
মরক্কোর বিপক্ষে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে পর্তুগাল। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামের এক সুপারস্টার এখন যেন গলার কাঁটা হয়ে আছে পর্তুগালের জন্য। নিয়মিত অধিনায়ক হলেও তাকে ছাড়াই শেষ ষোলতে শুরুর একাদশ সাজিয়েছিলেন কোচ ফার্নান্দো সান্তোস। তাতেই যেন চটেছেন সিআর সেভেন। ছিলেন না গতকালের দলীয় অনুশীলনে।
এই অবস্থার মধ্যেই আজ রাত ৯টায় আল থুমামা স্টেডিয়ামে মরক্কোর বিপক্ষে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই নামতে যাচ্ছে ইউরোপের দলটি। এই লড়াইটা ইউরোপের সাথে আফ্রিকারও। কারণ মরক্কো যে ছেড়ে কথা কইবেনা এটা বলাই যায়। এখন প্রশ্ন মরক্কো পর্তুগালের পথের কাটা হতে পারবে তো? আর রোনালদোর শেষটা মধুর হবে তো? পর্তুগালের জন্য তিনি মুকুটহীন সম্রাট। দেশটার একমাত্র আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দেয়ার মূল সারথি। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আর বয়সের ভ্রুকুটিতে এখন এমন সমালোচনা যার নিত্যসঙ্গী। যার সমালোচনা করার আগে মানুষকে দশবার ভাবতে হতো, পারফরম্যান্স দিয়েই যিনি চুপ করাতেন সংশয়বাদীদের কোলাহল, সেই রোনালদোর বয়সী পা দুটো যেন এখন আধুনিক ফুটবলের জন্য বড্ড বেমানান। কে ভেবেছিল, এমন দিনও আসবে ফুটবলে! কয়েক দিন আগেও ‘মেসি না রোনালদো’ তর্কে গরম থাকা চায়ের টেবিলগুলো এখন বড্ড নিশ্চুপ।
অন্যদিকে রোনালদোভক্তদের কথার তুবড়িতে সরগরম হয় না ছুটির দিনের আড্ডা। পর্তুগিজ মহাতারকার সবচেয়ে বড় ভক্তও এখন হয়তো স্বপ্ন দেখেন না, প্রিয় আইডলের হাতে আরেকটিবার শোভা পাবে ব্যালন ডি'অর বা ফিফা বর্ষসেরার জ্বলজ্বলে ট্রফি। যে তারকা আগে আক্রমণভাগের বিভিন্ন পজিশনে ত্রাস ছড়াতেন, সে তারকার নতুন ‘পজিশন’-ই যে আশা জাগায় না ভক্তদের। বেঞ্চে বসে কে-ই বা কবে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হতে পেরেছে? লিগে ১৩ ম্যাচের মাত্র তিনটিতে খেলতে পেরেছেন পুরো ৯০ মিনিট। বড় কোনো ম্যাচে রোনালদোর ওপর ভরসা রাখেন না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ এরিক টেন হাগ। অ্যাস্টন ভিলা, ওয়েস্ট হ্যাম, ব্রেন্টফোর্ড, শেরিফ তিরাসপোল, ওমোনিয়ার মতো দলগুলোই এখন তার ৯০ মিনিট মাঠে থাকার টিকিট। তারই বিখ্যাত করা সেই ‘সিইইইউ’ উদযাপন দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় চাতক পাখির মতো।
এখন বেশি করে প্রচলিত ‘রোনালদো না খেললেই বরং দল ভালো খেলে’ এ কথাটাও ধীরে ধীরে সত্যে রূপ নিচ্ছে। সেটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে হোক বা পর্তুগালের হয়ে। পর্তুগিজ সংবাদমাধ্যম আ বোলা লিখেছে, ‘কম রোনালদো, বেশি পর্তুগাল’।
ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, রোনালদোকে কেন্দ্র করে যত কম খেলানো যায়, পর্তুগালের জন্য তত মঙ্গল। বাড়তি বয়সের কারণে আর দশজন খেলোয়াড়ের মতো রোনালদোর ক্ষমতায়ও যে মরচে পড়েছে, সেটা বোঝার জন্য পিএইচডিধারী হওয়া লাগে না। পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস অবশ্য সে দলে পড়েন না। অধিনায়ককে এখনো পারলে প্রতি ম্যাচে ৯০ মিনিট করে খেলান। দেশটাকে ২০১৬ সালে ইউরোর স্বাদ এনে দেয়া এই কোচ। গোলের জন্য তাকিয়ে থাকেন দেশের জার্সি গায়ে ১১৭ গোল করা নিজেদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড়ের দিকেই। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এবার বিশ্বকাপেও সেই ধারার ব্যতিক্রম হবে না। বের্নার্দো সিলভা, ব্রুনো ফার্নান্দেস, জোয়াও কানসেলো কিংবা রাফায়েল লিয়াওদের মনোযোগ থাকবে রোনালদোকে দিয়ে গোল করানোর দিকেই।
প্রতিপক্ষ মরক্কো বড় দল না হলেও তাদেরকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য এখানেও নিন্দুকরা নাক সিঁটকাতে কসুর করেন না। রোনালদোর শৈশবের ক্লাব স্পোর্তিংয়ের সাবেক কোচ তিয়াগো ফের্নান্দেসই যেমন বলে দিয়েছেন, রোনালদোই নির্ধারণ করেন পর্তুগালের হয়ে তিনি কখন, কত মিনিট খেলবেন, সান্তোস নন। ১৯৯২ সাল থেকে পর্তুগালের জাতীয় দল নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষক আন্তোনিও তাদেইয়ার ভাষ্যও এমনই। রাজার ওই রাজত্ব হাতছাড়া হয়েছে আগেই। বিশ্ব ফুটবলের এবারের মহাযজ্ঞে শেষবারের মতো ওই রাজমুকুট পরার হাতছানি রোনালদোর সামনে। শত সমালোচনার তির উপেক্ষা করে কেউ যদি এই বয়সেও ওই রাজমুকুট স্পর্শ করতে পারেন, সেটা রোনালদোই। ঠিক যেমন পেরেছিলেন ২০১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগের উত্তাল সেই রাতে ভলফসবুর্গকে স্তব্ধ করে দিতে, যেমন পেরেছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দলকে টেনে বিশ্বকাপে তুলতে, যেমন পেরেছিলেন সবচেয়ে বয়সী খেলোয়াড় হয়ে বিশ্বকাপে স্পেনের মতো দলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করতে, যেমন পেরেছিলেন জুভেন্টাসের হয়ে সিমেওনের আতলেতিকোর তর্জন-গর্জন থামিয়ে দিতে। পারলে তার বিদায়টা একটু বেশি মধুর হবে। অবশ্য যদি না-ও পারেন, ক্ষতি নেই।
আর এত বছর ধরে ফুটবলপ্রেমীদের আনন্দসাগরে ভাসানো মহাতারকার আলোকচ্ছটাকে বিশ্বকাপহীনতার আক্ষেপ হয়তো একটু আবছা করে দেবে, নিবিয়ে তো আর দিতে পারবে না! শেষ ষোলতে টাইব্রেকারে জিতলেও মনোবলের দিক থেকে বেশ চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে মরক্কো। আফ্রিকার শক্তিধর ফুটবলের সাথে ইউরোপের শক্তি আর কৌশলের মিশ্রণ দেখবেন আজ দর্শকরা। শেষ হাসি কে হাসবেন সেটাই দেখায় অপেক্ষা।