Logo
×

Follow Us

খেলাধুলা

রনি ও লিয়নের ফুটবলে দারিদ্র্যের জয়

Icon

মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২২, ১৫:৫৩

রনি ও লিয়নের ফুটবলে দারিদ্র্যের জয়

ট্রফি হাতে রনি মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

তৃণমূল থেকে উঠে এসে ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানোর রেকর্ড নেহায়েত কম নয়। বাংলাদেশেও এই নজির রয়েছে। তবে যারা এভাবে উঠে এসেছেন তাদের আবার হারিয়ে যাওয়ার রেকর্ডও রয়েছে। এই যেমন সর্বশেষ ব্রাজিলে অনুশীলন করে আসা জগেন লাড়কা এখন কৃষি কাজ করছেন। যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন আবারো সেখানেই ফিরে গেছেন। তাকে ঠিকঠাক যত্ন নিলে দেশের ফুটবলই উপকৃত হতো।

তবুও আবারো ব্রাজিলে যাচ্ছেন ১১ জন ছেলে ও ১১ জন মেয়ে। তাদের মধ্যে বালু তোলা শ্রমিক রয়েছেন একজন। তার সুযোগ পাওয়ার মধ্যদিয়ে ফুটবলে আবারো দারিদ্রের জয় হয়েছে। রনি মিয়া সেই সৌভ্যাগ্যবানদের একজন। নিয়মিত বালু তোলার কাজ করলেও তার মনেপ্রাণে ছিল ফুটবলপ্রেম। পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে নিজের মনের খোরাক মেটাতে ফুটবল নিয়ে মাঠে ছুট দিতেন। ভালোবাসার প্রতিদান রনি মিয়া পেয়েছেন। বৃদ্ধ বাবা তৈয়ব আলী পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বাবার এই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে নদীতে বালু তোলার মেশিনে কাজ করা শুরু করেন রনি। এরপরও ফুটবল থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি। বাবার কষ্টের সংসারে যেখানে তিন বেলা খাওয়াই দায়, সেখানে মাঠে ফুটবল খেলাটা তাই কঠিনই। 

দিনরাত নানা সমস্যার মধ্যদিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্য হয়ে ফুটবল খেলাটা তাই বিলাসিতার মতোই মনে হয়েছিল রনি মিয়ার জন্য। তবু ভালোবাসার টানে ফুটবলটাই ছিল তার কাছে কষ্ট ভুলে থাকার মাধ্যম। কিন্তু বুট কেনার টাকা না থাকার পাশাপাশি ন্যূনতম সুবিধাটুকু পেতেন না। অনেকটা স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে নদী পাড় হওয়র মতো করেই প্রতিকূলতা জয় করেছেন রনিা! তবুও থামেন না, কারণ দৃষ্টি তার বহুদূরে। এরপরই অনেকটা হঠাৎ করে তার সুযোগ হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হবার। বেতন দিতে না পারায় থেমে যায় বিকেএসপি অধ্যায়।

নতুন এক সংগ্রামে নিজেকে শামিল করেন রনি, ফুটবল পায়েই স্বপ্ন বুনতে থাকেন হবিগঞ্জের এই কিশোর ফুটবলারের। ঠিক তখনি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের নজরে পড়ে সে। তাতেই পুরোপুরি বদলে যায় রনির ভাগ্য। আর এখন তো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য পেলে, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদেনিহো, নেইমারদের দেশ ব্রাজিলে যাচ্ছে সে। ২০১৮ সালে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা দ্য অলিভিয়েরা জুনিয়র বাংলাদেশ থেকে কিশোর ফুটবলারদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রাজিলে পাঠানোর কাজ শুরু করেন। তার সহযোগিতা এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো চারজন কিশোর ফুটবলার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণ নিতে যায়। 

আর এবার দ্বিতীয়বারের মতো ১১ জন যাচ্ছে ফুটবলের দেশটিতে। গত দু’বছর অবশ্য করোনা ভাইরাসের কারণে এই কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সুযোগ পাওয়াদের একজন রনি মিয়া। বালু তোলার কাজের ফাঁকে এলাকায় বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নিতেন। তেমনই এক টুর্নামেন্টে রনির খেলা দেখে চোখ আটকে যায় ব্যারিস্টার সুমনের। রনিকে নিয়ে এসে নিজের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করে দেন এই গুণী মানুষটি। একাডেমিতে নাম লেখানোতেও ছিল কিছু বাধা। বড় ভাইকে বিদেশ পাঠাতে রনির বাবা ফসলি জমি বন্ধক রেখেছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে রনির আরেক ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। অন্যদিকে রনি বালু তুলতো। ফুটবল খেললে টাকা উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের সমস্যা সমাধান হবে এই আশা ছিল। ব্যারিস্টার সুমনকে এসব আগেভাগেই জানিয়ে দেয় রনি। সবকিছু শুনে রনিকে এক লাখ টাকার একটি চেক দেন সুমন। সেই টাকা দিয়ে রনিদের বন্ধকি জমি ছাড়িয়ে নেন। পাশাপাশি সুমনের একাডেমিতে খেলার সুযোগ করে দেওয়া হয় রনিকে। এই একডেমিতে তিন বছর ধরে নিয়মিত খেলছে সে। 

রনি মিয়ার মতো দারিদ্র জয় করা আরেক ফুটবলার হচ্ছেন লিয়ন প্রধান। রংপুরের পীরগঞ্জ ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় দরিদ্র পরিবারের এই সন্তান উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে ব্রাজিলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিদপ্তরের সহযোগিতায় চলতি মে মাসে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন লিয়ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২১, বালক অনূর্ধ্ব-১৭ এর প্রতিভাবান ৪০ জন খেলোয়াড়ের বিকেএসপিতে ২ মাসব্যাপী উন্নত প্রশিক্ষণ থেকে ব্রাজিলে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য যে ১১ জনকে বাছাই করা হয় তার মধ্যে লিয়ন একজন।

রংপুরের পীরগঞ্জ সরকারি শাহ আবদুর রউফ কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। পীরগঞ্জ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধনশালা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও খাদিজা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে লিয়ন। তাদের বসতভিটা ছাড়া জমি বলতে কিছুই নেই। সংসারের খরচ চালাতে অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়। অভাবের কারণে দুই ছেলেমেয়ের খাবারই ঠিকমতো জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। স্কুলে যাওয়ার জন্য লিয়ন একটা বাইসাইকেল চাইলেও বাবা সেটি কিনে দিতে পারেনি। অভাবের মধ্যে বড় হওয়া ছেলেটাই ফুটবল খেলার জন্য ব্রাজিল যাচ্ছে, বাবা হিসেবে এ যেন অনেক বেশি গৌরবের রফিকুলের জন্য।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫