে গেছেন বিলিয়নিয়ার।
কিন্তু শুধু কি তারকা ফুটবলাররাই বিলিয়নিয়ার? ফুটবলের দুই নম্বর চরিত্র কোচরা একটা সময় ছিলেন চরম নিগৃহিত, অবহেলিত; কিন্তু বাণিজ্য লক্ষ্মীর জোয়ারে সেই কোচরাও আকাশ-সমান দামি। কামিয়ে যাচ্ছেন মোটা দাগে। তারকা ফুটবলারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বসেরা কোচরাও একেকজন নাম লিখিয়েছেন বিলিয়নিয়ারের খাতায়! এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্বসেরা কোচদের আয়-রোজগারের খোঁজ-খবরই জানব!
দুনিয়াজুড়ে এখন লক্ষ-হাজার ক্লাব। সেসব ক্লাব এবং বিভিন্ন দেশের জাতীয় দল, যুব দল, বয়সভিত্তিক দল মিলে কতজন যে এখন কোচিং পেশায় নিয়োজিত। তবে তাদের সবাই ‘দামি’ তকমার অধিকারী নন। কোচিং দক্ষতায় দুনিয়াজুড়ে লক্ষ লক্ষ কোচদের মধ্য থেকে খুব অল্পসংখ্যক কোচই ‘দামি’ তকমাটা অর্জন করতে পেরেছেন। সেই ‘দামি’দের মধ্য থেকে আজ আমরা এমন ১০ জন কোচকে নিয়ে আলোচনা করব, যারা দামিদের মধ্যে সবচেয়ে দামি। মানেটা সোজা, এই প্রতিবেদনে আমরা বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ১০ জন কোচের গল্প জানব। যাদের পারিশ্রমিকের অঙ্কটা শুনলে সত্যিই চোখ বিস্ময়ে কপালে উঠে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত কোচদের সবাই ইউরোপিয়ান ক্লাবের কোচ। জাতীয় দলের কোনো কোচ ‘সেরা ১০’-এ জায়গা করে নিতে পারেননি! কারণটাও স্পষ্ট। ফুটবল বাণিজ্যের প্রধান ক্ষেত্র যেহেতু ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল, কাজেই আয়-রোজগারেও ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর কোচদেরই একচ্ছত্র রাজত্ব। বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের কোচ এবং এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ক্লাবগুলোর কোচদের ঠাঁই সেখানে নেই। এমনকি ফুটবলের অন্যতম উর্বর ভূমি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ক্লাব কোচরাও আয়-রোজগারে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর কোচদের ধারে কাছে নেই!
যাই হোক, এবার চলুন দেখে নিই বর্তমানে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পান কোন ১০ কোচ।
৫০ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটি কোচের দায়িত্বে রয়েছেন। ইংলিশ ক্লাবটিতে তার বার্ষিক পারিশ্রমিক ২৩ মিলিয়ন ইউরো! বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা ২৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ১৩ হাজার ৫২৫ টাকা মাত্র! শুধু বেতন-ভাতা হিসেবেই ম্যান সিটি থেকে বছরে এই টাকা পান গার্দিওলা। ভাবা যায়! এ ছাড়া নানা রকম বোনাস, প্রাইজমানি তো রয়েছেই। সেই ২০১৬ সাল থেকে ম্যানচেস্টার সিটির কোচের দায়িত্বে আছেন গার্দিওলা। বোনাস, প্রাইজমানি বাদ দিয়ে শুধু বেতন-ভাতার বিষয়টিই যদি বিবেচনা করি, তো গত ৫ বছরে ম্যানচেস্টার সিটি থেকে গার্দিওলা কত টাকা আয় করেছেন, একবার হিসাব করুন! ক্যালকুলেটর নিয়ে সঠিক হিসাব বের করার দরকার নেই, চোখ বন্ধ করে মুখস্তই বলে দেওয়া যাচ্ছে, ম্যান সিটিকে কোচিং করিয়েই বিলিয়নিয়ার বনে গেছেন পেপ গার্দিওলা।
আর শুধু তো ম্যান সিটিতে নয়, এর আগে জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখকে ৩ বছর কোচিং করিয়েছেন গার্দিওলা। তার আগে লিওনেল মেসিদের বার্সেলোনায় কোচ ছিলেন ৫ বছর! সব মিলে ১৩ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে গার্দিওলা কত টাকা কামিয়েছেন? উত্তরটা একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।
হোসে মরিনহো (এএস রোমা)
সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের তালিকায় দুই নম্বরে আছেন হোসে মরিনহো, যিনি বর্তমানে ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমার কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে গত মাসে চুক্তিপত্রে সই করা মরিনহো এএস রোমায় কোচিং শুরু করবেন আগামী মৌসুম থেকে। রোমায় তার বার্ষিক পারিশ্রমিক কত হবে সেটাও তাই জানা যায়নি। তবে রোমার দায়িত্ব নেওয়ার আগে ইংলিশ ক্লাব টটেনহামের কোচ ছিলেন। সেই টটেনহামে পাওয়া পারিশ্রমিকের ভিত্তিতেই তিনি আছেন তালিকার দুই নম্বরে। টটেনহামে তার বার্ষিক পারিশ্রমিক ছিল ১৭.৫ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭৯ কোটি ৩৯ লাখ ১২ হাজার ৪৬৫ টাকা!
২০২০ সালের অক্টোবরে টটেনহামের দায়িত্ব নিলেও মরিনহো সেখানে বেশি দিন টিকতে পারেননি। ব্যর্থতার দায়ে এ বছরের এপ্রিলেই তাকে বরখাস্ত করে টটেনহাম। তবে টটেনহামে টিকতে না পারলেও কোচ হিসেবে হোসে মরিনহো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অন্য উচ্চতায়। সেই ২০০০ সালে কোচিং পেশায় নাম লেখানো মরিনহো বর্ণাঢ্য কোচিং ক্যারিয়ারে কোচিং করিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান, চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবে।
সর্বশেষের টটেনহাম, ম্যানইউ বাদ দিয়ে বাকি সব ক্লাবেই পেয়েছেন সাফল্যের দেখা। চেলসির হয়ে প্রথম মেয়াদে এবং ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে তো বিস্ময়কর সাফল্যে ফুটবল দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের অবিশ্বাস্য সাফল্যে অভিভূত হয়ে নিজেই নিজেকে দিয়েছেন ‘স্পেশাল ওয়ান’, ‘ওনলি ওয়ান’ খেতাব। দীর্ঘ ২১ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে বিস্ময়কর সাফল্য যেমন পেয়েছেন, তেমনি দু’হাত ভরে কামিয়েছেন টাকাও। গার্দিওলার অনেক আগেই তিনি বনে গেছেন বিলিয়নিয়ার। সব মিলে কোচিং ক্যারিয়ারে কত টাকা কামিয়েছেন, তার সঠিক হিসাব তিনি নিজেও দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
দিয়েগো সিমিওনে (অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ)
তালিকার তিন নম্বরে আছেন অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের আর্জেন্টাইন কোচ দিয়েগো সিমিওনে। যদিও অন্য একটি গবেষণার মতে, সিমিওনেই বর্তমানে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পান। সেখানে দাবি করা হয়েছে. সব কিছু মিলিয়ে অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদে বর্তমানে সিমিওনের বার্ষিক পারিশ্রমিক ৪৩ মিলিয়ন ইউরো! কিন্তু এই তথ্য ফুটবল দুনিয়ার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য মতে, বর্তমানে সিমিওনের বার্ষিক পারিশ্রমিক ১৫ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ২৫৭ টাকা মাত্র!
২০০৬ সালে কোচিং পেশায় যুক্ত হওয়া সিমিওনে শুরুর দিকে ছোট ছোট ক্লাবগুলোতেই কোচিং করিয়েছেন। তবে হুট করেই ২০১১ সালে অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের মতো ক্লাবের কোচের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। এক সময় অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে খেলতেন। সেই সূত্রেই স্প্যানিশ ক্লাবটির দায়িত্ব নেন তিনি। সেই থেকে অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদেই আছেন। দায়িত্ব নেওয়ার সময় অবশ্য অ্যাতলেতিকোও সাধারণ মানের একটা ক্লাবই ছিল। তবে সিমিওনের হাতের ছোঁয়ায় বছর দুয়েকের মধ্যেই অ্যাতলেতিকো নাম লেখায় বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোদের কাতারে। বর্তমানে নিশ্চিতভাবেই সিমিওনের অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর একটি। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনাকে পেছনে ফেলে সিমিওনের অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ জিতে নিয়েছে স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপা। ক্লাবের উন্নতির পাশাপাশি কোচ সিমিওনের উন্নতিও হয়েছে। বেড়েছে পারিশ্রমিকের অঙ্ক। সব মিলে শুধু অ্যাতলেতিকোর কোচ হিসেবেই তিনি ঢুকে গেছেন বিলিয়নিয়ারের তালিকায়।
ফাবিও ক্যানাভারো (গুয়াংঝু এভারগ্রান্ডে)
তালিকায় জায়গা করে নেওয়া চতুর্থ নামটি সত্যিই বড় এক বিস্ময়। ফাবিও ক্যানাভারোর খেলোয়াড় হিসেবে কতটা উঁচু মানের ছিলেন, সেটা ফুটবল দুনিয়া ভালো করেই জানে। অমিয় প্রতিভা আর দক্ষতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারদের কাতারে। অধিনায়ক হিসেবে ২০০৬ সালে ইতালিকে চতুর্থ বারের মতো জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ মঞ্চে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পুরস্কার হিসেবে সে বছরই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিফেন্ডার হিসেবে জিতেছিলেন ব্যালন ডি’অর। তবে খেলোয়াড় হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেলেও কোচ হিসেবে এখনো ক্যানাভারো অখ্যাত।
বিশ্বমানের কোচের তকমা এখনো গায়ে লাগেনি। তারপরও তিনি জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের ৪ নম্বরে। কারণ, ইউরোপে নয়, তিনি বর্তমানে কোচিং করাচ্ছেন ‘ফুটবলারদের বৃদ্ধাশ্রম’ হিসেবে পরিচিত চীনের সুপার লিগে। কোচ হয়েছেন চীনা ক্লাব গুয়াংঝু এভারগ্রান্ডের। ক্যানাভারোর তারকাখ্যাতি কাজে লাগানোর জন্যই তাকে বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিকে কোচ করেছে চীনা ক্লাবটি। গুয়াংঝু এভারগ্রান্ডে ৪৭ বছর বয়সী ক্যানাভারোর বার্ষিক পারিশ্রমিক ২১.১৫ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১২৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪১৫ টাকা। শুধু বেতন-ভাতা হিসেবেই বছরে এ টাকা পান ক্যানাভারো। অন্যান্য বোনাস বা বিশেষ ভাতার বিষয়টি হিসেবেই আনা হয়নি।
খেলোয়াড়ি জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন ইউরোপের গরম মঞ্চে। খেলেছেন নাপোলি, পার্মা, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস, রিয়াল মাদ্রিদের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোতে। তবে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় যোগ দিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লাব আল-আহলিতে। এই আল-আহলিতেই তার কোচিং জীবনের শুরু। খেলা ছেড়ে ২০১৩ সালে দায়িত্ব নেন আল আহলির সহকারী কোচের। এরপর এ ক্লাব ও ক্লাব ঘুরে ২০১৭ সালে দায়িত্ব নিয়েছেন গুয়াংঝুর। চীনা ক্লাবটিতে নাম লিখিয়েই তিনি বনে গেছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের একজন। মজার ব্যাপার হলো, গুয়াংঝুতে ফাবি ক্যানাভারোর সহকারীর দায়িত্বে আছেন তারই আপন ছোট ভাই পাওলো ক্যানাভারো।
জিনেদিন জিদান (সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ কোচ)
ফরাসি এই ফুটবল মহানায়ককে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, দুনিয়া জানে। কোচ হিসেবেও এরই মধ্যে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। অখ্যাত কোনো ক্লাব নয়, তিনি কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটাই করেছেন বিশ্বসেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবে। এখনো পর্যন্ত এক রিয়ালের কোচ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ৫ মৌসুমের মতো! প্রথম মেয়াদে তিনি অবিশ্বাস্য সফলতা দেখিয়েছেন। আড়াই বছরের দায়িত্ব পালনকালেই রিয়াল মাদ্রিদকে জিতিয়েছেন ৩ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। গড়েছেন অবিশ্বাস্য এক রেকর্ড। কারণ, ইতিহাসে আর কোনো কোচই কোনো ক্লাবকে টানা তিন বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে পারেননি।
দ্বিতীয় মেয়াদে অবশ্য অতটা সফল নন। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও ক্লাবকে জেতাতে পারেননি কিছুই। তাইতো ব্যর্থতার দায় মানায় নিয়ে রিয়ালের কোচের পদ থেকে দ্বিতীয় বারের মতো সরে দাঁড়িয়েছেন জিদান। মানে তার নামের আগে ‘সাবেক’ শব্দটি বসে গেছে। তবে সরে দাঁড়ালেও রিয়ালের সঙ্গে সর্বশেষ চুক্তির হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের তালিকায় ৫ নম্বরে রয়েছেন। সর্বশেষ রিয়ালে তার বার্ষিক পারিশ্রমিক ছিল ১২ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা ১২৩ কোটি ৯০ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭০ টাকা মাত্র! রিয়ালের দায়িত্ব ছেড়ে জিদান নতুন করে এখনো কোনো ক্লাবে নাম লেখাননি। তবে রিয়াল ঠিকই জিদানের উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ইতালির কিংবদন্তি কোচ কার্লো আনচেলত্তিকে।
মরিসিও পচেত্তিনো (পিএসজি)
তালিকার ৬ নম্বরে জায়গা করে নেওয়া নামটিও বেশ চমক জাগানিয়া। কারণ, কোচ হিসেবে মরিসিও পচেত্তিনো এখনো পর্যন্ত তেমন সাফল্যের ছোঁয়া পাননি। তবে কোচিং দক্ষতা হিসেবে এরই মধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন ৪৯ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন। সেই সুনামের পুরস্কার হিসেবেই এ বছরের জানুয়ারিতে তারকাখচিত পিএসজির কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। ফরাসি ক্লাবটির কোচ হয়েই মরিসিও পচেত্তিনো ঢুকে গেছেন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের তালিকায়।
গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী নেইমার-এমবাপেদের পিএসজিতে পচেত্তিনোর বার্ষিক বেতন ১১.৩০ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৫ টাকা! আর্জেন্টাইন এই কোচ কোচিং পেশায় নাম লিখিয়েছেন ২০০৯ সালে, স্প্যানিশ ক্লাব এসপানিওলের হয়ে। সেখান থেকে ইংলিশ ক্লাব সাউদাম্পটন, টটেনহাম হয়ে বর্তমানে তারকাখচিত পিএসজিতে। যে ক্লাবটি নেইমার, কিলিয়ান এমবাপে, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, মারকুইনহোদের মতো তারকাদের কিনে উঠে এসেছে বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর কাতারে। সেই ক্লাবের কোচ হয়ে মরিসিও পচেত্তিনোও বনে গেছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত কোচদের একজন।
অ্যান্তোনিও কন্তে (ইন্টার মিলান)
ফাবিও ক্যানাভারো ৪ নম্বরে এবং মরিসিও পচেত্তিনোর ৬ নম্বরে জায়গা পাওয়াটা যেমন বিস্ময়ের, তেমনি বিস্ময়ের ৭ নম্বরে থাকা অ্যান্তোনিও কন্তের নামটিও। তবে কন্তের ৭ নম্বরে থাকাটা উল্টো কারণে বিস্ময়ের। কারণ. সাফল্য-দক্ষতায় অ্যান্তোনিও কন্তে গত প্রায় এক দশক ধরেই বিশ্বসেরা কোচদের একজন। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে তিনি গত এক দশকে লিগ শিরোপাই জিতেছেন ৫টি। জুভেন্টাসকে টানা তিন বার (২০১১-১২ থেকে ২০১৩-২০১৪) জিতিয়েছেন ইতালিয়ান সিরি আ’র শিরোপা। এরপর দুই বছর ইতালি জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৬ সালে আবার ফিরে আসেন ক্লাব ফুটবলে। দায়িত্ব নেন ইংলিশ ক্লাব চেলসির। নিজের কোচিং দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে নিজের প্রথম মৌসুমেই চেলসিকে উপহার দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা।
সেই চেলসি ছেড়ে ২০১৯ সালে আবার ফিরে এসেছেন স্বদেশী লিগ ইতালিয়ান সিরি আ’তে। দায়িত্ব নিয়েছেন ইন্টার মিলানের। তো ৩ বছরের মাথায় ইন্টার মিলানেও পেয়েছেন লিগ শিরোপা সাফল্যের দেখা। সিরি আ’তে জুভেন্টাসের একচ্ছত্র রাজত্বে জানা দিয়ে সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে শিরোপা জিতেছে কন্তের ইন্টার মিলান। এর আগে টানা ৯ মৌসুম লিগ শিরোপাটা জিতেছে জুভেন্টাস। ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো সমৃদ্ধ সেই জুভেন্টাসের কাছ থেকে লিগ শিরোপা ছিনিয়ে আনাটা সহজ ছিল না। তবে কোচ কন্তের জাদুর ছোঁয়ায় ইন্টার মিলান এবার অতি সহজেই সেই অসাধ্য সাধন করেছে।
শুধু কি জুভেন্টাস, চেলসি, ইন্টার মিলানের হয়ে লিগ শিরোপা জেতা। এর আগে ২০০৯ সালে ইতালিয়ান ক্লাব বারির হয়ে সিরি বি-এর শিরোপাও জিতেছেন কন্তে। সব মিলে কোচ হিসেবে কন্তে শিরোপা জিতেছেন ১০টি। শিরোপা সাফল্যের মাপকাঠিতে গত এক দশকে তার চেয়ে ওপরে কেবল পেপ গার্দিওলা ও জিনেদিন জিদান। এই শিরোপা সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত কোচদের তালিকায় কন্তের নামটা আরও উপরেই থাকার কথা ছিল! তবে ৭ নম্বরে জায়গা পাওয়াটাও কম কথা নয়। বর্তমানে ইন্টার মিলানে তার বার্ষিক পারিশ্রমিক ১১ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৩ কোটি ৫৮ লাখ ৪১ হাজার ৩৬৪ টাকা! ৫১ বছর বয়সী কন্তে কোচিং পেশায় আছেন ২০০৬ সাল থেকে। মানে কোচ হিসেবে তিনি অনেক আগেই ঢুকে গেছেন বিলিয়নিয়ারের তালিকায়। গত এক দশক ধরেই যে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন বড় বড় ক্লাবের।
ইয়ুর্গেন ক্লপ (লিভারপুল)
তালিকার ৮ নম্বরে রয়েছেন লিভারপুলের জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। শিরোপা সাফল্য হয়তো খুব বেশি নেই। তবে ৫৩ বছর বয়সী ক্লপ কোচ হিসেবে নিশ্চিতভাবেই বর্তমানের বিশ্বসেরাদের একজন। সেই ২০০১ সাল থেকে কোচিং পেশায় আছেন। দীর্ঘ ২১ বছরে তিনি মোট ৩টি ক্লাবের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানে যেখানেই কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন, কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। জার্মান ক্লাব মেইঞ্জে কাজ করেছেন দীর্ঘ ৮ বছর। এরপর বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের ডাগআউট সামলেছেন ৭ বছর। ডর্টমুন্ড ছেড়ে ২০১৫ সালে দায়িত্ব নিয়েছেন ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের। এখানেও এরই মধ্যে ৬ বছর কাটিয়ে ফেললেন।
আরও কয় বছর অ্যানফিল্ডে থাকতে পারবেন, সেটি ভবিষ্যতেই জানা যাবে। তবে তার হাত ধরেই এক সময় বিশ্ব ক্লাব ফুটবলে রাজত্ব করা লিভারপুল আবার নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে। তার হাত ধরেই ২০১৯-২০ মৌসুমে দীর্ঘ ৩০ বছর পর ইংলিশ ক্ষিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছে লিভারপুল। তার হাত ধরেই অল-রেডরা দীর্ঘ ১৪ বছরের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছে ২০১৮-১৯ মৌসুমে। তার আগের মৌসুমেই উঠেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। মানে নিজের হাতযশের মাধ্যমে ক্লপ হারিয়ে যাওয়া লিভারপুলকে আবার বিশ্বসেরা রূপে ফিরিয়েছেন। তার আগে ডর্টমুন্ডকে জিতিয়েছেন দুটি লিগ শিরোপাসহ ৪টি শিরোপা।
উপরোক্ত এই তথ্যগুলোই বলছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত কোচদের তালিকায় ক্লপের জায়গা করে নেওয়াটা স্বাভাবিকই। গণমাধ্যমের গবেষণায় উঠে এসেছে, লিভারপুলে বর্তমানে ক্লপের বার্ষিক বেতন ১০.৫ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০৮ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ২১০ টাকা! শুধু বেতন হিসেবেই যার পারিশ্রমিক এত টাকা, ২১ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে তিনি বিলিয়নিয়ার বনে গেছেন, সেটি তো অনুমেয়ই।
কার্লো আনচেলত্তি (রিয়াল মাদ্রিদ)
তালিকার ৯ নম্বরে আছেন বর্তমানে রিয়াল মাদ্রিদের কোচের দায়িত্ব নেওয়া কার্লো আনচেলত্তি। তবে রিয়ালের কোচ হিসেবে নয়, তালিকায় জায়গা পেয়েছেন ইংলিশ ক্লাব এভারটনের কোচ হিসেবে! জিনেদিন জিদান সদ্যই সরে যাওয়ার পর আনচেলত্তিকে দ্বিতীয়বারের মতো কোচ করেছে রিয়াল। মাদ্রিদের ক্লাবটিতে আনচেলত্তির বেতন কত হবে, সেটি এখনো জানা যায়নি। তবে ইংলিশ ক্লাব এভারটনে সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে তার বার্ষিক বেতন ছিল ৮ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা ৮২ কোটি ৬০ লাখ ৬৬ হাজার ৪৪৬ টাকা! বিশ্বসেরা রিয়ালে আগামী মৌসুমে তার বেতনের অঙ্কটা যে আরও বড় হবে, সেটি স্পষ্টই।
যাই হোক, অভিজ্ঞতা, সফলতা, দক্ষতায় ৬১ বছর কার্লো আনচেলত্তি নিশ্চিতভাবেই বর্তমানের সেরা কোচদের তালিকায় উপরের দিকে। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে ক্লাব কোচিং পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। দীর্ঘ ২৬ বছরে ভিন্ন ১০টি ক্লাবের দায়িত্ব সামলেছেন। সেই ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে জুভেন্টাস, এসি মিলান, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, পিএসজি, নাপোলির মতো বিশ্বসেরা ক্লাবও। কোচিং ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়টাই তিনি কাজ করেছেন বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোতে। পেয়েছেন সাফল্যের দেখাও। এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নিলেন দ্বিতীয় বারের মতো। এর আগেও দুই বছর (২০১৩-২০১৫) রিয়ালের কোচ ছিলেন তিনি। সর্বশেষ এভারটন ঘুরে আবার তিনি রিয়ালে।
সব মিলে বর্ণাঢ্য কোচিং ক্যারিয়ারে তিনি শিরোপা জিতেছেন ২০টির মতো। তার চেয়েও বেশি কামিয়েছেন টাকা। বরাবরই যেহেতু নামাদামি ক্লাবের কোচ ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই তার বেতনও ছিল বেশি। সাফল্য-খ্যাতির শীর্ষে বিচরণ করা কার্লো আনচেলত্তি অনেক আগেই যে বিলিয়নিয়ারদের ক্লাবের সদস্য বনে গেছেন সেটি স্পষ্ট।
হ্যান্সি ফ্লিক (বায়ার্ন মিউনিখ)
তালিকার ১০ নম্বর নামটিও নিশ্চিতভাবেই বড় চমক। কারণ, কোচ হিসেবে নিজ দেশ জার্মানির বাইরে খুব বেশি নাম কামাতে পারেননি হ্যান্সি ফ্লিক। পুরো নাম হ্যানস ডিয়েতের ফ্লিক। তবে সংক্ষেপে হ্যান্সি ফ্লিক নামেই পরিচিত তিনি। যাই হোক ৫৬ বছর বয়সী এই জার্মান ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই সহকারী কোচের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালেও তিনি জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে সহকারী কোচ ছিলেন। তো ২০১৯ সালেই তিনি সহকারী থেকে পদোন্নতি পেয়ে বায়ার্ন মিউনিখের মূল দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব লাভ করেন। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও তিনি বায়ার্নের কোচই ছিলেন। তবে তিনি এখন আর বায়ার্নের কোচ নন। কদিন আগেই ক্লাব বায়ার্ন ছেড়ে জার্মানির জাতীয় দলের কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নিজের সাবেক গুরু জোয়াকিম লো’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তিনি।
জার্মান জাতীয় দলে তার পারিশ্রমিক কত হবে, সেটা হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে গত মৌসুমটিতেও বায়ার্ন মিউনিখে তার বার্ষিক পারিশ্রমিক ছিল ৮ মিলিয়ন ইউরো। মানে কার্লো আনচেলত্তির সমান। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮২ কোটি ৬০ লাখ ৬৬ হাজার ৪৪৬ টাকা। বায়ার্নের হয়ে দুই বছরেই দুটি লিগ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ ৭টি শিরোপা জিতেছেন হ্যান্সি ফ্লিক। মানে মূল কোচ হিসেবে তার শুরুটা অবিশ্বাস্য। এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের ধারা তিনি জার্মানির জাতীয় দলের হয়েও অব্যাহত রাখবেন, এই আশাতেই তাকে জাতীয় দলের কোচ করেছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারবেন কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে অখ্যাত হ্যান্সি ফ্লিক যে দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে উঠছেন, সেটি দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।