সেই ‘অভিশপ্ত’ বারবোসাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে ব্রাজিলিয়ানরা!

খলিলুর রহমান
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২২, ১৫:০৭

মোয়াসির বারবোসা
অবশেষে তার জন্য দেশবাসীর হৃদয়ে ভালোবাসার দুয়ার খুলতে শুরু করেছে। মৃত্যুর ২১ বছর পর একটু একটু করে ব্রাজিলিয়ানদের ভালোবাসা পেতে শুরু করেছেন মোয়াসির বারবোসা; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে হঠাৎ উদিত এই ভালোবাসা কি মৃত্যুর এতগুলো বছর পর বারবোসার অতৃপ্ত বিদেহী আত্মাকে তৃপ্ত করতে পারবে?
দুনিয়ার জীবনে যিনি দেশবাসীর সীমাহীন ঘৃণা, তাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আগুনে দাহ হয়েছেন, দীর্ঘ ৫০ বছর চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেও যিনি দেশবাসীর ঘৃণা থেকে মুক্তি পাননি, একটু ভালোবাসা পাননি, মৃত্যুর এত বছর পর ওপাড়ে বসে দেশবাসীর এই হঠাৎ ভালোবাসা দিয়ে কী করবেন বারবোসা?
বারবোসার করুণ-নিষ্ঠুর গল্পটা অভিজ্ঞ ফুটবলপ্রেমীদের জানাই। যারা জানেন না, বা জানলেও যাদের ভালো করে মনে নেই, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, বারবোসা ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ‘অভিশপ্ত এক নাম।’ ব্রাজিলের ১৯৫০ বিশ্বকাপ শিরোপা-স্বপ্ন ভঙ্গের প্রতীক! আর বারবোসার কাছে? আপামর দেশবাসীর সীমাহীন ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অপমানে চরম বিষিয়ে উঠা নিজের জীবনটা যেন বারবোসার কাছে আরও বেশি অভিশপ্ত ছিল। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর ‘একাকীত্বের বন্দিজীবনে’ তিনি পাননি এতটুকু সুখ-শান্তি।
বারবোসা নিশ্চিতভাবেই ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘ট্র্যাজিক হিরো’। অনেকের মতে, বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় ‘ট্র্যাজিক হিরো’ তিনি। ফুটবল মাঠের একটা ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি কখনো কাউকে পেতে হয়নি। এতটা কষ্টের জীবনও কখনো কাউকে কাটাতে হয়নি।
পাঠক হৃদয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, হঠাৎ করে ব্রাজিলের সেই ১৯৫০ বিশ্বকাপ দলের গোলরক্ষক বারবোসাকে নিয়ে আলোচনার কারণ কী? ওই যে কথায় বলে, নামে নামে যমে টানে। অবশ্য যমে টানার মতো কিছু এবার ঘটেনি। একটি নাম স্মৃতির আড়াল খুঁজে ব্রাজিলিয়ানদের সেই ‘মারাকানাজো ট্র্যাজেডি’র খলনায়কের নামটি তুলে এনেছে আর কি!
ব্রাজিলের বর্তমান জাতীয় দলের অন্যতম সদস্য গ্যাব্রিয়েল বারবোসা আলমেইদা। এই বারবোসার কারণেই সেই বারবোসা আলোচনায়। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গোর ২৫ বছর বয়সী ফরোয়াড গ্যাব্রিয়েল বারবোসা আলমেইদার জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক অবশ্য হয়েছে ২০১৬ সালে; কিন্ত ‘সেরা’ কাউকে স্মরণ করাতে তো সেরা হতে হবে। গ্যাব্রিয়েল বারবোসা ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি গায়ে সেই সেরা রূপটাই দেখাতে পারছিলেন না। দলে নেইমার, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, ফিলিপে কুতিনহো, রবার্তো ফিরমিনো, রিচার্লিসনের মতো তারকা ফরোয়ার্ডদের ভিড়ে ব্রাজিলের একাদশে সুযোগই তেমন পাচ্ছিলেন না তিনি। তবে দেরিতে হলেও সম্প্রতি নিজের জাতটা জানান দিতে শুরু করেছেন গ্যাব্রিয়েল বারবোসা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের সর্বশেষ তিন ম্যাচে করেছেন দুই গোল। তার এই সাম্প্রতিক ফরমের কারণেই প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় উঠে এসেছে সেই অভিশপ্ত বারবোসা।
নামের মিল ছাড়াও দু’জনের মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। দু’জনেরই জন্ম ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। সবচেয়ে বড় মিল, দু’জনেই সুযোগ পেয়েছেন ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর। এত এত মিলের মধ্যে বড় একটা অমিল হলো, গ্যাব্রিয়েল বারবোসা একজন ফরোয়ার্ড। আর ১৯৫০ বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক হিরো বারবোসা ছিলেন একজন গোলরক্ষক।
হালের ২৮ বছর বয়সী গ্যাব্রিয়েল বারবোসা তো সবে ফুল ফোটাতে শুরু করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কত দূর যেতে পারবেন, ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে প্রতিভা-দক্ষতায় মোয়াসির বারবোসা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুউচ্চে। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকের বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক হিসেবেই বিবেচনা করা হতো তাকে। বিস্ময়কর হলো, তিনি এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, হাতে গ্লাভসই পরতেন না! গ্লাভস না পরেও তিনি অন্যদের চেয়ে যোজন এগিয়ে ছিলেন।
প্রতিভা, দক্ষতা, পারফরম্যান্স বিবেচনায় ইতিহাসের পাতায় মহানায়ক হয়েই থাকার কথা ছিল তার; কিন্তু ওই যে, ভাগ্যে তার লেখা ছিল ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হবেন। বিশ্বসেরা গোলরক্ষক হয়েও তিনি বিশ্বমঞ্চ মাতানোর সুযোগ তেমন পাননি। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ডামাডোলে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালের বিশ্বকাপ হয়নি। অথচ এই সময়টাতেই তিনি ছিলেন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। তবে বিশ্বকাপে না হওয়ার কারণে নয়, বারবোসা মূল ‘খলনায়ক’ বনে যান বিশ্বকাপ খেলেই। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে একটিই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছেন কিংবদন্তি বারবোসা।
প্রতিভা-দক্ষতায় ১৯৫০ সালে নিজেদের ঘরের মাটির সেই বিশ্বকাপটি রাঙানোরই কথা ছিল তার। উরুগুয়ের বিপক্ষে শিরোপা-নির্ধারণী (ফাইনাল) ম্যাচের আগ পর্যন্ত টুর্নামেন্টটা নিজের রঙে রাঙিয়েও ছিলেন তিনি। প্রতিটা ম্যাচেই অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স করে দেশ ব্রাজিলকে একটু একটু করে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিরোপার খুব কাছে; কিন্তু শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচের একটা ভুলেই সব শেষ। নায়ক থেকে বারবোসা বনে যান ‘মারাকানজো ট্র্যাজেডি’র কলঙ্কিত নায়ক। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে তিনি হয়ে যান-‘কালপ্রিট।’ সেই কলঙ্কের কালিমা নিয়েই তাকে ‘বন্দি’ অবস্থায় কাটাতে হয় বাকি জীবন।
১০-২০ বছর নয়, কাটায় কাটায় ৫০টি বছর তাকে কাটাতে হয়েছে বন্দিজীবন। আইনের জেলখানায় নয়, বারবোসা বন্দি হয়েছিলেন ঘৃণার জেলখানায়! অপরাধ করে আইনের জেলখানায় বন্দি হলেও একটা স্বস্তি থাকে, জীবনের স্বাদ থাকে! কিন্তু ঘৃণার জেলখানার কয়েদি বারবোসার জীবনে কোনো কিছুই ছিল না। চরম পরিতাপের বিষয় হলো, যে ঠুনকো ভুলের অপরাধে বারবোসাকে ঘৃণারপাত্র বানিয়েছিল ব্রাজিলিয়ানরা, ফুটবলে সেটি আসলে তেমন অপরাধই না!
সেই ভুলটা কী ছিল জানার আগে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের উন্মাদনার মাত্রা বোঝাটা জরুরি। ব্রাজিল ফুটবলের দেশ। ফুটবল তাদের নেশা, পেশা। ফুটবলের চেতনা তাদের রক্তে। ১৯৩০ সালে যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়, ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবলীয় রক্ত টগবগ করে ফুটে ওঠে। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের ফুটবল-পাগল জাতি হিসেবে প্রমাণের এই তো সুযোগ। তবে সেজন্য তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে হবে; কিন্তু এক এক করে ৩টি বিশ্বকাপ (১৯৩০, ১৯৩৪ ও ১৯৩৮) মঞ্চ হয়। চ্যাম্পিয়ন দূরের কথা, ব্রাজিল শিরোপার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। প্রথম তিন আসরের ব্যর্থতায় ব্রাজিলিয়ানদের বিশ্বকাপ শিরোপা ক্ষুধা প্রকট হয়ে ওঠে।
অন্য ব্রাজিলিয়ানদের মতো বারবোসাও এই আক্ষেপ নিয়েই বড় হন। বিশ্বকাপ শিরোপা-খরা ঘুচানোর স্বপ্ন নিয়েই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন তারা। ১৯৩৮ বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর থেকেই জাতীয় দলের হয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেন বারবোসা। বছর দুয়েকের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন বিশ্বসেরা গোলরক্ষক হিসেবে। মাঠের উড়ন্ত ফর্মে বারবোসার বিশ্বকাপ স্বপ্ন আরও রঙ ছড়ায়; কিন্তু হায়! বারবোসার দুর্ভাগ্য, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে পরের দুটি বিশ্বকাপ (১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে) হতেই পারেনি।
ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে থাকা অবস্থায় বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটা বারবোসার জন্য চরম দুর্ভাগ্যই ছিল। তবে ১৯৫০ সালে যখন প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পান, তখনো বারবোসা বিশ্বসেরা। ২৯ বছর বয়সে ফর্মও তুঙ্গে। এই অবস্থায় বারবোসা এবং তার দেশবাসীর বিশ্বকাপ স্বপ্ন আরও রঙিন হয় বিশেষ একটি কারণে। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপটির আয়োজকও হয় বারবোসাদের ব্রাজিলই।
নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের দলটাও ছিল দুর্দান্ত। অসাধারণ সব তারকায় ঠাসা। সব মিলে নিজেদের মাটির বিশ্বকাপ ঘিরে ব্রাজিলিয়ানদের স্বপ্ন-উন্মাদনা আকাশ ছোঁয়। দেশবাসীর সেই স্বপ্নে আরও রঙ ছড়িয়ে বারবোসা, অগাস্তো, নিতন সান্তোস, আদেমির, ফ্রাসাও, জিজিনহোদের ব্রাজিল দুর্বার গতিতে শিরোপার খুব কাছেও চলে গিয়েছিল। ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটিও ব্রাজিল শুরু করেছিল এগিয়ে থেকে। রাউন্ড রবিন লিগের শেষ ম্যাচটির আগে প্রতিদ্বন্দ্বী উরুগুয়ের চেয়ে পয়েন্ট তালিকায় এগিয়ে ছিল স্বাগতিকরা। মানে মারাকানায় শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ড্র করলেও চলত বারবোসাদের। প্রথম বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতো ব্রাজিলের।
ঘরের মাঠ। প্রতিপক্ষ উরুগুয়েও ছিল তুলনামূলকভাবে অনেকটা দুর্বল। সমীকরণও পক্ষে। সব মিলে ব্রাজিলিয়ানরা ধরেই নিয়েছিল বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে তাদের। প্রথম বিশ্বকাপের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতে তাই মারাকানায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল দুই লাখেরও বেশি মানুষ। আমদর্শক থেকে শুরু করে ফুটবলবোদ্ধা, সাংবাদিক, রাজনীতিক-দেশটির আপামর জনসাধারণের একটাই বিশ্বাস ছিল-তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ব্রাজিলিয়ানদের সেই বিশ্বাস আরও গাঢ় হয়। ম্যাচের ৪৭ মিনিটে ব্রাজিলকেই প্রথম এগিয়ে দেন ফ্রাসাও। সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিশ্বাসে ম্যাচের শুরু থেকেই নাচতে থাকা মারাকানার টইটুম্বুর গ্যালারিতে তখন সমুদ্রের গর্জন।
ম্যাচটি ছিল রাতে। ব্রাজিলের গণমাধ্যমগুলো তাই ১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরই ব্রাজিলকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ধরে ম্যাচ রিপোর্ট তৈরি করে ফেলে। প্রস্তুত করে রাখে ছাপা খানার নিউজ প্লেটও। শুধু দু-এক জায়গায় ফাঁকা রাখে, স্কোর বসিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন তো আর এখনকার মতো কম্পিউটারে কম্পোজ হতো না। ছাপার প্লেটে হাতে অক্ষর বসিয়ে বসিয়ে নিউজ তৈরি করা হতো। তাই এই আগাম প্রস্তুতি; কিন্তু এতসব আয়োজন করতে গিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের একবারের জন্যও মনে হারের সংশয় জাগেনি! তা জাগলে কি আর নিজেদের চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ম্যাপ রিপোর্ট তৈরি করে ফেলে।
তাদের উচ্ছ্বাস-আবেগের স্রোত ভেদ করে সংশয় না জাগলেও বাস্তবে ঘটেছিল সেটাই। ব্রাজিলিয়ানদের বাড়া ভাতে পানি ঢেলে ম্যাচটা ২-১ গোলে জিতে দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। আর এই হারের জন্য ব্রাজিলিয়ানরা দায়ী করেন একমাত্র গোলরক্ষক বারবোসাকে। উরুগুয়ে যে জয়সূচক গোলটি পেয়েছিল বারবোসার ভুলেই!
ম্যাচের ৬৬ মিনিটে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান শাফিনো। মারাকানার ব্রাজিলিয়ান উন্মাদনায় তখনো তেমন ভাটা পড়েনি। কারণ, ১-১ গোলে ড্র হলেও তো চ্যাম্পিয়ন হতো ব্রাজিলই; কিন্তু ৭৯ মিনিটে ঠিকই একেবারে চুপসে যায় মারাকানা। দুর্দান্ত এক গোল করে মারাকানাকে স্তব্ধ করে দেন আলসিডেস ঘিঘিয়াও। ফুটন্ত তরকারিতে জগভর্তি পানি ঢেলে দিলে যেমন হয়, ঘিঘিয়াওয়ের গোলটির পর ঠিক সেভাবেই নিভে মারাকানার ফুটন্ত গ্যালারি। মুহূর্তেই মারাকানা পরিণত হয় শোকাহত বাড়ি!
ম্যাচের সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিলিয়ানদের সেই স্তব্ধতা আরও গভীর থেকে গভীর হয়। একটু আগেও যেখানে গগণবিদারী চিৎকার চেঁচামেচিতে মেতেছিল লক্ষাধিক মানুষ, ম্যাচ শেষের বাঁশির পর মনেই হচ্ছিল না, সেখানে জীবিত কোনো মানুষ আছে! বাতাসে কান পাতলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনার গোংড়ানির শব্দই শোনা যাচ্ছিল শুধু!
শুধু মারাকানা স্টেডিয়াম নয়। পুরো ব্রাজিলই হয়ে ওঠে শ্মশানপুরী। সর্বত্রই চলে শোকের মাতম। ব্রাজিলিয়ানদের এই বিশ্বকাপ স্বপ্নভঙ্গ ‘মারাকানাজো ট্র্যাজেডি’ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আর ব্রাজিলিয়ানরা এই ট্র্যাজেডির বলির পাঠা বানিয়েছে বারবোসাকে। তাদের এক কথা-বারবোসার জন্যই হারতে হয়েছে। সেই আসল কালপ্রিট।
বারবোসার দায় কিছুটা ছিলই। তবে দায় যতটা, তার চেয়ে লক্ষ-হাজার গুণ বাড়িয়ে তাকে ইতিহাসের কলঙ্কিত নায়ক বানিয়ে দেয় ব্রাজিলিয়ানরা। ঘিঘিয়াও মাঝমাঠ এলাকা থেকে বল ধরে ডানপ্রান্ত দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসছিলেন ব্রাজিলের গোলপোস্টের দিকে। গোলরক্ষক বারবোসা ভেবেছিলেন ঘিঘিয়াও হয়তো বাম প্রান্তে থাকা কোনো খেলোয়াড়কে লক্ষ্য করে পাশ বাড়াবেন। এ রকম পরিস্থিতিতে গোলরক্ষকরা সাধারণত সেটাই করেন। আর বিশ্বসেরা বারবোসা তো এরকম অভিজ্ঞতার মুখে কতবারই পড়েছেন। নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি পোস্ট ছেড়ে একটু ওপরে যান; কিন্তু তার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ঘিঘিয়াও ব্রাজিলিয়ান এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে নিজেই প্রথম পোস্ট লক্ষ্য করে শট নেয়। পোস্ট ঘেষে তার শট জড়িয়ে যায় ব্রাজিলের জালে।
বারবোসা অবশ্য শটটি রুখে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; কিন্তু তার প্রচেষ্টাটা ছিল অহেতুক। কারণ, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে ঘিঘিয়াওয়ের শট ঠেকানো সম্ভব ছিল না! মুহূর্তের সিদ্ধান্তে এমন ভুল অনেকেই করেন; কিন্তু বারবোসার এই ভুল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ছিল ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমা তারা কখনো করেওনি বারবোসাকে। বরং ঘৃণার জেলখানায় বন্দি করে রেখেছিল আজীবন। গণমাধ্যমসহ ব্রাজিলের আপামর মানুষের রায় ছিল-আমাদের বিশ্বকাপ উরুগুয়েকে উপহার দিয়েছেন বারবোসা। এমন দেশ-দ্রোহী কালপিটকে ক্ষমা করা যায়!
ওই ম্যাচের পর বারবোসার চারপাশে যেন অদৃশ্য একটা ঘৃণার দেয়াল ঝুলে যায়। যেখানেই গেছেন, মানুষ তাকে ঘৃণার তীরে বিদ্ধ করেছে। কাছের মানুষ থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, দেশবাসী তাকে কালপিট বলে গালি দিতে কার্পণ্য করেননি কেউই। বারবোসা বোবা মানুষের মতো মাথা নিচু করে সহ্য করেছেন সব। লজ্জায়, অপমানে মাথা তোলার সাহস পাননি কখনো। নিজেকে পরম অপরাধী ভেবে কাটিয়েছেন সব সময়।
সমালোচনা, ঘৃণার তীর থেকে বাঁচতে নিজের জীবনে শিকল পড়ান তিনি। জনসমক্ষে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেন। ওই ঘটনার পরও অবশ্য অনেক দিন ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন। সদস্য ছিলেন ব্রাজিল জাতীয় দলেও; কিন্তু ক্লাব বা জাতীয় দলের সতীর্থদের সাথেও সেভাবে মেশেননি। বেশির ভাগ সময়ই একাকী অনুশীলন করেছেন। ম্যাচ খেলতে নেমে যৌক্তিক কারণে গোল হজম করলেও গ্যালারি থেকে ভেসে এসেছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের স্লোগান। ফলে অনুশীলন বা ম্যাচ খেলে চুপচাপ বাড়িতে চলে এসেছেন। ফুটবলীয় কারণের বাইরে বাকি সময় বাড়িতেই কাটিয়েছেন।
খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর নিজেকে একেবারেই গৃহবন্দি করে ফেলেন। ঘুরতে বা শপিংমলে যাওয়া দূরের কথা, বাড়ির কাছের মুদি দোকানেও যেতেন না। অতি প্রয়োজনেও যদি বাড়ি থেকে বের হতেন, কেউ দেখলেই ঘৃণাভরে নানা রকম গালমন্দ করত। এমনভাবে তাকাতো যেন, একসঙ্গে কত মানুষকে খুন করেছেন! হাসি, আনন্দ, হই-হুল্লোড়, এসবের কোনো কিছুই আর বারবোসার জীবনে ছিল না। মন খুব বেশি রকম বিষিয়ে উঠলে কখনো সখনো নিজের সাবেক ক্লাবগুলোর খেলা দেখতে চুপিচুপি স্টেডিয়ামে যেতেন। তবে বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতেন না।
তার জীবদ্দশাতেই ৪টি বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০ ও ১৯৯৪ সালে; কিন্তু এতগুলো বিশ্বকাপ জয়ের পরও বারবোসাকে ক্ষমা করেনি ব্রাজিলের মানুষ। জীবনের পড়ন্তবেলায় এই কষ্টের জীবন নিয়ে ব্রাজিলের এক গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন বারবোসা। সাক্ষাৎকারে তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে অতি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছরের জেল। অথচ ৫০ বছরেও আমার অপরাধের ক্ষমা হলো না!’
ব্রাজিলের মানুষ তাকে কতটা ঘৃণা করত, তা বোঝাতে গিয়ে বিশেষ একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন বারবোসা, ‘ওই মারাকানাজো ঘটনার অনেক অনেক বছর পর একবার আমি একটা শপিংমলে যাই। লোকজন যেন আমাকে চিনতে না পারে, সেজন্য খানিকটা ছদ্মবেশও নিয়েছিলাম; কিন্তু শপিংমলের ভিড়ের মধ্যে ঠিকই এক ভদ্র মহিলা আমাকে চিনে ফেলে। যিনি ছোট্ট একটা বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে শপিংমলে এসেছিল। আমাকে দেখার পরই ভদ্র মহিলা নিজের সঙ্গের বাচ্চাটিকে বলে উঠে, বাবু দেখ, দেখ, ওই যে ওই লোকটি আমাদের ১৯৫০ বিশ্বকাপ জিততে দেয়নি! কথাটা বলার সময় ভদ্র মহিলা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যেন ঘৃণার ছুরি দিয়ে আমাকে খুন করে ফেলবে!’
ঘিঘিয়াওয়ের ওই গোলের পর ব্রাজিলের আর সবার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন বারবোসা নিজেই। বুকফাটা সেই কষ্টটা বিশেষ এক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তও করেছিলেন তিনি। ম্যাচ শেষে তার অন্য সতীর্থরা যখন কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, বারবোসা তখন গোলপোস্টের জাল ধরে উদাস বদনে তাকিয়ে থাকেন। বুঝিয়ে দেন, তিনি গোলপোস্টের জালে বন্দি! ওই ছবিটাই পরবর্তীতে তার জীবনের প্রতীকী ছবি হয়ে ওঠে।
জীবনের শেষ দিকে একবার শ্যূট-টাই পরে কেতাদূরস্ত হয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে ঠিক সেভাবেই নিজেকে গোলপোস্টের জালে আড়াল করে একটা ছবি তোলেন বারবোসা। সেই ছবির বার্তাও ছিল ওই একটাই, ১৯৫০-এর মারাকানাজো ট্র্যাজেডি যেভাবে জালে বন্দি করেছিল তাকে, এখনো সেভাবেই বন্দি আছেন তিনি। ৫০ বছরেও মুক্তি মেলেনি তার। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইট-কংক্রিটের জেলখানার লোহার শিকলও ছিঁড়ে ফেলা যায় বা ছিঁড়ে যায়, কিন্তু সুতোর তৈরি এই জাল ছেঁড়া যায় না।
মারাকানাজো ট্র্যাজেডি’র পর পাক্কা ৫০ বছর বেঁচে ছিলেন হতভাগা বারবোসা। দীর্ঘ এই সময় চাতকর পাখির মতো একটা আশা নিয়েই বেঁচে ছিলেন, হয়তো ব্রাজিলের মানুষ তার ভুলটা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। ক্ষমা করে দিয়ে ঘৃণার পরিবর্তে তাকে একটু ভালোবাসবে; কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। ব্রাজিলিয়ানদের নিষ্ঠুর হৃদয় গলেনি।
শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘৃণা, অপমান, গালমন্দ থেকে অবশ্য তার মুক্তি মিলেছে। তবে ব্রাজিলের জনগণের পক্ষ থেকে নয়, তার মুক্তির দরজাটা খুলেছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়, মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। ২০০০ সালের ৭ এপ্রিল ৭৯ বছর বয়সে পরপারে চলে গেছেন বারবোসা। সৃষ্টিকর্তার ডাকে দুনিয়া ত্যাগের দুই দশক পর ব্রাজিলের মানুষ যেন কিছুটা নমনীয় হয়েছে।
নয়তো গ্যাব্রিয়েল বারবোসার উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের আলোচনায় ২০ বছর আগে ওপাড়ে চলে যাওয়া বারবোসাকে স্মরণ করা হবে কেন! শুধু স্মরণ করা নয়, প্রয়াত মোয়াসির বারবোসাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনও ছেপেছে ব্রাজিলের কতিপয় গণমাধ্যম। সেসব প্রতিবেদনেই নমনীয়তার সুর। ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার সুবাস; কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের এই অতি বিলম্বিত ভালোবাসার কোনো মানে আছে দুই দশক আগে ওপাড়ের বাসিন্দা বনে যাওয়া বারবোসার কাছে?