মেসির প্রথম নাকি এমবাপ্পের দ্বিতীয় শিরোপা

মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৫২

লিওনেল মেসি ও কিলিয়েন এমবাপ্পে। ছবি: সংগৃহীত
লিওনেল মেসি ২০১৪ সালে একবার ফাইনাল খেললেও শিরোপা জিততে পারেনি। অন্যদিকে ২০১৮ সালে একবার ফাইনালে খেলেই চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হয়ে গেছেন কিলিয়েন এমবাপ্পে।
আজ রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত ৯ টায় কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সময়ের দুই সেরা মেসি-এমবাপ্পের লড়াই। সেখানে মেসির প্রথম নাকি এমবাপ্পের দ্বিতীয় শিরোপা জয় সেটা দেখার অপেক্ষা এখন। যে লড়াই শেষে একদল সোনালি ট্রফি হাতে বাড়ি ফিরবে। অন্য দলের সঙ্গী হবে আফসোস!
কোন দলের হাতে উঠবে স্বপ্নের ট্রফি? আর্জেন্টিনা নাকি ফ্রান্সের? বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স নাম লেখানোর পর থেকেই আলোচনা চলছে। গত বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। সেই পরাজয়ের মোক্ষম প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ লিওনেল মেসিদের সামনে। পাশাপাশি বিশ্বকাপে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘুচানোর সুযোগও আছে আলবেসিলেস্তদের। তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতে ফ্রান্স ও উরুগুয়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনা। দুটি করে বিশ্বকাপ জিতে তিন দলই বর্তমানে আছে সমান্তরালে।
কিন্তু ফ্রান্সও বিশ্বকাপ ট্রফির দিকে পাখির চোখ করে তাকিয়ে আছে। টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতে তারা ব্রাজিল ও ইতালির পাশে নাম লেখাতে চায়। ব্রাজিল ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতেছে। বিশ্বকাপে এমন ঘটনা ওটাই ছিল শেষ। এর আগে ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে টানা দুবার বিশ্বকাপ জয় করেছে ইতালি। ফ্রান্স কি ব্রাজিল ও ইতালির পাশে নাম লেখাতে পারবে?
আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের ফুটবলীয় লড়াইয়ে এগিয়ে আর্জেন্টিনাই। আলবেসিলেস্তদের ছয় জয়ের বিপরীতে ফ্রান্সের জয় তিনটি। অতীত লড়াইয়ের পাশাপাশি বর্তমান পারফরম্যান্স বিচার করলে দল দুটির লড়াইয়ে কাউকে এককভাবে এগিয়ে রাখা বেশ কঠিন। ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম যেমন লিওনেল মেসির প্রতি সম্মান রেখে কথা বলছেন। তেমনি আর্জেন্টাইনরাও ফ্রান্সের প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলছেন।
ফরাসি তারকা আতোয়ান গ্রিজম্যান বলে দিয়েছেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই লিওনেল মেসি বিশ্বের সেরা ফুটবল তারকা। তবে আমরা বিশ্বকাপ জয়ের জন্যই খেলতে নামব।’
আর্জেন্টাইনরাও জানেন, ফ্রান্সের শক্তি অনেক। কিলিয়ান এমবাপ্পের গতির সাথে লড়াই করাই বেশ কঠিন। সেখানে আছেন আতোয়ান গ্রিজম্যান এবং ওসমান ডেম্বলেদের মতো তারকারা। লক্ষ্যভেদে বুড়ো অলিভিয়ের জিরদ এখনো অতুলনীয়। ডিফেন্সে রাফায়েল ভারানেরা বর্তমান বিশ্বের সেরাদের সারিতে। তাই বলে ফ্রান্সকে মোটেও ভয় পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তাদের সামনে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা বেশ ভালোভাবেই সাজিয়ে দিয়েছেন লিওনেল স্কালোনি। তারা এখন ড্রেসিং রুমে গান গায়, বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে।
লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখতে চায় তারা। বিশ্বকাপটা জিততে চায় আর্জেন্টিনার জন্য। দিয়েগো ম্যারাডোনার জন্য। আর্জেন্টিনার লক্ষ্যের সাথে মিশে আছে আবেগ। ভালোবাসা। পৃথিবীর কোটি কোটি ভক্তের শুভকামনা। অন্যদিকে ফরাসিরা আবেগের রাশটা টেনে রেখে বাস্তবতাকে সাথে নিয়ে সামনে চলছে। টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে কোনো ভুল করতে রাজি নন দিদিয়ের দেশম।
আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য অবশ্য একটা সুখবর আছে। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালে যে আকাশি নীল-সাদা জার্সি গায়ে ফাইনাল খেলে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা, লিওনেল মেসিরা এবার সেই একই রঙের জার্সি গায়ে খেলতে নামবেন। এই খবর আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের মধ্যেও নাকি দারুণ উৎসাহ এনে দিয়েছে। ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা।
আজ রবিবার সেই ফাইনালে কি তৃতীয় ট্রফিটা জিততে পারবে তারা! দুই দলেই আছে বিশ্বমানের ফুটবলার। যারা নিজেদের কাজটা শতভাগ করতে জানেন। এ কারণেই ফাইনালের লড়াইটা হয়ে উঠবে আরও সুন্দর। আরও মধুর। আরও কঠিনও নয় কী! আর্জেন্টাইন সমর্থকরা দোহা দখল করে বসে আছে। তারা বিশ্বকাপ ট্রফি ছাড়া ঘরে ফিরতে রাজি নয়। ফরাসি সমর্থকের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তারাও দাবি ছাড়ার পাত্র নয়। ফুটবলারদের পাশাপাশি দর্শকদের মধ্যেও চলছে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।
এদিকে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে অবশ্য আর্জেন্টিনা। দুই দলের সর্বশেষ সাক্ষাতের স্মৃতি আর্জেন্টাইনদের জন্য সুখকর নয়। ৩ গোল করেও ৪-৩ ব্যবধানে হেরে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল হোর্হে সাম্পাওলির দলকে। জোড়া গোল করে তরুণ এমবাপ্পে সে ম্যাচেই বিশ্বমঞ্চে আগমনীবার্তা দিয়েছিলেন। তবু মুখোমুখি লড়াইয়ের ইতিহাস কিন্তু ফ্রান্সের পক্ষে নয়। সেখানে আলবিসেলেস্তের প্রাধান্য। প্রীতি ম্যাচ, বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট ১২ দেখায় আর্জেন্টিনার জয় ৬টি। ফ্রান্স জিতেছে ৩টি, ড্র ৩ ম্যাচ।
প্রথম মুখোমুখি সেই প্রথম বিশ্বকাপে, ১-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের মোট তিনবার দেখা হয়েছে দুই দলের। প্রথম ও সর্বশেষ আসরের আগে ১৯৭৮- এ একই গ্রæপে পড়েছিল দুই দল। সেজার লুই মেনোত্তির দল জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। লিওনেল মেসির ফরাসিদের বিপক্ষে প্রথম দেখা ২০০৯-এ। মার্সেইয়ের সেই প্রীতি ম্যাচে ২-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। মেসি গোল করেছিলেন, সঙ্গে হোনাস গুতিয়েরেস, কোচ ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এবার একেবারে অখ্যাত হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া লিওলেন স্কালোনির অধীন সেই ফ্রান্সের বিপক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটিতে মুখোমুখি হচ্ছে আকাশি-সাদারা।
ক্রোয়েশিয়াকে বিপক্ষে সেমিফাইনালের দারুণ জয়ের পর একটি দিন পুরো বিশ্রামে কাটিয়েছেন লিওনেল মেসিরা। কাতার বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে গতকাল দুপুর থেকে তাঁরা প্রস্তুতি শুরু করেছেন ফাইনালের। পোল্যান্ড ম্যাচে পেশিতে চোট পাওয়া আনহেল দি মারিয়া নেদারল্যান্ডস ম্যাচে কিছু সময় বদলি নেমে খেলেছিলেন। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেই প্রয়োজন মনে করেননি স্কালোনি। ফাইনালের জন্য তাঁকে পুরো ফিট করে তোলার চেষ্টা হবে এই কয়েক দিনে।
দি মারিয়া ফিরলে মিডফিল্ডে এনসো ফের্নান্দেসকে রেখে লিয়ান্দ্রো পারেদেসকে আবার হয়তো বেঞ্চে রাখা হবে। নক আউট পর্বে এ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ অনুযায়ী কৌশল সাজিয়ে সফল স্কালোনি। নেদারল্যান্ডসকে আটকাতে যেমন ৫ ব্যাক নিয়ে খেলেছিলেন। আর্জেন্টিনা তাতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২-০ তে এগিয়েও গিয়েছিল। ক্রোয়েশিয়ার শক্ত মিডফিল্ডের বিপক্ষে আবার ৪-৪-২ ফরমেশনে গিয়ে লুকা মডরিচদের তিনি অকার্যকর করে রেখেছেন। কিলিয়ান এমবাপ্পেদের বিপক্ষে ৫-৩-২ (৩-৫-২), নাকি ৪ ব্যাক, ৪ মিডফিল্ডার অথবা দি মারিয়াকে নিয়ে ৪-৩-৩-এ ফেরেন, সেটাই দেখার।
তবে স্কালোনির জন্য সুখবর হলো দুই ফুল ব্যাক মার্কোস অ্যাকুনিয়া ও গনসালো মনতিয়েল নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফাইনালে ফিরছেন। স্কোয়াডের একমাত্র আলেহান্দ্রো গোমেসের খেলা নিয়ে যা একটু সংশয় আছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে গোড়ালিতে চোট পাওয়া এ ফরোয়ার্ড এই পর্যন্ত আর মাঠে নামেননি। চিরচেনা আকাশি-সাদা জার্সিতেই এ ম্যাচে মাঠে নামবে আর্জেন্টিনা। যেমনটি তারা নেমেছিল ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ ফাইনালেও। তবে সর্বশেষ ২০১৪ ও ১৯৯০-এর ফাইনালে নিজেদের দ্বিতীয় রং নীল পরে খেলেছিল মেসি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনার দল। দুটিতেই প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। দুটিতেই হেরেছিল আর্জেন্টিনা।