-61c196d216461.jpg)
অলিম্পিকে অংশ নেওয়া তারকারা
শেষ পর্যন্ত অলিম্পিককে দমিয়ে রাখতে পারেনি করোনা। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত এই ক্রীড়াযজ্ঞের ৩১তম আসরটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে; কিন্তু মরণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পূর্ব ঘোষিত সূচিতে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। টুর্নামেন্ট পিছিয়ে দেওয়া হয় এক বছর। তবে মহামারির প্রকোপ না কমায় এবারও (২০২১ সালে) টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। আয়োজক দেশ জাপানের বেশির ভাগ মানুষই এই মহামারির মধ্যে অলিম্পিক আয়োজনের বিরোধী ছিল।
কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি, বিরোধিতা উপেক্ষা করে অলিম্পিক ঠিকই ২৩ জুলাই শুরু হয়ে ৮ আগস্ট সফলভাবে শেষ হয়েছে। তবে শেষ হলেও তার রেশ এখনো রয়েই গেছে। বিশেষ করে পদকজয়ী তারকাদের ঘিরে এখনো উৎসব চলছে নিজ নিজ দেশগুলোতে। যারা একটু বেশি আলো ছড়িয়েছেন, তাদের ঘিরে তো উন্মাদনাটা চলছে বিশ্বজুড়েই।
অলিম্পিকের ৩১তম আসরটিতে অংশ নিয়েছিল আইওসির সদস্যভুক্ত ২০৬ সদস্য দেশের ১১ হাজার ৪৮৩ অ্যাথলেট। এই অ্যাথলেটরা ৩৩টি খেলার ৫০টি ডিসিপ্লিনের মোট ৩৩৯টি ইভেন্টে লড়াই করেছে। আরও একটু স্পষ্ট করে বললে- সোনা, রুপা, ব্রোঞ্জ মিলিয়ে মোট ১০১৭টি পদকের লড়াইয়ে নেমেছিলেন ১১ হাজার ৪৮৩ জন অ্যাথলেট। তবে পদক মোট ১০১৭টি হলেও পদক গলায় ঝুলিয়েছেন সব মিলে ২১৭৫ জন অ্যাথলেট। ১০১৭টি পদক ২১৭৫ জনে জেতেন কীভাবে, বিস্ময়ে চোখ কচলানোর আগে জেনে নিন, ৩৩৯টি ইভেন্টের অনেক ইভেন্টই দলীয়। দলগত ইভেন্টগুলোতে জয়ী দেশের পদক ধরা হয় একটি। তবে ব্যক্তিগতভাবে পদক পান দলের সবাই। ফুটবলের কথাই ধরা যাক। বিজয়ী দেশ হিসেবে সোনা পায় একটি দেশ। অথচ দলের ২০ জনই সোনার পদক গলায় ঝুলান। ফলে ৩৩৯ ইভেন্টে ১০১৭টি পদক হলেও আয়োজকদের মোট পদক (স্মারক) বিতরণ করতে হয়েছে ২৪০২টি।
দেশ হিসেবে পদক জয়ে টোকিও অলিম্পিকে সবচেয়ে সফল যুক্তরাষ্ট্র। ৩৯টি সোনা, ৪১টি রুপা ও ৩৩টি ব্রোঞ্জ মিলিয়ে তারা মোট পদক জিতেছে ১১৩টি। ৩৮টি সোনা, ৩২টি রুপা ও ১৮টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৮৮ পদক জিতে দ্বিতীয় হয়েছে চীন। ২৭ সোনা, ১৪টি রুপা ও ১৭টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৫৮ পদক জিতে তৃতীয় হয়েছে স্বাগতিক জাপান। যাই হোক, এসব পরিসংখ্যান নয়, আমাদের এই প্রতিবেদনের বিষয় অলিম্পিকের তারাদের তারারা। মানে টোকিওতে বিশেষ আলো ছড়িয়েছেন যারা। অলিম্পিকে পদকজয়ী প্রত্যেকেই বিশ্ব তারকা। তবে তাদের মধ্যে যারা বিশেষ কীর্তি গড়েছেন, স্থাপন করেছেন অনন্য নজির, গেয়েছেন মানবতার জয়গান- এই প্রতিবেদনের উপজীব্য তারাই।
বোল্টের কীর্তি ছুঁয়েছেন ‘মেয়েদের বোল্ট’ থম্পসন হেরা
৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলের দৌড় যখন শেষ হলো, সমস্ত ক্যামেরার ফোকাস গ্রাস করে ফেলল এলাইনে থম্পসন হেরাকে; কিন্তু এ কি! এ তো দেখি প্রাণহীন এক মূর্তি। দুই হাত দিয়ে কোমর ধরে, মাথাটা একটু উঁচু করে দৃষ্টি ফেলে আছেন আকাশের দিকে। কোনো নড়াচড়া নেই। যেন টোকিওর দর্শকহীন জাতীয় স্টেডিয়ামে মুহূর্তেই বিশ্ববরেণ্য কোনো ভাস্কর আপন মহিমায় নিখুঁত এক মূর্তি তৈরি করে দিয়েছেন! সেকেন্ড আগে যিনি চিতা বাঘের চেয়েও ক্ষিপ্রতার রূপ দেখিয়েছেন বিশ্বকে, সেই এলাইনে থম্পসন হেরার মুহূর্তেই এমন মূর্তি বনে যাওয়ার কারণ কী?
কারণটা স্পষ্টই, ১২৫ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে যে কীর্তি কখনো দেখেনি নারী অ্যাথলেটিকস, সেই কীর্তির জন্ম দিয়েছেন। ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে এক অলিম্পিকে মেয়েদের ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪ গুণিতক ১০০ মিটারে সোনা জিতেছেন। ছুঁয়েছেন স্বদেশী কিংবদন্তি উসাইন বোল্টের ‘ট্রিপল জয়ে’র অনন্য কীর্তি। আনন্দ-আবেগে থম্পসন হেরার বাকরুদ্ধ তো হওয়ারই কথা। অবশ্য সেই বাকরুদ্ধ রূপ কাটতেও সময় লাগেনি। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে যেমন চোখের পলকে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে যান, সংবিতে ফিরলেন সেভাবেই। চেতনায় ফিরে আকাশের দিকে তাকিয়েই বিড় বিড় করে যেন কী বললেন। হয়তো মনের সবটুকু আবেগ-শ্রদ্ধা মিশিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন!
নারী-পুরুষ মিলিয়ে ইতিহাসের প্রথম স্প্রিন্টার হিসেবে ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে স্প্রিন্টের ‘ট্রিপল’ জিতেছিলেন উসাইন বোল্ট। সোনা জিতে নেন পুরুষদের ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে। পরে ২০১৬ রিও অলিম্পিকেও নিজের কীর্তির পুনরাবৃত্তির জন্ম দেন সর্বকালের দ্রুততম মানব বোল্ট। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে সোনা জয়ের পর ৪ গুণিতক ১০০ মিটারে ডিসকোয়ালেফাইড না হলে তিনে তিন ‘ট্রিপল’ কীর্তিই হতো তার। যাই হোক, যে কীর্তি ইতিহাসে অন্য কারও একবার নেই, সেই কীর্তি দু’বার গড়েছেন বোল্ট।
এবার টোকিও অলিম্পিকে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্প্রিন্টার হিসেবে সেই কীর্তি ছুঁয়েছেন তারই এক স্বদেশীনী। বোল্টের কীর্তি ছুঁয়ে থম্পসন হেরাও দুনিয়াকে দেখিয়ে দিলেন, মেয়েরাও স্প্রিন্টে ট্রিপল জিততে পারে! বোল্টের প্রতিনিধি হয়ে থম্পসন দুনিয়াকে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, যে যত হুংকার দিক, স্প্রিন্টের রাজত্ব জ্যামাইকানদেরই। এমন একটা কীর্তির পর আদর করে থম্পসন হেরাকে ‘মেয়েদের বোল্ট’ বলে ডাকতেই পারে বিশ্ব ক্রীড়ামোদিরা।
২৯ বছর বয়সী থম্পসন হেরা আসলে কিংবদিন্তর তালিকায় নিজের নামটা লিপিবদ্ধ করে ফেলেন টোকিওতে মেয়েদের ১০০ মিটারে সোনা জিতেই। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে সোনা জিতেছিলেন। টোকিওতে ১০০ মিটারে সোনা জিতে সেই খেতাব ধরে রাখেন। সঙ্গে গড়েন ইতিহাসের মাত্র তৃতীয় মেয়ে হিসেবে ১০০ মিটার টানা দুটি অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সোনা জয়ের কীর্তি। পরে ২০০ মিটারে সোনা জিতে বাকি দু’জনকে ছাপিয়ে থম্পসন হেরা গড়ে ফেলেন টানা দুটি অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে (মেয়েদের ইভেন্টে) সোনা জয়ের প্রথম কীর্তি। এরপর তো ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতে ‘ট্রিপল’ কীর্তির স্বাদই শুকেছেন।
সোনার পদক জয়ের ভিত্তিতে এবারের টোকিও অলিম্পিকে সবচেয়ে সফল যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু কেলেব ড্রেসেল। সাঁতারে মোট ৫টি সোনা জিতেছেন তিনি; কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় নিশ্চিতভাবেই টোকিও অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় তারকা থম্পসন হেরা। কারণ সাঁতারে ৫ সোনা জয়ের চেয়ে স্প্রিন্টে ৩ সোনা জেতা অনেক বেশি মর্যাদার। এই কথার যথার্থতা খুঁজে পাবেন ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের দিকে দৃষ্টি দিলেই। সেবার চীনে সাঁতারে রেকর্ড ৮টি সোনা জিতেছিলেন কিংবদন্তি মাইকেল ফেলপস; কিন্তু স্প্রিন্টে রেকর্ড গড়ে দুটি সোনা জিতেই বেইজিং অলিম্পিকের মূল আলোটা কেড়ে নেন বোল্ট। সেখানে থম্পসন হেরা তো এবার দেখিয়েছেন ‘ট্রিপল’ কীর্তি।
এই কীর্তি গড়ার পথে ১০০ মিটারে অলিম্পিক রেকর্ডও গড়েছেন থম্পসন হেরা। ভেঙে দিয়েছেন ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে গড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত নারী স্প্রিন্টার ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নারের রেকর্ড। সেবার অবিশ্বাস্য দৌড়ে রেকর্ডটা গড়েছিলেন জয়নার। সময় করেছিলেন ১০.৬২ সেকেন্ড। তার সেই রেকর্ড এতদিন অক্ষতই ছিল। তবে এবার টোকিওতে সেই রেকর্ড ভেঙে থম্পসন হেরা গড়েছেন নতুন রেকর্ড। টোকিওতে তিনি সময় করেছেন ১০.৬১ সেকেন্ড।
টোকিওর ওই দৌড়ের মধ্য দিয়েই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম মানবী বনে যান থম্পসন হেরা; কিন্তু জ্যামাইকান মেয়ে চমক দেখিয়েছেন অলিম্পিকের পরও। গত ২১ আগস্ট ইউজেন ডায়মন্ড লিগে ছাপিয়ে গেছেন নিজেকেই। ১০০ মিটারে সোনা জয়ের পথে তিনি সময় করেছেন ১০.৫৪ সেকেন্ড। আর ০.০৫ সেকেন্ড সময় কম করলে ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নারের গড়া ১০.৪৯ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ডেই ভাগ বসাতে পারতেন তিনি। অল্পের জন্য সেটা না পারলেও ডায়মন্ড লিগের দৌড়ের মধ্য দিয়ে থম্পসন হেরা বনে গেছেন বর্তমান পৃথিবীর জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম মানবী। কারণ তার চেয়ে দ্রুত দৌড়ানো গ্রিফিত জয়নার পরপারে চলে গেছেন সেই ১৯৯৮ সালে।
২০১৬ রিও অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে সোনা জিতলেও এবার টোকিওতে মূল ফোকাসটা থম্পসন হেরার দিকে ছিল না। কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তারই টিমম্যাট শেলি-অ্যান ফ্রেসার প্রাইস। একে তো এটা ছিল ফ্রেসার-প্রাইসের শেষ অলিম্পিক। তার ওপর এবার দুর্দান্ত ফর্মেও ছিলেন ২০০৮ বেইজিং ও ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সোনাজয়ী ফ্রেসার-প্রাইস। অন্যদিকে রিওতে চমক দেখানো থম্পসন হেরা পরবর্তীতে যেন নিজের সেরা রূপটা হারিয়ে ফেলেন। জ্যামাইকান ট্রায়ালেও ফ্রেসাই প্রাইস এবং অন্য সতীর্থ শেরিকা জেকসনের সঙ্গে পেরে ওঠেননি; কিন্তু টোকিওতে এসে ঠিকই বাজিমাত করে দিয়েছেন থম্পসন হেরা। নিজের দুই সতীর্থকে পেছনে ফেলে থম্পসন সেরা সোনা জিতে নেন ১০০ মিটারে। ইভেন্টাকে পুরো জ্যামাইকান বানিয়ে ফ্রেসার-প্রাইস জিতে নেন রুপা, শেরিকা জেকসন জিতেছেন ব্রোঞ্জ।
নিজে কিংবদন্তি বনে যাওয়ার পাশাপাশি জ্যামাইকানদের অন্য একটা আফসোসও দূর করেছেন থম্পসন হেরা। টোকিওতে পুরুষদের স্প্রিন্টে পুরোপুরি ব্যর্থ জ্যামাইকানরা। বোল্টের ছেড়ে যাওয়া রাজ আসনে বসেছেন ইতালির মার্সেল জেকবস, কানাডার আন্দ্রে ডি গ্রাসরা। পুরুষদের সেই ব্যর্থতা পুরোপুরি পুষিয়ে দিয়ে থম্পসন দেশ জ্যামাইকার নামটা লিপিবদ্ধ করেছেন নতুন এক ইতিহাসের পাতায়। বয়স মাত্র ২৯। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে আলো ছড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে তার। টোকিও জয়ের পর থম্পসন হেরার দৃষ্টি এখন সেদিকেই, ‘আমার বয়স তো সবে ২৯। লম্বা পথই পড়ে আছে সামনে। আরও অনেক কিছুই করে দেখানোর সুযোগ আছে আমার।’
সেরাদের সংকল্প তো এমনই হবে।
কিংবদন্তি ফেলপসকে মনে করিয়েছেন ড্রেসেল
২০১৬ রিও অলিম্পিকের পরই অবসর নিয়েছেন ‘পুলের রাজা’ মাইকেল ফেলপস। কিংবদন্তি ফেলপসের ছেড়ে যাওয়া পুল-রাজত্বে কে ঝড় তোলেন, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল তুঙ্গে। সঙ্গে সংশয়ও ছিল, ফেলপসের মতো করে ঝড় কেউ তুলতে পারবেন কি? ঠিক ফেলপস সুলভ না হোক, তবে সংশয়টা ঠিকই মুছে দিয়েছেন তারই স্বদেশী কেলেব ড্রেসেল। শুধু স্বদেশী নন, ফেলপসের এক সময়ের সতীর্থও। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ফেলপসের সঙ্গী হিসেবেই দুটি সোনা জিতেছিলেন ড্রেসেল। মানে ফেলপসের ২৩টি সোনার পদকের মধ্যে দুটিতে ড্রেসেলেরও অবদান আছে। তো রিও অলিম্পিকেই একটা আবছা আভাস দিয়েছিলেন ড্রেসেল। টোকিওতে দর্শক প্রত্যাশা পূরণ করে ভালোভাবেই মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বদেশী কিংবদন্তি ফেলপসকে।
মোট ৬টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৫টিতেই সোনা জিতেছেন। তার ৩টি সোনাই আবার ড্রেসেল জিতেছেন রেকর্ড গড়ে। সতীর্থদের নিয়ে এর একটিতে গড়েছেন বিশ্ব রেকর্ড, ৪ গুণিতক ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে। দুটিতে গড়েছেন অলিম্পিক রেকর্ড। সোনার পদক সংখ্যার নিত্তিতে মাপলে তিনিই টোকিও অলিম্পিকে সবচেয়ে সফল। সবচেয়ে বেশি পদক জিতেছেন তিনিই। কিন্তু সামগ্রিক সাফল্য বিবেচনায় তিনি আড়ালে পড়ে গেছেন জ্যামাইকান নারী স্প্রিন্টার এলাইনে থম্পসন হেরার, যিনি ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে ‘স্প্রিন্ট ট্রিপল’ জয়ের কীর্তি গড়েছেন। তবে থম্পসন হেরার ছায়ায় ঢাকা পড়লেও ড্রেসেল নিজের আলোটা ঠিকই ছড়িয়েছেন টোকিওতে।
বয়স সবে ২৫। এরই মধ্যে তার নামের পাশে ৭টি অলিম্পিক সোনা। ‘রাজা’ ফেলপসের ২৩ সোনার দিকে কতটুকু এগোতে পারবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে তার সামনে পড়ে আছে লম্বা পথ। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে ৬টি সোনা জিতে নিজের আগমণ বার্তা জানান দিয়েছিলেন ফেলপস। টোকিওতে ৫টি সোনা জিতে ড্রেসেলও নিজের আগমন বার্তাটা দিয়ে রাখলেন ভালোমতোই।
বোল্টের রাজত্বে অখ্যাত জ্যাকবস-রাজা
লেমন্ত মার্সেল জ্যাকবস। এই নামে একজন স্প্রিন্টার আছেন, টোকিও অলিম্পিকের আগে বিশ্ববাসী তা ভালো করে জানতই না! কিন্তু টোকিওতে ইতালির সেই অখ্যাত জ্যাকবসই বিশ্বকে চমকে দিয়ে বসেছেন উসাইন বোল্টের রেখে যাওয়া রাজত্বের আসনে। জিতে নিয়েছেন ১০০ মিটার ও ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে সোনা। মানে বোল্টের ৩টি ইভেন্টের দুটিতেই রাজমুকুট পরেছেন মার্সেল জ্যাকবস। যা তাকে রাতারাতি বানিয়ে দিয়েছে বিশ্ব তারকা।
২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক থেকে ২০১৬ রিও অলিম্পিক, টানা তিনটি অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে এক রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বোল্ট; কিন্তু ২০১৭ বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের পর সেই বোল্ট ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে বিদায় নেন। তারপর থেকেই বিশ্ব ক্রীড়ামোদিদের কাছে সবচেয়ে বড় কৌতূহল ছিল কে হবেন বোল্টের উত্তরসূরি। দিনে দিনে সেই কৌতূহল বেড়ে টোকিও অলিম্পিকের আগে তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। বিশেষ করে পুরুষদের ১০০ মিটার ঘিরে দর্শক কৌতূহলটা তুঙ্গে ওঠে। অলিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট বলে কথা।
তাছাড়া শুধু অলিম্পিকের আকর্ষণীয় ইভেন্ট বলেই, বোল্টের ইভেন্ট বলেই পুরুষদের ১০০ মিটার ঘিরে দর্শকদের আকর্ষণ ছিল আকাশচুম্বী। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের পারফরম্যান্স এবং সামর্থ্য বিচারে ক্রীড়াপ্রেমীরা বোল্টের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বেশ কয়েকজনকে বাছাইও করে ফেলে। বোল্টের স্বদেশী-সতীর্থ ইয়োহান ব্লেক, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেড কারলি, কানাডার আন্দ্রে ডি গ্রাস-এদের নিয়েই দর্শকদের কৌতূহল ছিল বেশি। সম্ভাবনার দৌড়ে রাখা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার আকানি সিম্বিনেকেও। এদের পাশে মার্সেল জ্যাকবসের নামটি কেউ কল্পনাও করেননি।
কিন্তু টোকিওতে সোনার লড়াইয়ে সেই জ্যাকবসই বোকা বানিয়েছেন সবাইকে। বোল্টের স্বদেশী ব্লেক সেমিফাইনালেই ছিটকে পড়েন। জ্যামাইকার তার অন্য সতীর্থরাও সেমিফাইনালের বেড়া ডিঙাতে পারেননি। ফলে ফাইনালে মূল আলোটা ছিল ফ্রেড কারলি, আন্দ্রে ডি গ্রাস ও আকানি সিম্বিনের দিকে। কিন্তু আকানি সিম্বিনে দৌড়ের শুরুতেই ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যান। তখনো সবার দৃষ্টি ফ্রেড কারলি ও আন্দ্রে ডি গ্রাসের দিকে। কিন্তু ১০ সেকেন্ডের দৌড় শেষে বিশ্ববাসী বিস্ময়ে হতবাক। ফ্রেড কারলি, ডি গ্রাসদের পেছনে ফেলে ১০০ মিটারের নতুন চ্যাম্পিয়ন অখ্যাত জ্যাকবস! যার নামটি কেউ গণনাতেই নেয়নি!
১০ সেকেন্ডের বলা হলেও জ্যাকবসরা কেউ অত সময় নেননি। প্রথম ইতালিয়ান হিসেবে পুরুষদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অলিম্পিক সোনা জিততে জ্যাকবস সময় করেছেন ৯.৮০ সেকেন্ড, যা এই ইভেন্টে ইতিহাসের পঞ্চম দ্রুততম সময়। তার ঠিক পেছনে থেকে রুপা জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেড কারলি। তিনি সময় করেছেন ৯.৮৪ সেকেন্ড। ৯.৮৯ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে ব্রোঞ্জ জিতেছেন কানাডার আন্দ্রে ডি গ্রাস।
১০০ মিটারের চমকেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান জ্যাকবস। পরে বোল্টের আরেক ইভেন্ট ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতেও সোনা জিতে জ্যাকবস প্রমাণ করে দিয়েছেন ১০০ মিটারের জয়টা তার ফেক নয়! বরং যোগ্য হিসেবেই বোল্টের ছেড়ে যাওয়া রাজ-আসনে বসেছেন তিনি।
তবে এখানেই থামতে চান না ইতালিকে ইতিহাসের পাতায় নিয়ে যাওয়া ২৬ বছর বয়সী জ্যাকবস। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে আচমকাই যে সাফল্যের মুকুট মাথায় উঠে, এটা তিনি ধরে রাখতে চান সামনেও। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকেও জিততে চান ১০০ মিটারের শিরোপা-মুকুট, ‘দেশের হয়ে ১০০ মিটারে প্রথম অলিম্পিক সোনা। সত্যিই সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। এখন প্রত্যাশা একটাই, এই সাফল্য আগামীতেও ধরে রাখা। চ্যালেঞ্জটা আমি নিচ্ছি।’
বোঝাই যাচ্ছে, টোকিওর বিস্ময়কর সাফল্য জ্যাকবসের সাফল্য ক্ষুধাটা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
সবার ওপরে অ্যালিসন ফেলিক্স
এবারের টোকিও অলিম্পিকে একটি মাত্র ব্যক্তিগত ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন। মেয়েদের সেই ৪০০ মিটার দৌড়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ব্রোঞ্জ জিতে। একটি সোনার পদকও অবশ্য গলায় ঝুলিয়েছেন। সেটি মেয়েদের দলগত ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতে। অন্যরা যেখানে ৪-৫টি করে সোনা জিতেছেন, সেখানে একটি দলগত সোনা ও একটি ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জ জয়, এটি আর এমন কি! সাদাচোখে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক; কিন্তু এটুকু সাফল্য দিয়েই টোকিও অলিম্পিকের অন্যতম সেরা তারকা বনে গেছেন অ্যালিসন ফেলিক্স। কেড়ে নিয়েছেন বিশেষ আলো।
এই একটি দলগত সোনা এবং একটি ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জ পদক দিয়েই ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের রাণী’ বনে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই তারকা। ১২৫ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে পুরুষ এবং নারী, দুই মিলিয়েই অ্যাথলেটিকসে সবচেয়ে বেশি পদক জয়ের রেকর্ডের মালিক এখন তিনি। এবারের দুটি মিলিয়ে অলিম্পিকে তার মোট পদকসংখ্যা হলো ১১টি। অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে পুরুষ এবং নারী মিলিয়ে ১১টি পদক জিততে পারেননি আর কেউই।
টোকিও অলিম্পিকের আগে এই রেকর্ডটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই সাবেক কিংবদন্তি স্প্রিন্টার কার্ল লুইসের দখলে। যিনি সব মিলে অলিম্পিকে পদক জিতেছেন ১০টি। মেয়েদের বিভাগে অ্যাথলেটিকসে সর্বোচ্চ ৯টি পদক জিতেছিলেন জ্যামাইকার সাবেক তারকা মারলিন ওটি। তবে ওটির ৯টি পদক জয়ের রেকর্ডে ফেলিক্স ভাগ বসান ২০১৬ রিও অলিম্পিকেই। তবে ওটির সমান করেই রিও অলিম্পিক শেষ করেন তিনি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে তার সামনে থাকেন কেবল স্বদেশী কিংবদন্তি কার্ল লুইস।
ওটিকে পেছনে ফেলা এবং কার্ল লুইসকে ধরে ফেলার স্বপ্ন নিয়ে ফেলিক্স এবার প্রথম ট্র্যাকে নামেন ব্যক্তিগত ৪০০ মিটারে। বয়স ৩৬। এই বয়সে তিনি কতটুকু কী আর করতে পারবেন! ট্র্যাকে নেমে সংশয়বাদীদের এই সংশয় ঠিকই উড়িয়ে দিয়েছেন ফেলিক্স। সোনা-রুপা না হোক, ব্রোঞ্জ জিতে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি স্রেফ খেলা করার জন্য সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জাপানে আসেননি। সংশয়বাদীদের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি মারলিন ওটিকে পেছনে ফেলে দেন ফেলিক্স এবং ছুঁয়ে ফেলেন কার্ল লুইসের সর্বোচ্চ ১০ পদক জয়ের রেকর্ড।
ব্যক্তিগত ইভেন্টের এই পারফরম্যান্সে অনুপ্রাণিত হয়েই কিনা ফেলিক্সের নামটি মেয়েদের দলগত ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলের দলেও অন্তর্ভুক্ত করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। অন্য তিন সতীর্থকে নিয়ে দেশকে হতাশ করেননি ফেলিক্স। বরং সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে দিয়ে দেশকে উপহার দিয়েছেন সোনার পদক। আর এই পদক জয়ের মধ্যদিয়েই কার্ল লুইসকে পেছনে ফেলে অ্যালিসন ফেলিক্স হয়ে গেছেন অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসের সর্বোচ্চ পদকজয়ী।
অ্যাথলেটিকসে ১১টি পদক জেতা, এক কথায় অবিশ্বাস্যই। ফেলিক্স এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন মোট ৫টি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে। মার্কিন এই নারী অ্যাথলেট অলিম্পিক যাত্রাটা শুরু করেছিলেন ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক দিয়ে। সেবার একটি রুপা জিতেছিলেন ২০০ মিটারে। এরপর ২০০৮ বেইজিং, ২০১২ লন্ডন, ২০১৬ রিও এবং সর্বশেষ ২০২১ টোকিও অলিম্পিকের (পড়ুন ২০২০ টোকিও অলিম্পিক) মধ্য দিয়ে শেষ করলেন যাত্রা।
না, অ্যালিসন ফেলিক্স, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে বিদায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। তবে বয়স স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে, ফেলিক্সের অলিম্পিক ক্যারিয়ার শেষ! তা শেষ হোক। যে কীর্তি তিনি গড়ে গেলেন, ভাঙা দূরের কথা, তার এই রেকর্ড সহসাই কেউ ছুঁতে পারবে বলেও মনে হয় না। ফেলিক্স তাই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে না থেকে থাকবেন নিজের রেকর্ডের মধ্যদিয়ে। অলিম্পিকে তার ১১টি পদকের মধ্যে ৭টি সোনা, ৩টি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ।
শুধু অলিম্পিকেই নয়, বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপেও নারী-পুরুষ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১৮টি পদক জিতেছেন। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এমন অর্জন যার, তাকে হৃদয়ের আগল খুলে শ্রদ্ধা তো জানাতেই হয়। টোকিও অলিম্পিকের মধ্য দিয়ে তা জানিয়েছেও দর্শকরা। জানাবে ভবিষ্যতেও। কারণ বিদায় নিলেও ফেলিক্স চির অম্লান হয়ে থাকবেন নিজের রেকর্ডে।
ভাই-বোনের সোনার হাসি
স্বাগতিক হিসেবে ঘরের মাঠের অলিম্পিকে বিস্ময়কর পারফরম্যান্সই করেছে জাপান। অলিম্পিকে নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৭টি সোনা জয়ের রেকর্ড গড়েছে। সব মিলে ৫৮টি পদক জিতে সর্বোচ্চ পদকজয়ী তালিকায় জাপান জায়গা করে নিয়েছে তিনে। মানে পদক-সাফল্যে তাদের ওপরে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তো জাপানি ক্রীড়াবিদরা সম্মিলিতভাবেই দেশকে এমন গৌরবে ভাসিয়েছেন। পদকজয়ীদের প্রত্যেকেই ছড়িয়েছেন আলো। তবে জাপানি পদক জয়ী তারকাদের মধ্যে বিশেষ আলো কেড়েছেন হিফুমি আবে ও উতা আবে।
নামই বলে দিচ্ছে তারা একই পরিবারের। সম্পর্কের বাঁধনটা তাদের আরও শক্ত, ভাই-বোন। ভাই-বোনের সোনা জয়ের কীর্তি আগেও দেখেছে অলিম্পিক। তবে এবারের (২০২০ অলিম্পিক) আসরে আপন ভাই-বোন হিসেবে সোনার হাসি হেসেছেন একমাত্র তারাই। একবার নয়, দু’জনেই সোনার হাসি হেসেছেন দু’বার করে।
ভাই হিফুমির পথ অনুসরণ করে বোন উতাও নাম লেখান নিজেদের পছন্দের খেলা জুডোতে। তো প্রিয় এই খেলায় আবে পরিবারের দুই ভাই-বোনের একসঙ্গে সোনার হাসি এবারই প্রথম নয়। তিন বছর আগে ২০১৮ সালে বাকু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও নিজ নিজ ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন তারা। ২১ বছর বয়সী উতা সোনা জিতেছিলেন ২০১৯ টোকিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও। তবে তার চেয়ে দুই বছরের বড় ২৩ বছর বয়সী হিফুমি সেবার ঘরের মাঠে সোনাজয়ে ব্যর্থ হন। জিতেছিলেন রুপা।
সেই হতাশা দূর করে এবার ঠিকই দুই ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে সোনার উৎসব করেছেন। আবে পরিবারকে প্রথমে সোনার আনন্দে ভাসান উতা। নিজের ৫২ কেজি ওজন শ্রেণিতে তিনি জিতে নেন সোনা।
তার ঘণ্টা খানে পরই আবে পরিবারকে দ্বিতীয় বার সোনা উৎসবে ভাসান হিফুমি। ২০১৮ বাকু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও তারা সোনা জিতেছিলেন ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে। কী কাকতাল!
এবার শুধু দেশ এবং পরিবারকে নিজ নিজ ইভেন্টে সোনা জিতেই ক্ষান্ত হননি তারা। পরে একসঙ্গে মিলে দেশকে দলগত দ্বৈতে রুপা জিতিয়েছেন তারা। স্বাভাবিকভাবেই অন্য সোনাজয়ী তারকাদের ছাপিয়ে আবে ভাই-বোনদের ঘিরেই জাপানিদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনাটা বেশি।
দুই ভাই-বোনেরই খেলার ধরন এক। উদযাপন ভঙ্গিও একই রকম। এবার যেমন দু’জনেই সোনা জয়ের পর কোর্টে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছেন। তাদের যে কান্না ছুঁয়েছে প্রতিটি জাপানির হৃদয়।
দু’বার করোনা জয় করে ডাবল সোনা
অলিম্পিকে সোনা জয়ের পর বেশির ভাগ ক্রীড়াবিদই আনন্দ-আবেগের কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ আবার সোনা জয়ের আনন্দে দৌড়াতে থাকেন মাঠজুড়ে; কিন্তু টম ডিন এসবের কিছুই করলেন না। সাঁতার শেষে তিনি চোখের চশমাটা খুলে তাকালেন স্কোরবোর্ডের দিকে। দুই হাত মাথায় তুলে মুখ হা করে তাকিয়েই রইলেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল গিলে ফেলে তাকে। চোখ-মুখের ভাবটা এমন, যেন কিছুই হয়নি!
বিশ্বাস কী করে হবে? জীবনপ্রদীপই নিভে যেতে বসেছিল যার, সেই তিনি মৃত্যুকে জয় করে পূর্ণ সুস্থ হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবেন, সোনার পদক জিতবেন, এটা যে তার কাছে রূপকথার মতোই! ব্রিটিশ সাঁতারু টম ডিনের গল্পটা রূপকথার মতোই। একবার নয়, দু’বার মরণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে দু’বারই দেখে এসেছেন মৃত্যুর দুয়ার। প্রথম বার করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। দ্বিতীয় বার এ বছরের শুরুর দিকে।
দ্বিতীয় বার শারীরিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার শঙ্কা গ্রাস করে নিয়েছিল পুরোপুরি। তবে প্রচণ্ড মনের জোর আর সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদে দ্বিতীয় বারও জয়ী হন করোনা-যুদ্ধে। কিন্তু করোনার থাবা থেকে দু’দুবার বেঁচে গেলেও শরীরটা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। অন্যরা যখন পুরোদমে অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, দুর্বল শরীর নিয়ে তরুণ টম ডিনকে বাসাতেই থাকতে হয় পূর্ণ বিশ্রামে। অলিম্পিকের স্বপ্ন মনের ভেতরেই চাপা রেখে দিন কাটাতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে। ২১ বছর বয়সী টম ডিন নিজেই তখন বিশ্বাস করতে পারেননি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারবেন।
কিন্তু মনের জোর আর চেষ্টায় দ্রুতই সুস্থ হয়ে নেমে পড়েন অনুশীলনে। তবে অলিম্পিকের মতো বিশ্ব আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যতটুকু প্রস্তুতি দরকার, ততটা প্রস্তুতি নিতে পারেননি টম ডিন। প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়েই তিনি যুক্তরাজ্যের অলিম্পিক দলের হয়ে চলে আসেন জাপানে। টোকিওতে দু’দুটি সোনা জিতে লিখেছেন রূপকথার গল্প। প্রথম সোনা জিতেছেন পুরুষদের ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলের ব্যক্তিগত ইভেন্টে।
এই সোনা জয়ের পথে ছোটখাটো একটা রেকর্ডেরও অংশীদার হয়েছেন তিনি। ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে সোনা জয়ের পথে তার মূল লড়াইটা তারই সতীর্থ ডানকান স্কটের সঙ্গে। ডানকানের চেয়ে ০.০৪ সেকেন্ড কম সময় নিয়ে সাঁতার শেষ করেছেন তিনি। মানে ডানকান জিতে নিয়েছেন রুপা। ১:৪৪.২২ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জিতে নেন টম ডিন। রুপা জিততে ডানকান স্কট সময় করেছেন ১:৪০.২২ সেকেন্ড! সেই ১৯০৮ সালের পর এই প্রথম অলিম্পিকে সাঁতারের কোনো ইভেন্টে সোনা ও রুপা জিতেছে ব্রিটেন।
এটাই ক্যারিয়ারে টম ডিনের প্রথম অলিম্পিক সোনা। অথচ সাঁতার শেষে সবকিছু নিশ্চিত হওয়ার পরও টম ডিন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, অলিম্পিকে সোনা জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার! তাই তো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে থ হয়ে তাকিয়ে থাকেন স্কোরের দিকে! পরে পুরুষদের দলগত ৪ গুনন ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে রিলে ইভেন্টেও সোনা জিতেছেন টম ডিন। জোড়া সোনা জয়ের প্রতিক্রিয়ায় টম ডিন কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছেন, ‘অলিম্পিকে সোনা জয়, এটা অসাধারণ এক অনুভূতি। অলিম্পিকে সোনার পদক গলায় ঝুলানোর স্বপ্ন পূরণ সত্যিই দারুণ একটা ব্যাপার। আমার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর।’ কেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘গত এক বছরেরও কম সময়ে দু’বার করোনা হয়েছে আমার। সবকিছু ভুলে নিজের ফ্ল্যাটেই আইসোলেশনে থাকতে হয়েছে আমাকে। তখন তো অলিম্পিক সোনা ছিল আমার চেয়ে লাখ লাখ মাইল দূরে!’
কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারেননি ব্রিটিশ তরুণদের গর্ব তরুণ টম ডিন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠেই দিয়েছেন করোনাকালীন কঠিন সময়ের বর্ণনা, ‘প্রথম বারের তুলনায় দ্বিতীয়বার অবস্থা অনেক বেশি ভয়ংকর ছিল। প্রায় ১০০ দিন আমি অসুস্থ ছিলাম। করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও অনুশীলন করতে পারিনি। সোনা জেতা দূরের কথা, অলিম্পিকে আসতে পারব, এমনটাই তো কল্পনা করতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।’
সোনার কান্না একস্রোতে মিলিয়েছে দিয়াজ-ডাফি-ইব্রাহিমকে
ফ্লোরা ডাফি, হিদিলিন দিয়াজ, ফারেস ইব্রাহিম-সদ্য শেষ হওয়া টোকিও অলিম্পিকে সোনা সাফল্যের কান্না এই তিনজনকে মিলিয়ে দিয়েছে একবিন্দুতে। অলিম্পিকে সোনা জয়ের পর বেশির ভাগ ক্রীড়াবিদই আবেগ-উচ্ছ্বাসে কাঁদেন। সোনার পদক জয়ের পর কান্না, অলিম্পিকের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্যগুলোর একটি। এবারের টোকিও অলিম্পিকেও এই পরিচিত দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন অনেক অনেক তারকা। তবে তাদের মধ্য থেকে ওপরে উল্লিখিত তিনজনকে এক সুতোয় গেঁথেছে অন্য একটা বিশেষ কারণ। ফ্লোরা ডাফি, হিদিলিন দিয়াজ ও ফারেস ইব্রাহিম- তিনজনেই নিজ নিজ দেশকে উপহার দিয়েছেন প্রথম অলিম্পিক সোনা। তাদের হাত ধরেই অলিম্পিকে প্রথম বারের মতো সোনা জয়ের স্বাদ পেয়েছে বারমুডা, ফিলিপাইন ও কাতার। নিজ নিজ দেশকে প্রথম অলিম্পিক সোনা জেতানোর পর তিনজনের কান্নার ধরনই ছিল একই রকম! তিনজনেই কেঁদেছেন অঝোরে।
হিদিলিন দিয়াজের দেশ ফিলিপাইন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রথম অংশ নেয় সেই ১৯২৪ সালে। সেই থেকে প্রতিটি অলিম্পিকে অংশ নিলেও ফিলিপাইন কখনো সোনার পদক জিততে পারেনি। বিগত ৯৭ বছরে অলিম্পিকে সব মিলে ৩টি রুপা ও ৭টি ব্রোঞ্জ পদক অবশ্য জিততে সক্ষম হয় ফিলিপাইন। তবে সোনার পদক জয়ের আজন্ম স্বপ্ন তাদের অধরাই থেকে যায়। অবশেষে দেশবাসীর ৯৭ বছরের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটালেন হিদিলিন দিয়াজ। ভারত্তোলনে মেয়েদের ৫৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতেছেন ৩০ বছর বয়সী হিদিলিন দিয়াজ। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে এই হিদিলিনই দেশের প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে জিতেছিলেন রুপা। এবার তো গড়ে ফেললেন দেশের হয়ে প্রথম সোনা জয়ের কীর্তিই। স্বাভাবিকভাবেই দেশের হয়ে এই ইতিহাস গড়ার পর কেঁদে ফেলেন তিনি।
ফিলিপাইনের মতো কাতারও প্রথম সোনার মুখ দেখেছে ভারত্তোলনে। তবে দিয়াজের মতো কোনো মেয়ে নন, কাতারকে প্রথম সোনা উপহার দিয়েছেন ফারেস ইব্রাহিম। পুরো নাম ফারেস ইব্রাহিম সাইয়েদ হাসোনা এল-বখত। ডাক নাম মেসো হাসোনা। তবে বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে ফারেস ইব্রাহিম নামেই পরিচিত তিনি। ভারত্তোলনে পুরুষদের ৯৭ কেজি ওজন শ্রেণিতে সোনা জিতেছেন তিনি।
এবার টোকিওতে অবশ্য আরও একটি সোনা জিতেছে কাতার। পুরুষদের হাই-জাম্পে যৌথভাবে সোনা জিতেছেন মুতাজ্ ঈসা বারশিম। ৩০ বছর বয়সী এই অ্যাথলেট স্বেচ্ছায় সোনা ভাগাভাগির মাধ্যমে অবশ্য অনন্য এক মানবীয় নজির গড়েছেন। সেটি আলাদা গল্পেই জানা যাবে। তবে একই আসরে সোনা জিতলেও মুতাজ ঈসা বারশিমের ভাগ্যে দেশের হয়ে প্রথম সোনাজয়ীর খেতাব জোটেনি। কারণ, তার আগেই সেই খেতাব অর্জন করেছেন ২৩ বছরের টগবগে যুবক ফারেস ইব্রাহিম।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে দেশকে নতুন এক ইতিহাসের পাতায় ঢুকিয়ে দেওয়া, সোনা জয় নিশ্চিত করার পর ফারেস ইব্রাহিম যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না! বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ডুবে কাতারি য্বুক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। দু’হাতে মুছেও চোখের জলের স্রোতে বাধ দিতে পারছিলেন না। একে তো দেশের হয়ে প্রথম সোনা জয়, সেই ইতিহাসটা আবার তিনি জন্ম দিয়েছেন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে। স্ন্যাচে ১৭৭ কেজি তোলার পর তিনি ক্লিন অ্যান্ড জার্কে তোলেন ২২৫ কেজি। যা অলিম্পিক রেকর্ড। দুই শ্রেণি মিলিয়ে মোট ৪০২ কেজি তুলেছেন তিনি। এটাও অলিম্পিক রেকর্ড।
হিদিলিন দিয়াজ ও ফারেস ইব্রাহিমের সঙ্গে একবিন্দুতে মিলেছেন ফ্লোরা ডাফিও। তিনিও দেশ বারমুডাকে উপহার দিয়েছেন প্রথম অলিম্পিক সোনা। তবে কান্নার রঙে একবিন্দুতে মিললেও একটা দিক থেকে ফ্লোরা ডাফি অন্য দু’জনকে ছাপিয়েই গেছেন। প্রথম সোনা উপহার দেওয়ার মধ্যদিয়ে বারমুডাকে অন্য একটা ইতিহাসেও ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি। ফ্লোরা ডাফির হাত ধরেই ১২৫ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে সোনা জয়ের রেকর্ড গড়ে ফেলল বারমুডা।
দেশটির আয়তন মাত্র ৫৩.২ বর্গ কিমি, জনসংখ্যা ৬৪ হাজারেরও কম! পুঁচকে এই দেশটির প্রতিনিধি হয়েই ফ্লোরা ডাফি টোকিও মাতিয়েছেন সোনা জিতে! ভাবা যায়! বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। ছোট্ট এই দেশটি থেকে এবার অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল মাত্র দু’জন ক্রীড়াবিদ। দু’জনের মধ্যেই একজন দেশকে তুলে দিলেন রেকর্ড আর ইতিহাসের পাতায়। ৩৩ বছর বয়সী ফ্লোরা ডাফি সোনাটা জিতেছেনও আবার অলিম্পিকের অন্যতম কঠিন ইভেন্ট ট্রিয়াথলনে, মেয়েদের ব্যক্তিগত ইভেন্টে।
ফ্লোরা ডাফি এর আগেও ৩টি অলিম্পিকে (২০০৮ বেইজিং, ২০১২ লন্ডন এবং ২০১৬ রিও অলিম্পিক) অংশ নিয়েছেন। তবে পদক জয়ের স্বপ্নটা তার অধরাই ছিল। সেই অধরা স্বপ্ন এবার পূরণ করলেন সোনা জিতে। টগবগে যৌবনে যে পূরণ করতে পারেননি, ৩৩ বছর বয়সে, সেই স্বপ্ন ধরবেন, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফ্লোরা ডাফি নিজেও এটা কল্পনা করতে পারেননি। তাছাড়া চোটের কারণে এবার প্রস্তুতিটাও তেমন ভালো ছিল না; কিন্তু ওই কথায় বলে, ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে! ফ্লোরা ডাফি ভাগ্যকে জয় করেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অসম্ভবকে সম্ভব করার পর অতি-আবেগে কোর্টেই কাঁদতে থাকেন হাউমাউ করে।
ফিলিপাইন, কাতার, বারমুডার মতো সোনার স্বাদ হয়তো পায়নি। তবে এবার টোকিওতে প্রথম বারের মতো অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বাদ পেয়েছে বুরকিনা ফাসো, সান ম্যারিনো এবং তুর্কমেনিস্তানও। বুরকিনা ফাসো ও তুর্কমেনিস্তান পদক জিতেছে একটি করে। ৩টি পদক জয়ের পথে সান ম্যারিনো গড়েছে ইতিহাস। সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে অলিম্পিকে পদক জয়ের রেকর্ড গড়েছে সান ম্যারিনো। দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৩ হাজার।
এত কম জনসংখ্যার দেশ এর আগে কখনো অলিম্পিকে পদক জিততে পারেনি। সান ম্যারিনোকে এই রেকর্ডটির আনন্দে প্রথম ভাসিয়েছেন নারী শুটার আলেসান্দ্রা পেরিলি। মেয়েদের ট্র্যাপ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতে তিনি সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে সান ম্যারিনোকে অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ডের পাতায় তুলে দেন। এই কীর্তিটা তিনি গড়েন ২৯ জুলাই। এর দুই দিন পরই আবার নতুন রেকর্ড গড়ে সান ম্যারিনো। ৩১ জুলাই জিতে নেয় প্রথম রুপার পদকও। এই কীর্তিও অবশ্য সান ম্যারিনো গড়ে ৩৩ বছর বয়সী আলেসান্দ্রা পেরিলির হাত ধরেই। তবে এবার আর পেরিলি একা নায়ক নন। তার সঙ্গে নায়কের খাতায় নাম লেখান ৩৮ বছর বয়সী শুটার জিয়ান মার্কো বার্তিও। দু’জনে মিলে শুটিংয়ের মিশ্র দ্বৈতে রুপা জেতেন তারা। এরপর ৫ জুলাই সান ম্যারিনোকে তৃতীয় পদক উপহার দেন মাইলেস আমিনে। রেসলিংয়ে পুরুষদের ৮৬ কেজি ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি। সব মিলে সান ম্যারিনোর মাত্র ৫ জন ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন এবারের অলিম্পিকে। তার ৩ জনই গলায় তুলেছেন পদক!
সান ম্যারিনোর সঙ্গে পেরে না উঠলেও প্রথম বারের মতো অলিম্পিকে পদকজয়ীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে তুর্কমেনিস্তান ও বুরকিনা ফাসো। তুর্কমেনিস্তান জিতেছে একটি রুপা, বুরকিনা ফাসো পদক তালিকায় নাম তুলেছে একটি ব্রোঞ্জ জিতে। তুর্কমেনিস্তানের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিকে পদক জয়ের ইতিহাস পড়েছেন রুপালি মেয়ে পলিনা গারয়েভা। মেয়েদের ভারত্তোলনে ৫৯ কেজি ওজন শ্রেণিতে রুপা জিতেছেন তিনি। বুরকিনা ফাসোর প্রথম পদকটি ব্রোঞ্জ। পুরুষদের ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ জিতে দেশকে ইতিহাসের পাতায় তুলে দিয়েছেন হুগুয়েজ ফ্যাব্রিস জাঙ্গো। সার্বিক সাফল্য বিচারে এরা হয়তো অনেকটা পিছিয়েই। তবে নিজ নিজ দেশের হয়ে প্রথম পদক জয়ী হিসেবে এঁরাও বনে গেছেন নায়ক।
স্বেচ্ছায় সোনা ভাগাভাগি
অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত কোনটি? ১২৫ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে কত কত ঘটনাই তো ঘটেছে। হাস্যকর, হৃদয়বিদারক, মানবতার জয়গান গাওয়া কত ঘটনা ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই! সেসব হাজারো ঘটনার মধ্য থেকে ‘সেরা মুহূর্ত’ বেছে নেওয়াটা অসম্ভবই। তবে সদ্য শেষ হওয়া টোকিও অলিম্পিকে পুরুষদের হাই-জাম্পে স্বেচ্ছায় সোনা ভাগাভাগির ঘটনাটি যে অলিম্পিকের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মূহূর্তগুলোর একটি, এ ব্যাপারে অলিম্পিক বোদ্ধারা এক রকম নিশ্চিত। অলিম্পিক নিয়ে বিশেষ গবেষণা করা যুক্তরাষ্ট্রের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নারী আনা ব্রেটন তো স্পষ্টই বলেছেন, ‘আমার দেখা অলিম্পিকের সেরা মুহূর্ত এটি।’
মানবতা তথা বন্ধুত্বকে সুউচ্চে উঁচিয়ে ধরে যে ঘটনা বা মুহূর্ত, সেটিকে তো সেরা মানতেই হয়! এবারের টোকিও অলিম্পিকের হাই-জাম্পে স্বেচ্ছায় সোনার পদক ভাগাভাগি করে সত্যিকার অর্থেই বন্ধুত্বের অনন্য এক নজির স্থাপন করেছেন কাতারের মুতাজ ঈসা বারশিম ও ইতালির জিয়ানমারকো তামবেরি। কৃতিত্বটা অবশ্য বেশি দিতে হবে মুতাজ ঈসা বারশিমকেই। কারণ এককভাবে সোনার পদক গলায় তোলার স্বপ্ন চাপা দিয়ে তা ভাগাভাগির মানবিক প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তিনিই।
গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে এর আগেও সোনার পদক ভাগাভাগি হয়েছে। তবে এবারের ঘটনাটি ঘটল দীর্ঘ ১০৯ বছর পর। কারণ, অলিম্পিক এর আগে সর্বশেষ সোনার পদক ভাগাভাগির দৃশ্য দেখেছিল সেই ১৯১২ স্টকহোম অলিম্পিকে। তবে সেবার কী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোনার পদক ভাগাভাগি হয়েছিল, কারণটা স্পষ্ট জানা যায়নি; কিন্তু এবার সোনার পদক শেয়ার করে বন্ধুত্বের বন্ধনের অবিশ্বাস্য এক দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন মুতাজ ঈসা বারশিম।
পুরুষদের হাই-জাম্পে এবার সেরা তিন প্রতিযোগীই সমান ২.৩৭ মিটার পেরিয়েছেন; কিন্তু এর আগের রাউন্ডগুলোতে ঠিক ভালো করতে না পারায় বেলারুশের মাকসিম নেদাসেকাউ সোনার দৌড় থেকে পিছিয়ে পড়েন। ব্রোঞ্জ পদক পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। তবে সেরা দুই প্রতিযোগীর মধ্যে কে সোনা আর কে রুপা পাবেন, সেটি আলাদা করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। কারণ আগের রাউন্ডগুলো মুতাজ ঈসা বারশিম এবং তামবেরি একই রকম ফল করেছেন। তাদের আলাদা করতে তাই দড়ি উঁচিয়ে ২.৩৯ মিটার করা হয়; কিন্তু ২.৩৯ মিটার লাফাতে গিয়ে দু’জনেই সমান ৩ বারের চেষ্টায় ব্যর্থ! তাহলে আলাদা করার উপায়?
বাধ্য হয়ে বিশেষ এক পরিকল্পনা নিয়ে অলিম্পিকের এক কর্মকর্তা প্রবেশ করলেন মাঠে। তিনি গিয়ে প্রস্তাব দিলেন, ‘তোমরা যদি রাজি থাক, তাহলে আমরা জাম্প-অফ’-এর ব্যবস্থা করতে পারি।’ ফুটবলে যেমন টাইব্রেকার হয়, সেরকমই আর কি! বারশিম ও তামবেরি, দু’জনে তখন দু’পাশে দাঁড়িয়ে। কোনো সিদ্ধান্ত দিতে হলে তো দু’জনকে আলোচনা করতে হবে! কিন্তু মুতাজ ঈসা বারশিম বন্ধু তামবেরির সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই ওই কর্মকর্তাকে পাল্টা একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। বিনয়ের সঙ্গে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমরা দু’জনেই কি দুটি সোনার পদক পেতে পারি না!’ খানিক ভেবেই ওই কর্তা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, সেটাও হতে পারে।’ এটা শুনেই দুই বন্ধু আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন একযুগে। যেন বোঝাতে চাইলেন, আমরা দু’জনেই আকাশ ছুঁয়েছি! দৌড়ে গিয়ে একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করলেন। এরপর নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা শরীরে জড়িয়ে মাঠজুড়ে উদযাপন করলেন একসঙ্গে। তাদের সেই যুগল উদযাপন স্পষ্টই বলে দিচ্ছিল, ‘আমরা দু’জনেই জয়ী, জয়ী আমাদের বন্ধুত্ব।’
তামবেরি এর আগে কখনোই অলিম্পিকে পদক জিততে পারেননি। অন্য দিকে বারশিম আগের দুটি অলিম্পিকেই (২০১২ লন্ডন অলিম্পিক এবং ২০১৬ রিও অলিম্পিকে) রুপা জিতেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তার সোনার পদক জয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল বেশি তীব্র। অভিজ্ঞতার দৌড়ে এগিয়ে থাকা বারশিম চাইলে কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবই সাদরে গ্রহণ করতে পারতেন; কিন্তু এককভাবে সোনার পদক গলায় ঝুলানোর কথা ভুলে তার মনে পড়ল বন্ধুর কথা। যাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে হতাশার গহ্বর থেকে আজকের এই উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন, সেই বন্ধু যদি জাম্প-অফে হেরে যায়! তার চেয়ে দুই বন্ধুতে মিলে সোনা ভাগাভাগি করাই তো ভালো! তিনি ভালোভাবেই পড়তে পেরেছিলেন বন্ধুর মনের আকুতি। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে সোনা ভাগাভাগির প্রস্তাবটা দিয়ে বন্ধুর মুখেও সমান হাসি ফুটিয়ে তোলেন তিনি!
হ্যাঁ, এক সঙ্গে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুবাদে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের মেলবন্ধনটা তৈরি হয়েছে আগেই। সেই বন্ধুত্বের টানেই হতাশার বন্ধ ঘর থেকে বন্ধু তামবেরিকে টেনে আলোয় নিয়ে এসেছেন বারশিম। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের পর গোড়ালিতে গুরুতর চোট পান ২৯ বছর বয়সী তামবেরি। যে চোটের কারণে তার ক্যারিয়ারটাই শেষ হতে বসেছিল। তবে প্রচণ্ড মনের জোরে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়ে পর পর প্যারিসের ডায়মন্ড লিগে অংশ নিতে চান ইতালিন অ্যাথলেট; কিন্তু বিধি বাম। প্যারিসে তিনি লাফ দিতেই পারছিলেন না। হতাশায় মনের জোর, আত্মবিশ্বাস দুটোই হারিয়ে ফেলেন। প্রতিযোগিতার পর নিজের ঘরে গিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকেন। সান্ত্বনা, অনুপ্রেরণা দিতে বন্ধুর রুমে ছুটে যান ৩০ বছর বয়সী বারশিম।
হতাশা ভুলিয়ে বন্ধুকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে বারশিম সেদিন শুনিয়েছিলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা, ‘দেখো, তুমি ঠিক পথেই আছ। মাত্রই চোট থেকে ফিরেছ। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, চোট কাটিয়ে তুমি ডায়মন্ড লিগে আসতে পারবে? কিন্তু তুমি ঠিকই এসেছ। তাড়াতাড়ি সবকিছু চেয়ো না। যা হচ্ছে, আস্তে আস্তে হতে থাকুক। এক সময় ঠিকই নিজের সেরা দিয়ে বিশ্ব জয় করবে।’
বন্ধু বারশিমের কথাগুলো তামবেরিকে এতাটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, আর পেছন ফিরে তাকাননি। টোকিও অলিম্পিককে পাখির চোখ করে নিজেকে প্রস্তুত করেন নিজের মতো করে। মরণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারিও তার সেই প্রস্তুতিতে বাঁধ ফেলতে পারেনি। ফল, এখন সারা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট। দুই বন্ধু টোকিওতে আর কোনো পদক জিততে পারেননি। তবে বন্ধুত্বের জয়গান গাওয়া এক সোনার পদকেই তারা পেয়ে গেছেন বিশ্ব তারকার খেতাব। পেয়েছেন বিশ্ববাসীর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তবে তুলনামূলকভাবে ভালোবাসাটা বারশিমই বেশি পেয়েছেন। এক পদকে তিনি পেয়েছেন দুটি জয়ের স্বাদ।