
প্রথমবারের মতো সাফ শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ নারী দল। ছবি: সংগৃহীত
যে কোনো মানুষের বাল্য, স্কুল কিংবা প্রাথমিক শিক্ষাটা যথেষ্ট ও উপযুক্ত হলে তার জীবন সার্থক হবেই। সবকিছুর মতো একজন ফুটবলারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই যে আমাদের মেয়েরা প্রথম বারের মতো নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল, তার মূলে কিন্তু ওই শেকড়ের শিক্ষা।
শুধু নারী ফুটবলাররাই নয়, আমাদের বয়সভিত্তিক দলগুলোও সাফল্য দেখিয়েছে ও দেখাচ্ছে। এতে প্রতীয়মান, ফুটবলারদের প্রাথমিক শিক্ষায় সম্ভবত বেশ যত্ন নেওয়া হচ্ছে। তাই ফুটবলের গোড়া বা শেকড়ে একটা নতুন আলোর ঝলকানি লক্ষ করা গেছে। এটা অব্যাহত রাখতে পারলে ফুটবল তার হারানো গৌরব ও জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ গ্রুপপর্বে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের বিপক্ষে বড় জয় নিয়ে নকআউট পর্বে জায়গা করে নেয়। শ্রীলংকাকে ৫-১ গোলে ও মালদ্বীপকে ৫-০ গোলে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ দল। শ্রীলংকার বিপক্ষে বড় জয়ে মুর্শেদ ও নাজিউদ্দিন ২টি করে গোল করেন। মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচে মুর্শেদ আবারও দুটি গোল করে কৃতিত্ব দেখান। তবে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন বাংলাদেশের মিরাজুল। তিনি ৭৪, ৭৭ ও ৯৭ মিনিটে গোল করে হ্যাটট্রিক করেন। নকআউট পর্বে শক্তিশালী ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। চমৎকার খেলেও ম্যাচে জিততে পারেনি তারা।
প্রথমার্ধে দারুণ খেলে ভারতের সব আক্রমণ প্রতিহত করা ছাড়াও বেশ কয়েকবার গোলের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ার্ধের ৫ মিনিটে প্রথম গোল খেয়ে বসে বাংলাদেশ। এরপর ২ মিনিটের ব্যবধানে ফের গোল হজম করলে পরাজয় প্রায় ঘনিয়ে আসে। ম্যাচের ৬০ মিনিটে বাংলাদেশের মিরাজুল একটি গোল পরিশোধ করলে খেলা জমে ওঠে। কিন্তু ভারতীয় দল বাংলাদেশের সব আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়ায় পরাজয় নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় বাংলাদেশ দলকে। ৯০ মিনিটে কঠিন লড়াই করেও ১-২ গোলে হেরে যায়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, তারা ফাইনালে উঠতে পারেনি। তবে সব মিলিয়ে ভালো খেলেছে বাংলাদেশের কিশোররা।
এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বেও বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো করেছে। শক্তিশালী বাহরাইনের বিপক্ষে ম্যাচ ড্র করেছে গোলশূন্যভাবে। অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে স্বাগতিকদের জয় থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশের যুবারা। দ্বিতীয় ম্যাচে বেশ ভালো খেলে ভুটানের বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয় পেয়েছে। বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের কাছে ভালো খেলেও ০-৩ পরাজিত হয়েছে। বাহরাইনের সঙ্গে ড্র করা জয়ের সমান মর্যাদার। কারণ বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাহরাইন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দল আরবের দেশ বাহরাইনের সঙ্গে ড্র করার পর ওই দেশের পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের ব্যাপক প্রশংসা করেছে।
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল শিরোপা জয়ের ইতিহাস গড়ার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই প্রমাণ করেছে। ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ৩-০ গোলে মালদ্বীপকে পরাজিত করে। সাবিনা খাতুন একাই দুটি গোল করেন। দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের জালে ৬ গোল দেয় বাংলাদেশ। এ ম্যাচে বাংলাদেশের সেরা স্ট্রাইকার সাবিনা হ্যাটট্রিক করেন। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের সেরা দল, পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী ভারতকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয়। ম্যাচে স্বপ্না একাই দুটি গোল করেন। সেমিফাইনালে বাংলাদেশ ৮-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে ভুটানকে হারিয়ে বুঝিয়ে দেয় দক্ষিণ এশিয়ায় তারাই শ্রেষ্ঠ।
বিস্ময়কর হলো, ফাইনাল ওঠা পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো গোল হজম করেনি। বাংলাদেশ এই আসরের আগে মাত্র একবার ফাইনালে উঠেছিল। ২০১৬ সালের সেই ফাইনালে বাংলাদেশ ১-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল ভারতের কাছে। এবার পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন সেই ভারতকে পাত্তাই দিল না লাল-সবুজের দলটি। সবশেষ ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা, দুটো পুরষ্কারই পেয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
ফুটবলে এই যে একটা সুন্দর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা কি এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কাজে লাগানোর চিন্তা-ভাবনা করবে, নাকি সাফল্যকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই জড়িয়ে থাকবে? সাধারণত একসঙ্গে নারী ও বয়সভিত্তিক ফুটবলে ভালোর পথ তৈরি হওয়ার ঘটনা ঘটে না। এবার এই সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা দারুণ খুশি। কারণ সামনে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল। তখন এমনিতেই বাংলাদেশে চলবে ফুটবলের জোয়ার। ফুটবলের তৃণমূলে বা শেকড়ে এই বিপুল সম্ভাবনাটা এবার যেন হারিয়ে না যায়, সেটাই সকলের প্রত্যাশা।