-copy-637b82993e609.jpg)
খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্বাগতিক দেশগুলো নতুন নতুন নয়নাভিরাম স্টেডিয়াম নির্মাণ করে থাকে। কাতারও এর ব্যতক্রিম নয়। তারা রাস আবু স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে শুধু বিশ্বকাপের জন্য। বিশ্বকাপ আসরের পর পরই এটি ভেঙে ফেলা হবে। সে কারণেই ফুটবলে স্টেডিয়াম বরাবরই দর্শকদের কাছে আগ্রহের বিষয়। কোন মাঠে খেলা হচ্ছে, সেখানে দর্শক উপস্থিতি কেমন হতে পারে, সুযোগ-সুবিধা কেমন- সেসব জানতে সাধারণ দর্শক সব সময় উৎসুক হয়ে থাকে। এমনকি স্টেডিয়ামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়েও দর্শকের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে।
স্টেডিয়াম নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বড় আয়োজনগুলো কেন্দ্র করে। যেমন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্ব আসরের সময় যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, তারকা ও খেলার পাশাপাশি স্টেডিয়ামগুলো ঘিরেও চলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। কাতার বিশ্বকাপেও সবার চোখ থাকবে তাই স্টেডিয়ামগুলোর দিকে। সেগুলোর রঙিন আলোর নিচেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে দলগুলোর। সেখানে কেউ উচ্ছ্বাসে ভাসবে, কেউ পুড়বে হতাশায়।
এবারের কাতার বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে আটটি স্টেডিয়ামে খেলা হবে। এসব স্টেডিয়ামের বেশির ভাগই বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুনভাবে নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে পরিচিত অলিম্পিক নিয়ে যে উন্মাদনা থাকে, ফুটবলে বিশ্বকাপ এলে সেই উন্মাদনা বেড়ে যায় কয়েকশ গুণ। পুরো বিশ্ব ফুটবলজ্বরে আক্রান্ত থাকে এই এক মাস। প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর জুন-জুলাইয়ে সমগ্র পৃথিবী একটা বিন্দুতে মিলে যায়। ফুটবল আবেগের সর্বোচ্চ প্রদর্শনীও দেখা যায় বিশ্বকাপে। এবার এই মহাযজ্ঞ বসবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দেশ কাতারে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের দিন গণনা এর মধ্যে শুরু হয়েছে কয়েকবার। বিশ্বকাপকে বরণ করে নিতে এখন থেকে অধীর আগ্রহে বসে থাকেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে কাতারের নান্দনিক স্টেডিয়ামগুলো। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ হবে কাতারের রাজধানী দোহা থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরের শহর আল খোরে অবস্থিত আল বায়াত স্টেডিয়ামে। ২০ নভেম্বর উদ্বোধনী দিনের প্রথম ম্যাচে ইকুয়েডরের মুখোমুখি হবে স্বাগতিক কাতার।
এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ব্যস্ততম ভেন্যু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে আল বায়াত স্টেডিয়ামকে। ৬০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালসহ গ্রুপ পর্বের ৯টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে এবারের আসর। এবার যেসব স্টেডিয়ামে শিরোপার জন্য দলগুলো লড়বে, সেসব মাঠ সম্পর্কে একনজরে জেনে নেওয়া যাক।
খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম
৪৫ হাজার ৪১৬ দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামের নাম ‘খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম’। ১৯৭৬ সালে নির্মিত এই স্টেডিয়ামই একমাত্র ভেন্যু, যেটি কাতার বিশ্বকাপের আয়োজকস্বত্ব লাভের আগ থেকেই পুরোপুরি চালু অবস্থায় ছিল। এখানেই ২০১১ সালের এশিয়ান কাপের ফাইনাল এবং ২০১৯ সালের ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে ম্যাচে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিল লিভারপুল ও ফ্লামেঙ্গো। সে হিসেবে কাতারের সবচেয়ে আইকনিক স্টেডিয়ামগুলোর একটি হচ্ছে এই খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম। রাজধানী দোহায় এই স্টেডিয়াম প্রথম চালু করা হয় ১৯৭৬ সালে। বিশ্বকাপ সামনে রেখে ২০১৭ সাল থেকে স্টেডিয়ামটির সংস্কারকাজ শুরু করা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী এই স্টেডিয়ামে এশিয়ান গেমস দ্য গলফ কাপ এবং এএফসি এশিয়া কাপের মতো বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। এখন অপেক্ষা কেবল বিশ্বকাপের বাঁশি বাজার।
আল জানোব স্টেডিয়াম
৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার আল জানোব স্টেডিয়াম। রাজধানী দোহার দক্ষিণে আল ওয়াকরাহ শহরে অবস্থিত স্টেডিয়ামটির নকশা করা হয়েছে মুক্তা ও মাছ শিকারে ব্যবহৃত নৌকার আদলে। বিশ্বকাপ সামনে রেখেই কাতারের আল ওকারাহ অঞ্চলে বানানো হয়েছে আল জানোব স্টেডিয়ামটি। ২০১৯ সালে আমির কাপ ফাইনাল দিয়ে যাত্রা শুরু করা হয়েছে স্টেডিয়ামটির। আলোচিত সেই ম্যাচে আল সাদকে ৪-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে আল দুহাইল ক্লাব। স্টেডিয়ামটি ডিজাইন করেছেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইরাকি স্থপতি জাহা হাদিদ। দেশটির স্থানীয় বিশেষ একটি বোটের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এই স্টেডিয়াম।
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম
৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার আল রায়ান স্টেডিয়াম। এটি কাতারের সবচেয়ে সফল ক্লাব আল রাইয়ানের হোম গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত। স্টেডিয়ামটি একই নামের পুরনো ভেন্যুতে বিশ্বকাপের উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এটি একটি মেট্রোস্টেশন এডুকেশন সিটির কাছে অবস্থিত হওয়ায় এটি ‘এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। এটির অবস্থান শহরের সঙ্গে মরুভূমির সংযোগস্থল হিসেবেও চিনে থাকেন। বিশ্বকাপের পর এরও ধারণক্ষমতা কমিয়ে আনা হবে বলে জানা গেছে। স্টেডিয়ামটি নির্মাণে ২০ শতাংশ সবুজ কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব স্টেডিয়ামগুলোর একটি। ২০০৩ সালে এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হলেও বিশ্বকাপ সামনে রেখে ফের সংস্কার করা হয়েছে।
আল থুমামা স্টেডিয়াম
আল থুমামা স্টেডিয়ামটির দর্শক ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার। রাজধানী সেন্ট্রাল দোহার নিকটবর্তী এই স্টেডিয়ামটির অবস্থান হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একেবারে কাছে। এটি গাহফিয়ার আদলে নির্মিত। গাহফিয়া হচ্ছে মূলত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পুরুষদের পরিধানের একটি ঐতিহ্যবাহী টুপি। অন্য ম্যাচের পাশাপাশি এই স্টেডিয়ামে থাকবে কোয়ার্টার ফাইনালের একটি ম্যাচ। বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টের পর ধারণক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে। ২০২১ সালে আমির কাপ ফাইনাল দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে আল থুমামা স্টেডিয়াম। কাতারি স্থপতি ইব্রাহিম এম জাইদাহ এই স্টেডিয়ামের নকশা করেছেন। আরব দেশে টুপি পরা লোকের মাথার মতো করে বানানো হয়েছে স্টেডিয়ামটি। যে কারণে বিশেষত্ব পেয়েছে এটি।
স্টেডিয়াম ৯৭৪
আবু আবাউন্ড স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’-এর ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার দর্শক। দোহার ওয়াটার ফ্রন্টে শিপিং কন্টেইনার দিয়ে তৈরি পপআপ স্টেডিয়ামটি বিশ্বকাপের পর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হবে। এটিকে রাস আবু স্টেডিয়াম হিসেবেও কেউ কেউ চিনে থাকেন। ৯৭৪ নম্বরটি কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড। স্টেডিয়াম নির্মাণে ব্যবহৃত কন্টেইনারের সংখ্যাও ৯৭৪। ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর বিশেষ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয় স্টেডিয়াম ৯৭৪। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ফিফা আরব কাপের উদ্বোধনী দিনে এই মাঠে প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। স্টেডিয়ামে প্রাকৃতিকভাবে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো কুলিং টেকেরও প্রয়োজন রাখা হয়নি। বিশ্বকাপের পর এটিও সম্পূর্র্ণ ভেঙে ফেলা হবে। বিশ্বকাপে নকআউট পর্বের ম্যাচসহ এখানে সব মিলিয়ে সাতটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
লুসাইল স্টেডিয়াম
লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণক্ষমতা ৮০ হাজার। দর্শক ধারণক্ষমতার হিসাবে কাতারের সর্ববৃহৎ এই স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। সেই সঙ্গে প্রথম সেমিফাইনালসহ গ্রুপপর্ব ও নকআউট পর্বের বেশকিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে এখানে। রাজধানী সেন্ট্রাল দোহা থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে লুসাইল নামক স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্টেডিয়ামটি। কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি চোখ থাকবে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের দিকে। এ ছাড়া ফাইনাল ও সেমিফাইনালসহ এই মাঠে ম্যাচ হবে ১০টি। গ্রুপ পর্বে আলাদা আলাদা ম্যাচে এই মাঠে খেলতে নামবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের মতো ফেভারিট দলগুলো।
আল বায়াত স্টেডিয়াম
৬০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার আল বায়াত স্টেডিয়ামটি কাতারের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিসেবে পরিচিত। এই ভেন্যুতে উদ্বোধনী ম্যাচ ও দ্বিতীয় সেমিফাইনালসহ মোট ৯টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। টুর্নামেন্ট শেষে ওপরের অংশ সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা অবশ্য রয়েছে। এটি তৈরি করা হয়েছে বেদুইনদের তাঁবুর আদলে। স্টেডিয়ামটির অবস্থান রাজধানী দোহা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে কাতারের উত্তর-পূর্ব উপকূলে। সবচেয়ে বড় লুসাইল স্টেডিয়ামের পর সবচেয়ে বেশি চোখ থাকবে এই আল বায়াত স্টেডিয়ামের দিকে। আরব কাপে বাহরাইন-কাতার ম্যাচ দিয়ে যাত্রা শুরু এই স্টেডিয়ামটির। এই স্টেডিয়ামে একটি সেমিফাইনাল, একটি কোয়ার্টার ফাইনাল, একটি দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামটি ৪৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার। এটি কাতারের আল রাইয়ান শহরে অবস্থিত। স্টেডিয়ামটি স্থানীয়ভাবে ফুটবলপ্রিয়দের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি নির্মাণ করা হয় ২০০৩ সালে। স্টেডিয়ামটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কোনো থ্রি-ডি সিনেমা দেখা হচ্ছে। বসার চেয়ারগুলো ব্যবহার করা যাবে যার যার ইচ্ছামতো। স্টেডিয়ামের আলোকসজ্জায় অবশ্য ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ধরনের বাতি। আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম, যেটি ‘আল রাইয়ান স্টেডিয়াম’ নামেও অনেকের কাছে সমধিক পরিচিত। আল রাইয়ান ও আল খারিথিয়াত ক্লাব এই স্টেডিয়ামকে নিজেদের হোম ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। স্টেডিয়ামটি প্রথম তৈরি করা হয় ২০০৩ সালে। তখন স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ছিল ২১ হাজারের মতো। তবে নতুন করে সংস্কার করার পর এই মাঠের ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়। বিশ্বকাপে এই মাঠে অনুষ্ঠিত হবে সাতটি ম্যাচ।
পরিশেষে
কাতার বিশ্বকাপে ৮টি স্টেডিয়ামের পরিচিতি পর্ব শেষ। এখন অপেক্ষা বাঁশি বাজার। বিশ্বকাপে প্রায় এক মাস ধরে এই স্টেডিয়ামগুলোর ওপরই থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের কৌতূহলী দৃষ্টি। এখানেই রচনা করা হবে আনন্দ-বেদনার উপাখ্যান। এখন অপেক্ষা সেই মহেন্দ্রক্ষণের।