টিম ম্যানেজমেন্টের সবাই মিলেই আমাকে বাদ দিয়েছেন: মুশফিকুর রহীম

মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৫:৫৬

মুশফিকুর রহীম
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের পাশাপাশি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের শীতল সম্পর্কের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
টি-টোয়েন্টি সিরিজে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাচকদের পক্ষ থেকে বলা হলেও পরদিন মুশফিক বলেছেন উল্টো কথা। তার সঙ্গে কোনো আলাপ না করেই বিশ্রামের কথা বলা হয়েছে। এরপর সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলেন তিনি। এরপরই বিসিবির পক্ষ থেকে তাকে ডেকে পাঠিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা না বলার নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। বিসিবি-মুশফিকের মধ্যে যা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটিও তাকে ডাকার মধ্যে শেষ করা হয়েছে। অথচ পাকিস্তানের বিপক্ষে তার শততম টি-টোয়েন্টি খেলা হয়ে যেত। তবে যে কথাগুলো মুশফিক বলেছেন তারই সার সংক্ষেপ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল।
অনেকটা অপ্রতাশিতভাবে জাতীয় দল থেকে আপনার বাদ পড়ার পর বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
দেশের জার্সিতে খেলা খেলোয়াড়দের সবসময়ই একটা দায়বদ্ধতা থাকে। খেলোয়াড় হিসেবে সবারই উত্থান-পতন থাকে। এবার অনেকটা লম্বা সময় পর বাদ পড়লাম। বিশ্বকাপে নিজের প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারিনি এটা তো সত্য। আর সে কারণে যদি বাদ দিয়ে থাকে, তাহলে খেলোয়াড় হিসেবে বিষয়টিকে আমি খুব পজিটিভলি দেখছি। সামনে টেস্ট সিরিজ থাকায় সেটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। টি-টোয়েন্টি সিরিজ যেখানে মাত্র দুদিন সময় পেতাম, সেখানে এখন ১০/১২ দিন সময় পাচ্ছি।
অথচ চারদিকে গুঞ্জন ছিল, আপনি নিজে থেকেই নাকি বিশ্রামের আবেদন করেছিলেন?
না বিষয়টি সত্যি নয়। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমি এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কাউকে বলার প্রয়োজন হবে। করোনা পরিস্থিরি কারণে যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য টানা ৫/৬ মাস টানা খেলাটা বেশ কঠিন। এরপরও বলতে চাই, এখনও আমি একটা সিরিজে বিশ্রাম নেওয়ার মতো পর্যায়ে যাইনি। ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে সবার জন্যই হতাশার একটি বিশ্বকাপ গেছে। সেদিক থেকে আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এই তিনটি টি-টোয়েন্টি সিরিজে ম্যাচে সুযোগ পেলে গত আসরের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারব। অনেকে মনে করতে পারেন আমি সুযোগ পাইনি বলে এমন কথা বলছি; কিন্তু আমি মনে করি যারা দলে সুযোগ পেয়েছেন তারা সবাই জাতীয় দলের জন্য যোগ্য। দলের জন্য আমরা শুভকামনাও থাকল।
একজন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স বিবেচনা আনতে একটি বিশ্বকাপ কতটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়?
নানা কারণে একজন খেলোয়াড়ের একটা টুর্নামেন্ট কিংবা বিশ্বকাপের মতো আসর খারাপ যেতেই পারে। সেখানে সর্বোতভাবে মূল্যায়নের সুযোগটা আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বকাপ সবসময়ই বড় ইভেন্ট হিসেবে পরিচিত। এ রকম ইভেন্টে কেউ ভালো করবে আবার কেউ খারাপ করবে, এটাকে আমি স্বাভাবিক মনে করি। দল হিসেবেও এমনটি হতে পারে বলে মনে করি। যেমন ভারতের মতো দল এবার সেমিফাইনালেও খেলতে পারেনি। তবে একদিক থেকে বলতে পারি, আমি যতগুলো বিশ্বকাপ খেলেছি, এই বিশ্বকাপে তুলনামূলক ভালো পারফরম্যান্স হয়েছে। যদিও সেটা আমার প্রত্যাশার ধারে কাছেও যেতে পারেন। বাদ পড়ার বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। এখানে কোনো কারণ খুঁজতে চাইছি না। তবে একটি আসর দিয়ে একজনকে বিবেচনা করা যায় না।
বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের পর পাকিস্তান সিরিজে টি-টোয়েন্টি দলকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। অনেকের কাছে এটি নতুন পথচলা শুরু। বিষটিকে কীভাবে দেখছেন?
টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি যেখানেই খেলেন না কেন অভিজ্ঞ হলে খেলাটা সহজ হয়ে যায়। তবে বিসিবির বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি আমি। টি-টোয়েন্টিতে আমরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারিনি। কয়েকটি ইনিংস বা ম্যাচে হয়তো ভালো খেলেছি, তবে সেটি দীর্ঘমেয়াদে কিংবা ধারাবাহিকভাবে হয়নি। আমি তো মনে করি, টি-টোয়েন্টিতে এখনো উন্নতির আরও অনেক জায়গা রয়েছে। আমি যখন সেরাটা দিতে পারব না, আমার জায়গায় অন্য কেউ আসবে এটাই স্বাভাবিক। পারফরম্যান্সই যদি বাদ দেওয়ার কারণ হয়, তাহলে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে স্বাগত জানাতে হবে। এরপর জাতীয় দলের টি-টোয়ন্টি না থাকলেও বিপিএল, প্রিমিয়ার রয়েছে। মন থেকে চেষ্টা করলে টি-টোয়েন্টিতে ভালো ফল আসবে।
‘বিশ্রাম’ নিয়ে যা বলা হয়েছে দল ঘোষণার আগে কি নির্বাচকদের সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছে?
দল ঘোষণার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আমি ‘এভেইলেবেল’ কিনা। আমি তখন বলেছি, অবশ্যই আমি ‘এভেইলেবেল’। দলে থাকব কি থাকব না, সেটা আমার কখনোই আমার হাতে থাকে না। আমি খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকলেও তারা মনে করেছে, এই টি-টোয়েন্টিতে আমাকে তাদের ওই রকম প্রয়োজন নেই। তবে কথা বলে বাদ দেওয়া হয়নি।
অথচ আপনি বারবার বলছেন যে আপনাকে বিশ্রাম নয় বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তো ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে?
আগে যেমন বলেছি ঠিক তেমনি আমি এখনো বলছি, আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সত্যিকারের সৎ ও সত্যি ভাবনাটাই সবসময় বলা উচিত। দলের আগে যেমন তেমন দেশের আগেও তো কেউ থাকে না। সেখানে আমি তো নগণ্যতম একজন খেলোয়াড় মাত্র। আমি সবার সামনেই বিষয়টি পরিষ্কার করেছি।
আপনার বাদ পড়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আগে থেকেই একটা ধারণা ছিল। অনেক পত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। এটি কি নির্বাচকদের অন্য কারো সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়?
নির্বাচকদের পক্ষ থেকে আমাকে বলেছে, নির্বাচক কমিটি, টিম ম্যানেজমেন্ট, হেড কোচ ও টিম ডিরেক্টরসহ সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আমাকে রাখা হবে না দলে। সেটা তো তারাই পরিষ্কার করেছে।
টি-টোয়েন্টিতে নতুনদের বেশি করে সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে কি নির্বাচকরা সিনিয়রদের বাদ দেওয়ার বার্তা দিয়েছে বলে আপনার কাছে মনে হয়?
এই বিষয়টি নিয়ে বলা আমার জন্য বেশ কঠিন আর বিব্রতকর। যারা গত ৬-৭ বছর ধরে খেলেছে, তারা জুনিয়র আর আমরা ১৫ বছর ধরে খেলছি, সে কারণেই আমরা সিনিয়র। এভাবে বলা সহজ হলেও আমার কাছে ভাবনাটা বেশ কঠিন। এই বিশ্বকাপে হয়তো বা দেখেছেন টি-টোয়েন্টির গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেশিরভাগ দল অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের কতটা গুরুত্ব দেয়। আমাদের দল সেখান থেকে কিছুটা ভিন্ন পথেই হেঁটেছে। ২-৩টি ম্যাচ খারাপ খেললে তাদের কাছে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। আমার কাছে তো মনে হয়, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা যে কোনো সংস্করণেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটি টি-টোয়েন্টি কিংবা টেস্ট যেখানেই হোক।
খেলোয়াড়দের বাইরের বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামানোর জন্য বলা হলেও আপনারা কিন্তু এদিকে বেশি মজেছেন। এটি কি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়েছে?
এটা সম্পর্র্কে আমরা আরও আগে থেকেই ভালোভাবেই জানি। আমরা যেসব কথা বলেছি, তাতে হয়তো অনেকে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ওই সময়ে আমরা এত চাপে থাকি যে কে কী বলল, সেটা শুনে ধরে রেখে সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় পাই না। তবে খেলার সময় আমার কথায় যদি ফিরে আসেন, আমি মানুষ হিসেবে এমন একটা দিকের ইঙ্গিত করেছি, যা পুরো জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের যেন একটু আয়নার সামনে দেখি। সেদিক থেকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে থাকলে এটা সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না আর বলারও কিছু নেই এখানে।
অথচ বিশ্বকাপে যাবার আগে আপনারা বলেছিলেন, বাংলাদেশের এবার সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা রয়েছে?
যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তাতে করে সেমিফাইনালে খেলতে পারতাম। আসলে একটা লক্ষ্য নিয়ে তো বিশ্বকাপের মতো আসরে যেতে হয়। আমরা শেষ চারে খেলার লক্ষ্যটা নির্ধারণ করেছিলাম। এই যেমন শ্রীলঙ্কা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের বিপক্ষে দুটি ক্লোজ ম্যাচ হেরেছি। সবাই বলছেন, এ দুটি ম্যাচ জেতা অবশ্যই উচিত ছিল। এ রকম ম্যাচ যখন জিতবেন না, স্বাভাবিকভাবে ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা আর স্বাভাবিক থাকে না। খেলোয়াড়দের মানসিক অবস্থা যেমন খারাপ হয়ে যায় ঠিক তেমনি দেখা দেয় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও। হয়তো একটা ম্যাচ জিতলে পরিস্থিতি ভালো হতে পারত।
ওয়ানডেতে সমীহ করা দল হলেও টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ কেন এত পিছিয়ে?
টি-টোয়েন্টি খেলার মতো পাওয়ার হিটার কিংবা জোরে মারা খেলোয়াড়ের সংখ্যা খুব বেশি নেই আমাদের। নতুন নতুন খেলোয়াড় উঠে না আসাটাও একটা বড় কারণ বলে মনে হয়। আর মিরপুরে যে ধরনের উইকেটে খেলা হয়, তাতে করে নেতিকবাচক প্রভাব পড়ছে খেলার মধ্যে। আমাদেরকে উইকেট বানানোর ক্ষেত্রে স্পোর্টিংয়ের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। যেখানে বোলারদের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানরা সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই যেমন ২০১২ এশিয়া কাপের আগে বিপিএলে সেরা উইকেট ছিল। ওই টুর্নামেন্টের পর এশিয়া কাপে আমরা রানার্সআপ হই। ম্যাচগুলোতে ধারাবাহিক ছিলাম আমরা, ভারতের বিপক্ষে ২৯০ তাড়া করে জিতেছি। একটা ভালো উইকেট তৈরি করলে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে সেটিকে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।