
দিদিয়ের দেশম ও ওয়ালিদ রেগরেগুই
যে ফ্রান্সকে নিয়ে অনেকেরই আশঙ্কা ছিল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়ার, সেই দলটিই কিনা আজকে সেমিফাইনালে। শেষ চারের লড়াইয়ে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন দলটির প্রতিপক্ষ মরক্কো। আজকের ম্যাচে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি নজর থাকবে দুই কোচের উপর। দিদিয়ের দেশম ও ওয়ালিদের উপর তাই স্পটলাইটটা থাকবে।
এদিকে আবার রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেশম। ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। ২০১৮তে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ফ্রান্সকে। চার বছরের ব্যবধানে আরেকটি ফাইনালের দ্বারপ্রান্তে দিদিয়ের দেশম। কাতারে যদি ট্রফিটা শেষ পর্যন্ত ফরাসিদের হাতে ওঠে, তাহলে দারুণ এক কীর্তিতে নাম লেখাবেন তিনি। কোচ হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড আছে শুধু ইতালির ভিত্তোরিও পোজ্জোর। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে ইতালিকে চ্যাম্পিয়ন বানান কোচ পোজ্জো। ফ্রান্স ফাইনালে গেলেও একটি রেকর্ড হয়ে যাবে দেশমের। বিশ্বকাপে দুইবার ফাইনালে যাওয়া চতুর্থ কোচ হবেন তিনি।
পোজ্জোর সাথে এই রেকর্ডে আছেন জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও ব্রাজিলের মারিও জাগালো। জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক বেকেনবাওয়ার কোচ হিসেবে ১৯৮৬ সালে প্রথমবার দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। সেবার আর্জেন্টিনার কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি। তবে পরের আসরে সেই আর্জেন্টিনাকেই ১-০তে হারিয়ে মেটে বেকেনবাওয়ারের আক্ষেপ। ব্রাজিলিয়ান কোচ মারিও জাগালো ১৯৭০ সালে দেশকে এনে দিয়েছিলেন ট্রফি। জাগালোর অধীনে ১৯৯৮ সালেও ফাইনাল খেলে ব্রাজিল। তবে ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায় তারা। দিদিয়ের দেশমের খেলোয়াড়ি জীবনও ছিল সাফল্যে ভরা। অলিম্পিক মার্শেই ও জুভেন্টাসের হয়ে দুইবার জিতেছেন ইউরোপের ক্লাব পর্যায়ের এলিট টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লীগ। ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ ছাড়া একটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিও রয়েছে দেশমের। তবে সফল খেলোয়াড়রা সফল কোচ হয়েছেন এমন নজির কমই। হাতে গোনা যে ক’জন মাঠ ও ডাগআউট উভয় জায়গায় সফল, দেশম তাদের অন্যতম। ১০ বছর ধরে ফ্রান্সকে কোচিং করাচ্ছেন তিনি।
এই সময়ে অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। এখনো যাচ্ছে। ফরাসি ফুটবল প্রধান নোয়েল লা গ্রায়েতের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির তদন্ত চলমান। লা গ্রায়েত দেশমের কাছের লোক। গ্রায়েত যদি শেষ পর্যন্ত টিকতে না পারেন তো দেশমের গদিতেও টান পড়তে পারে। তবে বিশ্বকাপ জিতলে টিকে যেতে পারেন তিনি। এদিকে দেশমের টেনশন বাড়াবে টেকো মাথার লোকটিও । একটা সময় ছিলেন সহকারী কোচ। এর পর মাঝের সময়টা তার কাটে বিভিন্ন ক্লাবে। বিশ্বকাপের আগে অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন ওয়ালিদ রেগরেগুই। এরপর যেন ছবির মতো সব পাল্টে দিলেন। ডাগআউটে পকেটে হাত দিয়ে ঠান্ডা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো নন তিনি। পুরো ৯০ মিনিট ফোঁসফাঁস করেই কাটান। এরপর ক্ষণে ক্ষণে বদলান ম্যাচের কৌশল। সারাক্ষণ বোধ হয় তার মাথায় ঘুরতে থাকে, কাকে নতুন করে কোথায় নামালে কী হবে। মাথায় চুল নেই, অবশ্য নেই বললে ভুলই হবে। কোচদের ফ্যাশনের অংশ হিসেবে অনেকেই চুল ছেঁটে ফেলেন।
ওয়ালিদ রেগরেগুইও তেমন বেশভূষার একজন। অনুকরণ করেন এই সময়ে অন্যতম সফল কোচ জিনেদিন জিদানকে। নিজে মরক্কোর পাশাপাশি ফ্রান্সের নাগরিকত্বও নিয়ে রেখেছেন। এবার সেই ফ্রান্সের সামনে তার দল। অন্য পাশে আরেক জাদরেল কোচ দিদিয়ের দেশম। ম্যাচ রিডিং, স্ট্র্যাটেজি, সবখানেই তিনি নিখুঁত। তবু বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে এই টেকো মাথার লোকটিই হবে দেশমের টেনশনের অন্যতম কারণ। যদিও দুইজনের প্ল্যানিং, টেকনিক, সবই ভিন্ন। দেশম কাউন্টারে খেলতে পছন্দ করেন। তার মূল হাতিয়ার গতি। মিডফিল্ডে ভিন্নতা। মাঝেমধ্যে লং বল দিয়ে ফরোয়ার্ডদের রিলিজ করা। মাঝেমধ্যে থ্রু পাস দেওয়া। উইংব্যাকরা ওভারল্যাপ করে ক্রমাগত ক্রস বাড়াবেন। মূল তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পের সুবিধা হয়, এমনভাবেই ফরমেশনটা সাজান তিনি। বেশিরভাগ ম্যাচেই ৪-২-৩-১ বা ৪-৩-৩ এমন ফরমেশনে একাদশ নামান। তাছাড়া দেশম নিজেও দারুণ ফুটবলার ছিলেন। সে জন্য তার ম্যাচ রিডিংও দুর্দান্ত। গ্রুপ পর্বে আন্তোনিও গ্রিজম্যানকে তিনি মাঝমাঠের সঙ্গে আক্রমভাগেও কাজে লাগিয়েছেন।
যেহেতু মিডফিল্ড এবার তরুণদের নিয়ে সাজিয়েছেন তিনি, সে জন্য তাদের সাথে আক্রমণ তৈরি করে দিতে গ্রিজম্যানকে ব্যবহার করছেন প্রায় ম্যাচেই। রেগরেগুই সুযোগ সন্ধানী। ওত পেতে রাখেন পরের ডি বপে। সারাক্ষণ প্রতিপক্ষ ভালো খেললেও তার দুঃখ নেই। কারণ একটা সুযোগ পেলেই কাজে লাগিয়ে দেন তার ছাত্ররা। সেটাই তাকে এতদূরে নিয়ে এসেছে। মস্তিস্কের লড়াইটাও তাই জমজমাট হবে আজকে।